নানার দিকে তাকাল মুসা। নানা, অত হাসার কিছু নেই। ওর কাছে। পিস্তল আছে। পেছন থেকে গুলি মেরে দিলে গেছি। পুলিশকে জানানো দরকার।
আরও যাব পুলিশের কাছে মাথা নাড়লেন রাবাত। মোটেলে আগুন লাগলে যে অফিসারটা এসেছিল, মনে নেই? কি ভঙ্গিটাই না করল? যেন আমি একটা পাগল! নিজের চামড়া নিজেদেরই বাঁচাতে হবে আমাদের, কারও সাহায্য পাব না। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে অহেতুক আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। চল, যাই।
বড় করে দম নিলেন তিনি। বনের তাজা বাতাস টানলেন বুক ভরে। এই প্রথম তাকে নিশ্চিন্ত মনে হলো। এতদিনে ভার নামল আমার। মিলার যে পিছু নিয়েছে, এখন আমরা শিওর। তোদের সবার হাবভাব দেখে আমিও কিন্তু ভয় পেতে আরম্ভ করেছিলাম, সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাচ্ছি না তো!
পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর কিশোর। দুজনের চোখেই বিস্ময়।
আগে আগে চললেন রাবাত। পেছনে ছেলেরা।
গোধূলি বেলায় র্যাপিড সিটিতে পৌঁছল ওরা। একটা মোটেলে ঘর নিল। কাছের একটা ফাস্ট ফুডের দোকান থেকে বার্গার খেয়ে এসে বিছানায় শুয়ে মহা আনন্দে নাক ডাকাতে শুরু করলেন রাবাত।
বিছানায় চিত হয়ে ছাতের দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর। কি করে কাজটা করছে?
কার কথা বলছ? জানতে চাইল মুসা, মিলার, না নানা?
মিলার। যেখানেই যাচ্ছি ঠিক পিছে পিছে লেগে আছে। বের করে নিচ্ছে কোথায় আছি আমরা। কি ভাবে?
জবাব দিতে পারল না কেউ।
এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল ওরা।
পরদিন সকালে সবাই উত্তেজিত হয়ে রইল। রাস্তায় কড়া নজর। সামনে পেছনে দুদিকেই চোখ রেখেছে। সাউথ ডাকোটা ব্যাডল্যান্ড ধরে চলার সময় পথে দর্শনীয় কিছু দেখার জন্যে যেখানেই নামছে, গাড়ির কাছাকাছি থাকছে ওরা, চোখে চোখে রাখার জন্যে। ব্যাডল্যান্ডের নানা রকম পাথরের স্তূপ। মুসার অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। তার মনে হচ্ছে, অন্য কোন গ্রহে এসে হাজির হয়েছে, এটা পৃথিবী হতে পারে না! সব কিছুতেই যেন ভূতের ছোঁয়া দেখতে পাচ্ছে সে। অস্বস্তির আরও একটা বড় কারণ, তার সন্দেহ, ওসব পাথরের আড়ালে লুকিয়ে থেকে গুলি চালাতে পারে মিলার।
নানা, কি এমন আবিষ্কার করলে, যার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে সে? এই নিয়ে শতবার প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেছে মুসা।
খুব জরুরী জিনিস, একই জবাব দিলেন রাবাত। না জানবি যতক্ষণ, ততক্ষণ নিরাপদ। নইলে বলতে আর অসুবিধে কি ছিল।
ছোটবড় নানা আকারের, নানা ধরনের পাথরের চাঙড় আর আলগা পাথরের স্তূপ পেরিয়ে এল গাড়ি। প্রেইরি ডগ নামে এক ধরনের প্রাণীর এলাকায় এসে ঢুকল। মাটিতে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ওদের গর্ত। মুখের কাছে শুয়ে, রোদ পোয়াচ্ছে বিশাল ইঁদুরের মত দেখতে প্রাণীগুলো। গাড়িটাকে আসতে দেখলে বিচিত্র ভঙ্গিতে পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে সটান সোজা করে দিচ্ছে শরীরটাকে, তীক্ষ্ণ টিইং টিইং ডাক ছেড়ে সতর্ক করছে একে অন্যকে, গাড়ি বেশি কাছে চলে এলে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ছে গর্তের ভেতর। পরক্ষণেই আবার মাথা বের করে উঁকি দিচ্ছে।
.
