খুশি করা গেল না রাবাতকে। তবে জাহাজ থেকে নেমে গেলেন না। ছেলেদের নিয়ে ওপরের ডেকে রেলিঙের ধারে এসে দাঁড়ালেন। বন্দরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। প্রচুর লোকজন নানা কাজে ব্যস্ত। একটু দূরের একটা পার্কে খেলা করছে বাচ্চারা। খুব উপভোগ করছিলেন তিনি। হঠাৎ একটা দৃশ্য রাগিয়ে দিল তাকে।
হাত তুলে চিৎকার করে উঠলেন, দেখো! দেখো, ওই দ্বিতীয় লোকটা!
তার নির্দেশিত দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। বন্দরে জেটির কাছে রেখে আসা বুইকটা দেখা যাচ্ছে। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। কৌতূহলী হয়ে গাড়িটা দেখছে।
চোখ বড় বড় করে ফেলল কিশোর। সেই লোকটা, মনটিরেতে যার সঙ্গে দেখা করেছিল মিলার।
ওই ব্যাটাই, তাই না? রাবাত বললেন। দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা!
মেইন ডেকে নামার সিঁড়ির দিকে দৌড় দিলেন তিনি। কিন্তু লোকজন। ভিড় করে উঠে আসছে। ইঞ্জিনও চালু হয়ে গেছে। কাঁপতে শুরু করেছে লা ক্রস কুইন। রাবাত মেইন ডেকে নেমে আসার আগেই চলতে শুরু করল জাহাজ। দূরত্ব বাড়ছে জেটির সঙ্গে।
.
১৩.
জাহাজটার আবার জেটিতে ফিরতে এক ঘণ্টার বেশি লেগে গেল। সবার আগে নামলেন রাবাত আর তিন গোয়েন্দা। দৌড় দিলেন বুইকের দিকে।
গাড়ির কোন ক্ষতি করা হয়নি। তালা ভেঙে দরজা খোলারও চিহ্ন নেই। হামাগুড়ি দিয়ে নিচে ঢুকে গেল মুসা, আবার যন্ত্রটন্ত্র কিছু লাগিয়ে দিয়েছে কিনা। দেখার জন্যে। ট্রাংক খুলে সুটকেসগুলো বের করে আনল রবিন আর কিশোর। ওগুলোর ভেতরও দেখল। রাবাত দেখলেন সীট আর ড্যাশবোর্ডের নিচে। হুড তুলে ইঞ্জিনের চারপাশের খালি জায়গায়ও দেখলেন।
নেই! ঘোষণা করলেন তিনি। তাহলে ওই ইবলিসটা এসেছিল কেন? আবার আমাদের খুঁজে বের করল কি ভাবে? যন্ত্রটা তো খুলে ফেলে দিয়েছি!
হয়তো অপেক্ষা করে করে, রবিন বলল।
অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল অন্যেরা।
আমার কথাই বলি। ধরা যাক, যাকে ধরতে চাই তার গন্তব্য জানা আছে আমার। পথের মাঝে তাকে হারিয়ে ফেললাম। বুঝলাম অন্য কোন ঘুরপথে পালিয়েছে। তখন তাকে ধরতে হলে কি করব? তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে এমন কোথাও বসে থাকব, যেখান দিয়ে ট্যুরিস্ট যাতায়াত করে। টুরিস্ট স্পট। অপেক্ষা করতে থাকব। নজর রাখব। লা ক্রসে এসে অবশ্যই আমি জাহাজঘাটায় খোঁজ নেব, আমার লোকটা জাহাজে উঠে বেড়াতে যাচ্ছে কিনা দেখার জন্যে। কারণ বেশির ভাগ ট্যুরিস্টই এখানে এসে এই কাজ করে। এ মাথা ঝাঁকালেন রাবাত। ঠিক। এটাই ঘটেছে। চালাক ছেলে তুমি, রবিন। তোমরা তিনজনই খুব চালাক।
এখান থেকে কেটে পড়া উচিত আমাদের, রবিন বলল। এখন থেকে টুরিস্টরা যে সব জায়গায় যায়, সে-সব এড়িয়ে চলব আমরা। মেইন রোডে যাব না পারতপক্ষে। তাহলেই আর খুঁজে পাবে না আমাদের।
