গাড়ির পাশ কাটানোর সময় ফিরে তাকাল দলপতি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার দিকেও তাকালেন রাবাত। চোখে চোখ আটকে গেল দুজনের। চোখ বড় বড় হয়ে গেল লোকটার। গোল হয়ে গেল মুখ। ধীরে ধীরে বিকৃত হাসিতে রূপ নিল সেটা। রাবাত আর ছেলেদের দেখিয়ে সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে কিছু বলল।
হয়েছে কাজ, বলে উঠল রবিন, ধরবে এবার আমাদের! সেদিন হেরে যাওয়ার প্রতিশোধ নেবে আজ!
বুইকটাকে ঘিরে ফেলল সাইকেলগুলো। গতি কমিয়ে ফেলেছে।
আচমকা গতি বাড়িয়ে দিলেন রাবাত। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল বুইক। তোয়াক্কাই করল না সামনের সাইকেলগুলো। গতি বেড়ে গেল ওদেরও। আগে আগে চলেছে। যেন ওদেরকে ধরার চ্যালেঞ্জ করেছে গাড়িটাকে।
ওরা জানে ধাক্কা দিয়ে ফেলতে পারব না ওদেরকে, তিক্তকণ্ঠে বললেন রাবাত, ঠিকই আন্দাজ করছে।
ব্রেক চেপে গতি কমিয়ে ফেললেন তিনি। বাঁয়ে তাকালেন। ধীরে ধীরে পাশে সরতে লাগলেন। জায়গা করে দিল পাশের সাইকেলটা। আরও সরালেন তিনি। আরেকটু জায়গা দিল সাইকেল। তাঁর মতলব বুঝতে পারল না।
হাইওয়ের পাশে মাঠ থেকে ধোয়া উঠছে। শুকনো ঘাস পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। বাতাস প্রায় নেই, তাই উড়ে না গিয়ে জমির ওপরই স্থির হয়ে আছে ধোয়া, রাস্তার ওপরেও উঠে এসেছে একটা অংশ। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তার ভেতরে ঢুকে যাবেন রাবাত। ছেলেদের বললেন, শক্ত হয়ে বোসো!
কি করতে যাচ্ছেন বলার সময় নেই। ধোয়ার মধ্যে ঢুকে গেল গাড়ি। অদৃশ্য হয়ে গেল মোটরসাইকেল আরোহীরা। চারপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না কেবল কুণ্ডলী পাকানো ধূসরতা ছাড়া। এক মোচড়ে স্টিয়ারিঙের অনেকখানি বায়ে ঘুরিয়ে দিলেন রাবাত।
রাস্তা থেকে প্রায় উড়ে সরে এল গাড়িটা। একটা মুহর্তের জন্যে শূন্যে ঝুলে রইল যেন। তারপর প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। রাস্তার ডিভাইডারের মাঝে নেমে এসেছে গাড়ি। মুসার মনে হলো, উল্টে যাবে। চিৎকার করে উঠল সে। কিন্তু অহেতুক ভয় পেয়েছে। গাড়ি ওল্টাল না। নিরাপদেই নেমে দাঁড়িয়ে গেল।
ভারী দম নিলেন রাবাত। পায়ের চাপ বাড়ালেন অ্যাক্সিলারেটরে। বনবন করে ঘুরতে লাগল চাকা। কয়েকবার পিছলে গিয়ে অবশেষে মাটি কামড়ে ধরল। ডিভাইডারের সমান্তরালে খাদের পাড় ধরে ছুটতে শুরু করল নাক বরাবর। ধোয়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল।
আবার স্টিয়ারিং অনেকখানি ঘুরিয়ে দিলেন তিনি। কঁকুনি খেতে খেতে রাস্তায় উঠে এল গাড়ি। আগের রাস্তা থেকে সরে চলে এসেছে আরেকটা রাস্তায়।
চিৎকার করে বলল মুসা, নানা, তুমি একটা জিনিয়াস!