বেলা বারোটার মধ্যেই ব্যাডল্যান্ড দেখা হয়ে গেল ওদের। হাইওয়েতে ফিরে এসে পুবে রওনা হলো। ভূমি এখন সমতল। সামনে মাইলের পর মাইল রাস্তা লম্বা হয়ে পড়ে আছে। বাঁক নিয়েছে খুবই সামান্য, ওঠানামা নেই। বললেই চলে। সামনেও গাড়ি আছে প্রচুর, পেছনেও আসছে অনেক, কিন্তু লিংকনটাকে দেখা গেল না। দ্রুত চালাচ্ছেন রাবাত। একের পর এক গাড়িকে ওভারটেক করে পিছে ফেলে আসছেন। পাশ কাটানোর সময় দেখছেন ড্রাইভারের চেহারা।
বেশ কিছুটা এগিয়ে এসে গতি কমিয়ে দিলেন তিনি। পেছনের গাড়িগুলোকে আগে চলে যেতে দিলেন। ড্রাইভারদের চেহারা দেখলেন। ওদের মধ্যে হ্যারিস মিলার নেই।
বুঝলাম না, অবশেষে বললেন তিনি, সামনেও নেই, পেছনেও নেই; আমরাও ওর পাশ কাটিয়ে আগে যাইনি, সে-ও আমাদের পাশ কাটিয়ে পেছনে যায়নি। কিন্তু বাজি ধরে বলতে পারি আশেপাশেই কোথাও আছে। কোথায়?
পেছনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে মুসা। হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। খাইছে! মোটরসাইকেল! নানা, ক্রিসেন্ট সিটির সেই গ্যাঙটা আসছে!
রিয়ারভিউ মিররের দিকে তাকালেন রাবাত। ক্রিসেন্ট সিটি এখান থেকে বহুদূর। কোথায় চলেছে ওরা? বখাটেদের সভা হচ্ছে নাকি কোথাও, যোগ। দিতে চলেছে?
সামরিক শৃঙ্খলায় দুই সারিতে এগিয়ে আসছে ওরা। পিঠ সোজা, দৃষ্টি সামনে স্থির। ক্রিসেন্ট সিটির সেই দলটাই। পরনে কালো চামড়ার পোশাক, বেল্ট আর দস্তানায় কাটা বসানো।
দ্রুত এগিয়ে আসছে ওরা। বুইকটাকে ধরে ফেলছে।
নানা, জোরে চালাও না কেন? উদ্বিগ্ন হয়ে বলল মুসা।
কারও ভয়ে পালাতে যাচ্ছি না আমরা, শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন রাবাত।
এত সাহস কেন? আগের বার দলটাকে কি করে নাকানি-চোবানি খাইয়েছেন রাবাত, মনে করে হাসল রবিন। এবারও তেমন কোন খেল দেখানোর অপেক্ষায় আছেন নাকি?
আমাদের ক্ষতি করতেই আসছে, এমন ভাবার কোন কারণ নেই, রাবাত বললেন। ক্রিসেন্ট সিটির দলটা হলেও এতদিনে নিশ্চয় আমাদের কথা ভুলে গেছে।
কাছে চলে এল বাইকগুলো। ইঞ্জিনের গর্জন শোনা যাচ্ছে। বুইকটাকে পাশ কাটানোর জন্যে বায়ে সরল দলপতি।
নানা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা, এই লোকটাই তোমাকে সেদিন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল।
নাক দিয়ে শব্দ করলেন রাবাত। হুঁ! চেহারাটা কি করে রেখেছে। সারামুখে দাড়িগোফ! এগুলো মানুষ না বনমানুষ, তাই কেবল ভাবি!