হ্যাঁ, তাই করতে হবে। তাড়াতাড়ি কেটে পড়া উচিত এখন। একবার নিউ ইয়র্কে পৌঁছে গেলে আর কিছু করতে পারবে না মিলার। ওর সুযোগ শেষ হয়ে যাবে।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই লা ক্রস থেকে বেরিয়ে এল ওরা। বেশ কিছু ছোট ছোট রাস্তা দক্ষিণ-পশ্চিমে চলে গেছে। সেগুলো ধরে এগোল। রাত কাটাল ইলিনয় রাজ্যের রকফোর্ড শহরের বাইরে একটা সরাইখানায়।
পরদিন সকালে শিকাগো শহরে পৌঁছল ওরা। ছেলেদের লেক শোর ড্রাইভ দেখাতে নিয়ে গেলেন রাবাত। লেক মিশিগানের দিকে মুখ করা প্রচুর। দামী দামী সৌখিন বাড়ি আর বহুতল অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং দেখা গেল।
বাড়ি ফিরে বলতে পারবে এখন, মিশিগান হ্রদ দেখতে গিয়েছিলাম, হেসে বললেন রাবাত।
শহরের সবচেয়ে লম্বা একটা বাড়ির ওপরের তলার রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া সারল ওরা। তারপর পাড়ি জমাল ইনডিয়ানার ভেতর দিয়ে।
রাত কাটাতে থামল স্টারজিসে। রবিনের ক্যামেরার ফিল্ম ফুরিয়ে গেছে। শহরের প্রধান সড়কের ধারে ক্যামেরার দোকান আছে, তবে বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা। সুপারমার্কেটে গেল রবিন।
দোকানে ঢুকে কোণের দিকে একটা কাউন্টার দেখতে পেল। যে লোকটা তার কাছে ফিল্ম বিক্রি করল, সে অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার। টাকা। দিয়ে দরজার দিকে এগোল রবিন। হঠাৎ পথরোধ করা হলো তার।
সেই সুবেশী লোকটা, মনটিরেতে মিলারের সঙ্গে দেখা করেছিল যে, লা ক্রস বন্দরে ওদের গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল।
চোখে চোখে তাকিয়ে রইল রবিন। কথা বেরোল না। নড়তে পারল না।
তোমার সঙ্গে নেই ওটা, ভোতা, খসখসে গলায় বলল লোকটা। তবে। অসুবিধে নেই। আদায় করে নিতে পারব।
রবিনের হাত চেপে ধরল সে। এসো। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
সরে যাওয়ার চেষ্টা করল রবিন। পারল না। কব্জিতে ইস্পাতের মত শক্ত হয়ে চেপে বসেছে লোকটার আঙুল। স্বয়ংক্রিয় দরজার দিকে ওকে টেনে নিয়ে চলল লোকটা। দরজার কাছাকাছি আসতেই হুশ করে খুলে গেল পাল্লা। দরজার ওপাশে পার্কিং লট, তার ওপাশে…
ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলেছে রবিনের মাথায়। লোকটার সঙ্গে নিশ্চয় মিলারও এসেছে। লুকিয়ে আছে কোথাও। রবিনকে আটকে রেখে দুজনে মিলে মুক্তিপণ হিসেবে রাবাতের কাছ থেকে তার আবিষ্কারটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করবে। যদি দিতে অস্বীকার করেন রাবাত? ওকে কি করবে ওরা?
চিৎকার করে উঠল রবিন। লোকটার পায়ে গোড়ালি দিয়ে লাথি মেরে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। লাগাতে পারল না। ঝট করে পা সরিয়ে নিয়েছে লোকটা। তারমানে জুডো-কারাত জানা আছে তারও। সহজ লোক নয়।