হু, আমারও! ভদ্রতা করার জন্যে কোনমতে বলে তাড়াতাড়ি পার্কিং লটের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন রাবাত। তার তিন পাশে বডিগার্ড হয়ে এগোল তিন গোয়েন্দা।
গাড়িতে উঠে মুসা যখন বুঝল এতক্ষণে নিরাপদ, নানার দিকে চেয়ে হেসে। বলল, নানা, মহিলা তোমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পায়তারা করছিল। আমরা না থাকলে মরতে! সোজা ধরে নিয়ে যেত।
নিলে নিত, রসিকতার জবাব রসিকতা দিয়েই দিলেন রাবাত, আরেকটা নানী পেয়ে যেতি। চিবুকটা সামনে ঠেলে দিয়ে বললেন, তাহলে বুঝলি তো, এখনও বুড়ো হইনি। মেয়েরা তাকায়।
হ্যাঁ, পঞ্চাশ বছরের মেয়ে।
এ কথার আর জবাব দিলেন না নানা।
পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে ঢাল বেয়ে নেমে এল আবার ওরা। গাড়ি ঘুরিয়ে কাস্টার স্টেট পার্কের দিকে এগোলেন রাবাত।
কাস্টার পার্কে বাইসন থাকে, কিশোর বলল। একসঙ্গে এত নাকি খুব। কমই দেখা যায়। চিড়িয়াখানার বাইসন আর বুনো বাইসনে অনেক তফাৎ। বুনোগুলো অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। এড়িয়ে চলা ভাল।
হেসে রাবাত বললেন, কিশোর, বেরোনোর আগে গাইড-বুকটাকে গুলে খেয়েছ নাকি? রাতে বসে বসে পাতা মুখস্থ করো?
মুখস্থ করা লাগে না, রবিন বলল, একবার পড়লেই যথেষ্ট। কম্পিউটারের মেমোরি ওর, কখনও ভোলে না।
আমারও এ রকম থাকলে ভাল হত। কাজে লাগত। মাঝে মাঝে তো মনে হয় নিজের নামই ভুলে যাচ্ছি। বললেন রাবাত।
বেশি ব্যস্ত থাকো বোধহয়, ফোড়ন কাটল মুসা। মহিলার কথা দিয়েই বলি–সব সময় তাজা, নতুন নতুন বুদ্ধি খেলে মাথার মধ্যে। সেজন্যে পুরানো কথা আর ধরে রাখতে পারো না, ভুলে যাও।
মেজাজ ভাল আছে নানার। মুসার কথায় কিছু মনে করলেন না।
ঢালু হয়ে গেছে এখন পথ। পথের মাথায় গেট পেরিয়ে কাস্টার স্টেট পার্কে ঢুকল গাড়ি।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন রাবাত, আরি, ওগুলো কি! গাড়ি থামি?, দিলেন।
রাস্তার ধারে জটলা করছে কতগুলো বুনো গাধা। গাড়িটাকে দেখে পাকা রাস্তায় খুরের খটাখট আওয়াজ তুলে এগিয়ে এল। নাক বাড়িয়ে দিল জানালার কাছে।
মনে হয় খাবার চায়! মুসা বলল।
রাবাত বললেন, খাবার দিয়ে দিয়ে অভ্যাস খারাপ করে ফেলেছে লোকে। বাইসনেরাও এসে চাইবে না তো? তাহলেই সর্বনাশ। না দিলে হয়তো রেগেমেগে শিং দিয়ে গুতানোই শুরু করবে।
কিন্তু গাধার মত হ্যাংলামি করল না বাইসনেরা। রাস্তা থেকে বেশ দুরে রইল। গাড়ি থামিয়ে ভাল করে দেখার জন্যে নামলেন রাবাত, তখনও ফিরে তাকাল না জানোয়ারগুলো। আপনমনে ঘাস খেতে থাকল।
এক সময় এত বাইসন ছিল এখানে, মাঠই দেখা যেত না, কালো হয়ে থাকত, কিশোর বলল। দল বেঁধে রেললাইনের কাছে চলে আসত। দাঁড়িয়ে থাকত লাইনের ওপর। গাড়ি আটকে দিত।
