প্রায় দৌড়াতে শুরু করল কিশোর। চারপাশ থেকে ঘিরে এল জঙ্গল। প্রথম মোড়টার কাছে এসে ফিরে তাকাল। পেছনে রাস্তাটা দেখা যায় না। হারিয়ে গেছে গাছের ওপাশে।
আবার কানে এল গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। থামল গাড়িটা। দরজা খুলে বন্ধ হলো। রাস্তার পাশে বুইকটার কাছে গাড়ি রেখেছে কেউ।
তবে কি তার সন্দেহই ঠিক ছিল? মিলারই এসেছে? শ্বাস টানা বেড়ে গেল কিশোরের। ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেছে। খানিকটা পিছিয়ে পাশে সরে গেল সে। এখন দেখা যাচ্ছে রাস্তাটা। রাস্তা ধরে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। আগন্তুক। ভয় পেয়ে গেল কিলোর। মনে হলো খামচি দিয়ে ধরেছে কেউ হৃৎপিণ্ডটাকে। লুকিয়ে পড়তে হবে।
গাছপালার কারণে পাহাড়ের গোড়ায় বেশ ছায়া, অন্ধকারই বলা চলে। প্রচুর ঝোপঝাড় আছে। তবে ওগুলো বেশ দূরে। সে যেখানে রয়েছে সেখানে পথের ডান পাশে কয়েক গজ দূরে ম্যানজানিটা জাতীয় একধরনের গাছের ঝোপ, দেখতে পেল। বেশি বড় না। কাছাকাছি আর কিছু না দেখে ওটার দিকেই দৌড় দিল সে। প্রায় ডাইভ দিয়ে পড়ে ভেতরে ঢুকে গেল। লুকিয়ে গেল ডালপাতার আড়ালে। আস্তে করে ডাল সরিয়ে ফাঁক করে উঁকি দিল রাস্তার দিকে।
লোকটার মুখ দেখতে পেল না। পা চোখে পড়ল কেবল। শোনা যাচ্ছে নিঃশ্বাসের খসখসে শব্দ। দাঁড়িয়ে গেল লোকটা। পাহাড়ের দিকে মুখ। পায়ে বাদামী রঙের লোফার, পরনে জিনস। পাহাড়-জঙ্গলে আসার অভিজ্ঞতা নেই বোধহয়–অনুমান করল কিশোর, তাহলে এই পোশাক পরে আসত না। লোফারটা নতুন, জিনসেও ভাজ নেই তেমন, রঙ জ্বলেনি।
এখানে এসে দাঁড়িয়ে গেল কেন? এগোচ্ছে না কেন? কিছু দেখেছে? রাস্তা। থেকে সরে আসার আগে কোন চিহ্ন রেখে এসেছে কিশোর?
ঘাবড়ে গেল সে। মনে হতে লাগল, বড় বেশি খোলামেলা জায়গায় রয়েছে। কেউ আছে সন্দেহ করে যদি ঘুরে ভাল করে ঝোপের দিকে তাকায়। লোকটা, তাকে দেখে ফেলবে।
বাঁ পাশের ঝোপের ভেতর শব্দ হলো। ঘুরে তাকাল লোকটা। হুড়মুড় করে বেরিয়ে এল একটা বুনো জানোয়ার।
কি বেরোল দেখতে পেল না কিশোর, তবে সুযোগটা কাজে লাগাল। হাতের থাবা আর হাঁটুতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করল লোকটাকে দেখার জন্যে।
ধক করে উঠল বুক। দম বন্ধ করে ফেলল। লোকটার হাতে পিস্তল!
