সোজা গাড়ির ট্রাংকের দিকে রওনা দিলেন তিনি। সুটকেসগুলো বের করে এনে মাটিতে ফেললেন। হ্যাঁচকা টানে সীটগুলো সরিয়ে নিয়ে এলেন সামনের দিকে।
সামনের সীটের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। তারপর হাত দিল ড্যাশবোর্ডের নিচে।
জিনিসটা খুঁজে বের করল অবশেষে রবিন। হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল গাড়ির নিচে। সাবানের সমান একটা প্লাস্টিকের বাক্স বের করে আনল। পেট্রোল ট্যাংকে টেপ দিয়ে আটকানো ছিল।
ওর একটা দাঁতও রাখব না আমি! ভীষণ রাগে একটা পাথর তুলে নিলেন রাবাত। আমার ওপর গুপ্তচরগিরি!
যা দাঁড়ান, দাঁড়ান! বাধা দিল কিশোর। একটা গাছের ডালে রেখে দিল। যন্ত্রটা। হেসে বলল, থাক এটা এখানে, সঙ্কেত পাঠাক মিলারের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, থাকুক ব্যাটা ওখানে বসে।
সুটকেসগুলো আবার আগের জায়গায় তুলে রাখল তিন গোয়েন্দা। গাড়ি স্টার্ট দিলেন রাবাত। রাস্তায় উঠলেন না। মাঠের ওপর দিয়ে এগিয়ে চললেন উত্তরে। ক্রমে সরে যেতে থাকলেন হাইওয়ে থেকে
ফিরে তাকাল রবিন। এখনও অফিসারের সঙ্গে কথা বলছে মিলার মাথা চুলকাচ্ছে অফিসার। মনে হচ্ছে, কোন কিছু অবাক করেছে তাকে।
কিছুদূর এগিয়ে একটা রাস্তা দেখা গেল। সেটাতে উঠে পড়লেন রাবাত। কয়েকটা গায়ের ভেতর দিয়ে গেছে পথটা। দুই ধারে মাঝে মাঝেই পড়ছে বিস্তৃত পশুচারণভূমি। গরু-ঘোড়া চরছে। দক্ষিণ ডাকোটার পিয়েরিতে পৌঁছে মিসৌরি নদী পার হয়ে এল ওরা। তারপর কয়েকটা ছোট ছোট শহর। পশুচারণভূমি অনেক আছে এখানেও।
মিনেসোটা সীমান্তের মাইল পঞ্চাশেক দূরে একটা ছোট সরাইয়ে রাত কাটাতে উঠল ওরা। গ্যারেজ আছে। তাতে তালা দেয়ার ব্যবস্থাও আছে। গাড়ি ঢুকিয়ে রাখলেন রাবাত। সরাইয়ের মালিক এক হাসিখুশি মহিলা। নাম মিসেস আরগন। প্রচুর কথা বলে। সারাক্ষণ বকবক করে গেল। একাই কথা বলল। তার প্রশ্নের জবাব দিল কিনা কেউ, সেটাও লক্ষ করল না।
রাতে চমৎকার রান্না করে খাওয়াল মহিলা। সকালে দিল আঞ্চলিক নাস্তা।
আবার বেরিয়ে পড়ল ওরা। বাতাস কোমল, ভেজা ভেজা। গালে এসে লাগছে।
মিনেসোটা পেরোনোর সময় হাইওয়ে থেকে দূরে রইল। তবে রোচেস্টারে এসে আবার হাইওয়েতে উঠল। উইসকনসিনের লা ক্রসের দিকে এগোল।
রাবাতের মেজাজ ভাল বললেন, মিলার আসুক আর না-ই আসুক, লা ক্রসে থামব আমরা। এখানে বড় হয়েছিল মুসার নানী। এত সুন্দর শহর খুব কমই আছে।
তা থাকা যায়। মিলারের চিন্তা মাথা থেকে দূর করে দিলেই পারি, মুসা বলল। তার যন্ত্রটা খুলে ফেলে দিয়েছি। আর পিছু নিতে পারবে না সে।
ওই শেয়ালটাকে বিশ্বাস নেই। আরেকটা বুদ্ধি বের করে ফেলতে পারবে। পিছু নেয়ার জন্যে তৈরি হয়েই বেরিয়েছে সে। আমার বাড়িতেও নিশ্চয় ওধরনের যন্ত্র অনেক লাগিয়েছে। তাতে করে জেনে গেছে, আমি কি করছি।
আগে হলে এ সব কথায় গুরুত্ব দিত না কিশোর। কিন্তু এখন বিশ্বাস করল। মিলার ওদের পিছু নিয়েছে রাবাতের আবিষ্কৃত জিনিসটা ছিনিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যেই।
জিনিসটা কি? অনুমানও করতে পারল না কিশোর। কারণ করার মত কোন সূত্রই নেই তার হাতে। যন্ত্রটা খোঁজার সময় আবিষ্কারটাও পাওয়ার আশায় ছিল সে। নজর রেখেছিল। কিছুই চোখে পড়েনি। তবে কি রাবাতের পকেটে আছে? নাকি মাথায়? মাথায় থাকলে মিলার ওটা চুরি করবে কি করে?