ক্যামেরা তুলে খটাখট শাটার টিপে যাচ্ছে রবিন। যতটা কাছে যাওয়া সভব, যাব। এতদূর থেকে লম্বা ঘাসের মধ্যে বাইসনগুলোকে আর বাইসন। মনে হচ্ছে না, পাথরের চাঙড়ের মত লাগছে।
খবরদার, সাবধান করল মুসা, ওই কাজও কোরো না। সাংঘাতিক বদমেজাজী জানোয়ার।
হ্যাঁ, মুসার কথায় সুর মেলালেন রাবাত, প্রায়ই অ্যাক্সিডেন্টের খবর শোনা যায়। সাহস দেখিয়ে ওগুলোর কাছে চলে যায় লোকে, বোকামির জন্যে মরে। শিঙের গুতোয় ভর্তা হয়। যে ভাবে আছে ওভাবেই থাকতে দাও, বিরক্ত করার দরকার নেই। কোন বুনো জানোয়ারকেই অতটা বিশ্বাস করা উচিত না।
বাইসনের পালকে পেছনে ফেলে এল ওরা। পথের পাশে গাড়ি রাখার জায়গা পাওয়া গেল।
রাবাত বললেন, আমি একটু ঘুরে আসতে চাই। একটা রাস্তা দেখালেন তিনি। পাইন-ছাওয়া পাহাড়ের ঢালের দিকে চলে গেছে। পথের মাথায় কোন রাজপুরী, দেখার ইচ্ছে আছে কারও? এতদূর এসে না দেখে চলে যাওয়াটা বোকামি হয়ে যাবে।
আপত্তি নেই, জবাব দিল রবিন, যদি রাজপুরীতে রাক্ষস না থাকে।
ইগনিশন থেকে চাবি খুলে নিলেন রাবাত। কিশোরের দিকে তাকালেন, তুমি?
আমার হাঁটতে ইচ্ছে করছে না। এখানেই থাকি।
রবিন আর মুসাকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন রাবাত। কয়েক মিনিটেই হারিয়ে গেলেন ঘন বনের মধ্যে।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে কান পাতল কিশোর।
আরেকটা গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ পেয়েছে। এগিয়ে আসছে। সেদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কিশোর। মনে হচ্ছে, যে কোন মুহূর্তে গাছপালার ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসবে একটা ধূসর লিংকন।
কিন্তু লিংকন নয়, এল একটা ক্যাম্পার। হুইলে বসা একজন বুড়ো লোক। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কিশোরের উদ্দেশে হাত নাড়ল।
হাসল কিশোর। অতি-কল্পনা করে ফেলেছিল। কেউ অনুসরণ করছে না ওদের। মিলার পিছু নিয়ে থাকলে সারাক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারত না, এক না একসময় বেরিয়ে আসতেই হত। দেখা দিত। কিন্তু গত কয়েকশো মাইলের মধ্যে মিলারের চেহারাও দেখেনি ওরা। তারপরেও লোকটার কথা কেন যে মন থেকে তাড়াতে পারছে না, কে জানে! আসলে সন্দেহ করার মত আর কেউ নেই বলেই হয়তো এ রকম হচ্ছে।
কিশোরের মাথার ওপরে একটা গাছে পাখি ডেকে উঠল, ডানার শব্দ তুলে বেরিয়ে এল ওটা। বসতে বসতে বিরক্ত হয়ে গেল কিশোর। আর থাকতে ইচ্ছে করছে না। থেকেছে আসলে দেখার জন্যে, ওদের গাড়িটার কাছে কেউ আসে কিনা। সেই কেউটা আর কেউ নয়, মিলার। কিন্তু এখন ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হচ্ছে। প্রয়োজন ছিল না। এই অতি সন্দেহের কোন মানে নেই। মুসার আসতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে। তাড়াতাড়ি গেলে এখনও ওদের ধরা যায়।