হাই! ডাকল কে যেন রাস্তা থেকে।
পথের দিকে তাকাল আগন্তুক। চওড়া কানাওয়ালা ঐ হ্যাঁটের নিচে তার চেহারা এখন দেখতে পাচ্ছে কিশোর। হ্যারিস মিলারকে চিনতে ভুল করল না।
মাথা নামিয়ে ফেলল কিশোর। আগের চেয়ে বেশি। মাটিতে শরীর। মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করল, যাতে মিলারের চোখে না পড়ে। ঘামছে। উঠে দৌড় দেবে? না, উচিত হবে না। বেরোলেই তাকে দেখে ফেলবে মিলার।
হাই, আবার বলল মহিলা, আমাকে মনে আছে? কাছে চলে এসেছে।
নীরবে হাসল কিশোর। গলা শুনেই চিনতে পেরেছে। সেই মহিলা, ডরোথি, মাউন্ট রাশমোরে রাবাতকে পাকড়াও করেছিল যে।
আমি ভেবেছি আর দেখা হবে না আপনার সঙ্গে, মহিলা বলছে। লাঞ্চের পর দেখি আপনি নেই! কত খোঁজা খুঁজলাম। নেই তো নেইই। যেন হাওয়া! এখানে কি করছেন? পাহাড় দেখতে এসেছেন বুঝি?
মিলারের হাত দেখতে পাচ্ছে না কিশোর। পিস্তলটা কি করেছে বুঝতে পারল না। নিশ্চয় পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে। মহিলা দেখেনি। দেখলে প্রশ্ন শুরু করে দিত। বিড়বিড় করে কি যেন বলল মিলার, ঠিক বোঝা গেল না–পেট্রল ফুরিয়ে গেছে, এ রকমই কি যেন বলল। মহিলা বকবক করতে লাগল। মিলারকে আবার খুঁজে পাওয়ার আনন্দে বিভোর। নিজের গাড়িতে তাকে লিফট দেয়ার প্রস্তাব দিল। মিলার যদি পাহাড়ের দিকে হাঁটতে যেতে চায়, তাহলে সঙ্গ দেবে। হাঁটার ব্যাপারেই আগ্রহ বেশি মহিলার।
রাজি হলো না মিলার। বলল, অনেক ঘোরাফেরা করেছে, এবার ফিরে যেতে চায়। গাড়ির দিকে এগোল সে। মহিলা ছাড়ল না। সঙ্গে সঙ্গে চলল। কথা বলার নেশায় পেয়েছে যেন। অনর্গল বকছে।
আবার মাথা তুলল কিশোর।
মিলারের হাত চেপে ধরেছে মহিলা। শক্ত করে ধরেছে, যেন আর হাওয়া। হতে না পারে মিলার।
হাসি পেল কিশোরের। মিলারের মনের অবস্থা কল্পনা করে হাসিটা বাড়ল। ভাল বিপদেই পড়েছে বেচারা। ওই মহিলার হাত থেকে ছাড়া পাওয়া বড় কঠিন ব্যাপার।
গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল দুজনে।
মিনিট দুই পরে প্রথমে একটা, তারপর আরেকটা গাড়ি স্টার্ট নেয়ার শব্দ কানে এল। চলে গেল গাড়ি দুটো।
ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল কিশোর। মুসাদের পিছু নেয়ার সময় নেই আর এখন। একটা পাথর দেখে তাতে বসে পড়ল। সঙ্গীদের আসার অপেক্ষা করতে লাগল।
১১.
মুসারা এসে তাকে ওভাবেই পথের পাশে বসে থাকতে দেখল।
কি ব্যাপার, এ ভাবে বসে আছ কেন? মুসার প্রশ্ন।
ভ্রূকুটি করল রবিন। কিছু ঘটেছে? তোমার মুখ অমন শুকনো কেন?
পিস্তল নিয়ে ও আমাদের পিছে পিছে আসবে কল্পনাও করতে পারিনি, মাথা নাড়তে লাগল কিশোর। প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম। রাবুনো, আপনার। কাছে আমাদের সবার মাপ চাওয়া উচিত।
তাই নাকি? কেন?
এখানেও এসে হাজির হয়েছে মিলার। পিস্তল আছে তার কাছে। একটু আগেও আপনার কথায় বিশ্বাস ছিল না আমার। কিন্তু এখন হয়েছে। আপনি ঠিকই বলেছেন, আমাদের পিছু নিয়েছে সে।
সব খুলে বলল কিশোর।
মহিলার কথায় আসতেই হাসতে শুরু করলেন রাবাত। চমৎকার! অচেনা কাউকে দেখলেই খাতির করতে আসে মেয়েমানুষটা। যাক, কিছুক্ষণের জন্যে নিশ্চিন্ত, মিলারকে আটকে রাখবে সে।