মনটিরেতে ওই লোকটার সঙ্গে কি জন্যে দেখা করেছিল মিলার? ফিশারম্যান ওআর্ষে সেই যে লোকটা, দামী পোশাক ছিল যার পরনে, গণ্ডগোলের সম্ভাবনা দেখেই যে কেটে পড়েছিল, উধাও হয়ে গিয়েছিল মুহূর্তে। রাবাতের প্রতি তার তেমন নজর ছিল বলে মনে হয়নি, কোন আকর্ষণ ছিল না। মিলারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল কেন?
ওই যে! রাবাতের আচমকা চিল্কারে ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এল কিশোর।
সামনে একটা নদী। ওপরে ব্রিজ। রাবাত জানালেন, নদীটা মিসিসিপি। নদীর মাঝখানে অনেক চড়া, দ্বীপের মত হয়ে আছে। ঘন গাছে ছাওয়া। নদীর অন্য পাড়ে একটা শহর।
ওইটাই লা ক্রস, বললেন তিনি। আজ রাতে ওখানে থাকব।
বিকেলে সেদিন নদীর পাড়ের একটা রেস্টুরেন্টে খাবার খেলো ওরা। বেরিয়ে এল আশপাশের অঞ্চল ঘুরে দেখার জন্যে। কাদার মধ্যে খোঁচাখুঁচি করছে মাড সোয়ালো পাখি। একটা দ্বীপের ধারে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছে একটা বড় বক।
মার্ক টোয়েনের সময়ও নিশ্চয় এমনই ছিল মিসিসিপি, রাবাত বললেন। মনে আছে, হাকলবেরি ফিনের সঙ্গে একটা দ্বীপে গিয়ে লুকিয়েছিল টম সয়্যার? নিশ্চয় ওরকমই কোন দ্বীপ ছিল সেটা।
একটা কাজ করলে তো পারি, রবিন বলল, একটা জাহাজে চড়ে বসি। মোটেলের ডেস্কে লেখা দেখলাম এক ঘণ্টা পর পরই লা ক্রস থেকে বোট ছাড়ে, ভাটির দিকে যায়।
ঠিক! তুড়ি বাজালেন রাবাত। আমরাও যাব! তবে রাতে নয়, কাল সকালে।
পরদিন সকাল পৌনে এগারোটায় লা ক্রস কুইন নামে একটা জাহাজে চড়ে বসল ওরা। ওটা ডিজেল ইঞ্জিনে চলবে শুনে হতাশ হলেন রাবাত। তিনি আশা করেছিলেন, পুরানো ধরনের বাষ্পীয় ইঞ্জিনে দুই পাশে বড় বড় গরুর গাড়ির চাকার মত হুইল দিয়ে চালানো হবে। মিসিসিপির পুরানো ঐতিহ্য। যাত্রাটাই না বাতিল হয়, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি মুসা বোঝানোর চেষ্টা করল, ডিজেল ইঞ্জিন অনেক বেশি নিরাপদ। আগের বাষ্পীয় ইঞ্জিনগুলো তো দুর্ঘটনা ঘটাত। বিস্ফোরিত হয়ে গিয়ে কত বোট ডুবিয়ে দিয়েছে নদীতে।