এখনই চেঁচাবি না, সতর্ক করলেন রাবাত, আমরা কি করেছি বুঝতে দেরি হবে না ওদের। চলে আসবে তখন।
সামনে একটা এগজিট র্যাম্প দেখা গেল। সেটার দিকে ছুটলেন তিনি। সোজা নিচে নেমে এসে ছুটলেন আধ মাইল দূরের একটা গাছের জটলার দিকে। জটলার কাছে পৌঁছে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন ভেতরে। রাস্তা থেকে আর দেখা যাবে না এটাকে।
আমাদের দেখবে না ওরা, বললেন তিনি। ওরা ভাববে ধোয়া পার হয়ে সোজা সামনে চলে গেছি আমরা, সেদিকেই নজর দেবে।
ভারী হয়ে এসেছে তার নিঃশ্বাস। তবে মৃদু হাসি ফুটেছে ঠোঁটের কোণে। হাইওয়ের দিকে চোখ।
মিনিটখানেক পরেই দেখা গেল ওদের। সারি দিয়ে চলেছে পশ্চিমে। নজর সামনের দিকে। বুইকটাকে খুঁজছে।
খুব খারাপ লোক, রাবাত বললেন। আরও জ্বালাবে মনে হচ্ছে!
কিন্তু আমাদের পেছনে লেগেছে কেন? রবিনের প্রশ্ন।
বর্ণবাদী হতে পারে, অনুমানে বলল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর, আমার তা মনে হয় না। ওদের দলে কালো। লোকও আছে। শিওর, মিলার লাগিয়েছে। আমাদের কাবু করতে বলেছে ওদের। তারপর সে এসে ফর্মুলাটা কেড়ে নেবে। এর জন্যে নিশ্চয় টাকাও দিয়েছে ওদেরকে।
দূরে হারিয়ে গেল দলটা।
হঠাৎ হাত তুলল কিশোর, ওই, দেখুন! বললাম না, সব শয়তানি মিলারের!
ধূসর একটা লিংকন গাড়ি। কিশোর বলার মুহূর্ত পরই গতি কমিয়ে ফেলল।
বাহ, এসে গেছে, রাবাত বললেন।
রবিন বলল, আর কোন সন্দেহ নেই, গ্যাঙকে টাকা খাইয়েছে মিলার।
তাকে সামনে চলে যেতে দেয়া উচিত, মুসা বলল। ও এগিয়ে গেলে আমরা এগোব। পেছনে থেকে যাব তখন।
কিন্তু তাকে সে-সুযোগ দিল না লিংকন। গেল না। পথের ধারে কাঁচা জায়গায় নেমে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল। মুসারা যেখানে রয়েছে তার থেকে খুব বেশি দূরে নয়।
.
১২.
পার্কিং লাইট জ্বেলে দিয়ে অপেক্ষা করছে লিংকন।
শয়তানটা জানে আমরা এখানে আছি, রাবাত বললেন। কি করে জানল?
একটা পেট্রল কারকে আসতে দেখা গেল। লিংকনের কাছে গিয়ে থামল গাড়িটা। ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ অফিসার বেরিয়ে এল। দরজা খুলল মিলার। অফিসারের সঙ্গে কথা বলল। দুজনে এগিয়ে গেল লিংকনের সামনের দিকে। হুড তুলে ইঞ্জিন দেখতে লাগল।
ওসমস্ত অভিনয়, কিশোর বলল। গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ার ভান করছে। মিলার। গাড়ি থেকে বেরোল সে। কি করে আমাদের পেছনে লেগে রয়েছে, বোঝা দরকার।
কি করে? মুসার প্রশ্ন।
কোন ধরনের যন্ত্র রয়েছে আমাদের গাড়িতে, যেটা সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। সেই সঙ্কেত ধরে জেনে যাচ্ছে সে, আমরা কোথায় আছি। সামনে না এসে আড়ালে থেকেও আমাদের অনুসরণ করতে পারার এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা।
কিশোরের কথা বুঝে ফেললেন রাবাত। তারমানে বলতে চাইছ কোন ইলেকট্রনিক যন্ত্র লাগিয়ে দিয়েছে গাড়িতে!.