কি করে করবে? নম্বর জানো? রবিনের প্রশ্ন।
না। তবে আনলিস্টেড নাম না হলে ডিরেক্টরি এনকয়ারিতে ফোন করলেই বলে দেবে।
বিছানার পাশে টেবিলে রাখা ফোনের দিকে হাত বাড়াল কিশোর। মিনিট খানেকের মধ্যেই জেনে নিল মিলারের নম্বর। ফোন করল।
ও পাশে ফোন বাজতে লাগল।
এত রাতে বিছানা থেকে ডেকে তুলছ, হেসে বলল রবিন, রেগে আগুন হবে।
রকি বীচে এখন রাত এক ঘণ্টা কম। পার্বত্য এলাকায় রয়েছি আমরা, এখানে ওখানকার তুলনায় সময় বেশি।
তিনবার রিঙ হওয়ার পর খুট করে একটা শব্দ হলো, যেন কেউ রিসিভার তুলেছে ওপাশে। কয়েকটা মুহূর্ত সব শূন্য, তারপর আবার খুট। রেকর্ড করা একটা কণ্ঠ বলল, হ্যারিস মিলার বলছি। সরি, এখন ফোনের কাছে আসতে পারছি না। আপনার নাম আর ফোন নম্বর রেখে দিন। পরে যোগাযোগ করব। মেসেজ দেয়ার আগে টোন আসার অপেক্ষা করুন। কথা শেষ হওয়ার পর পরই ভেড়ার ডাকের মত একটা চিৎকার শোনা গেল।
ঝট করে কানের কাছ থেকে রিসিভার সরিয়ে ফেলল কিশোর। উফ, আরেকটু হলেই কান ফাটিয়ে দিয়েছিল। যন্ত্র! অ্যানসারিং মেশিন জবাব দিয়েছে।
তারমানে আছে কি নেই জানা গেল না, মুসা বলল।
সকালে আবার করব। দেখা যাক, তখন কি বলে?
সকাল আটটায় আবার মিলারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল কিশোর। সেই একঘেয়ে জবাব দিল অ্যানসারিং মেশিন। হাল ছেড়ে দিল কিশোর। মিলার বাড়ি আছে কিনা, রোঝা গেল না।
সেদিন ওয়াইয়োমিঙের ভেতর দিয়ে চলল ওরা। পরিষ্কার, সুন্দর দিন, যদিও নীল আকাশের এখানে ওখানে পেঁজা মেঘ ভাসছে। সেই মেঘে বৃষ্টি হবে না। দুধারে ঘাসে ঢাকা মাঠ, তাতে গরু চরছে। দক্ষিণ ডাকোটার র্যাপিড সিটিতে পৌঁছে রাবাত ঘোষণা করলেন, তাদের ছুটি মাটি করতে দেবেন না মিলারকে।
ওই ড্রামটার কথা মাথায়ই আনব না আর, বললেন তিনি। ওর কথা ভেবে দুশ্চিন্তা আর টেনশনের মধ্যে থেকে দেখার আনন্দ মাটি করব না।
এতে অস্বস্তি কমল ছেলেদের। র্যাপিড সিটিতে লাঞ্চ খাওয়ার সময় অনেক হই-হুঁল্লোড় করল। সেখান থেকে দক্ষিণে এগোনোর সময় একটিবারও আর পেছনে ফিরে তাকাল না। তবে কিশোর লক্ষ করল, বার বার রিয়ারভিউ মিররের দিকে চোখ যাচ্ছে রাবাতের।
মাউন্ট রাশমোরে পৌঁছল ওরা। পাহাড়ের ওপরে খানিকটা জায়গা সমতল করে চারপাশের দৃশ্য দেখার জন্যে পর্যবেক্ষণ মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে পাহাড়ী পথ। কয়েক মাইল পেরিয়ে এসে পার্কিং লট দেখা গেল। ওখানে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে এগোল ওরা। চওড়া পথ। সিকি মাইল পর রয়েছে মঞ্চ। সহজেই পৌঁছানো যায়। পঞ্চাশটা রাজ্যের পতাকা উড়ছে ওখানে।
মঞ্চে এসে দাঁড়াল ওরা। পাইনে ছাওয়া ঢাল নেমে গেছে নিচে। গাছের ফাঁকে মাথা তুলে আছে আমেরিকার মহান চার প্রেসিডেন্ট ওয়াশিংটন, জেফারসন, লিংকন, থিয়োডোর রুজভেল্ট। দক্ষিণ ডাকোটার পর্বতের পাথর কেটে তৈরি হয়েছে ওই বিশাল মুখগুলো।
খাইছে! কি জিনিস বানিয়েছে! অবাক হয়ে দেখতে দেখতে বলল মুসা।
সঙ্গে গাইডবুক এনেছে কিশোর। কিন্তু সেটা দেখার প্রয়োজন হলো না। আগেই পড়ে নিয়েছে। বলল, গুটজন বরহ্লামের নির্দেশে তৈরি হয়েছে ওগুলো। একেকটা মুখ ষাট ফুট উঁচু।
হেসে ফেলল মূসা, গুম যখন ছোট ছিলেন, নিশ্চয় তার মা বলেছিলেন–বড় হয়ে বিশাল কোন কাজ করবে বাবা, যা তোমাকে স্মরণীয় করে রাখবে। সেই বিশাল কাজটাই করেছেন তিনি।
বাহ, খুব মজার কথা বলে তো ছেলেটা! পেছন থেকে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।
ফিরে তাকাল মুসা।
রাবাতও তাকালেন।
মোটাসোটা, মাঝবয়েসী এক মহিলা। পরনে আঁটো জিনসের প্যান্ট। রাবাতের দিকে তাকিয়ে হাসল। এরা আপনার নাতি?
একজন।
বাচ্চারা বড় মজার জিনিস! ঝর্নার বহমান পানির মত কলকল করে হাসল মহিলা। সব সময় তাজা। নতুন নতুন কথা খেলে মাথার মধ্যে, কখনও পুরানো হয় না।
এমন ভঙ্গিতে ওদের দিকে তাকালেন রাবাত, যেন তাজা আর নতুনত্ব সত্যি আছে কিনা দেখতে চাইছেন। মুসার চোখ উজ্জল। রবিন লাল হয়ে গেল।
নিজেকে বাচ্চা ভাবতে মোটেও ভাল লাগে না কিশোরের। কঠিন। দৃষ্টিতে তাকাল মহিলার দিকে। বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। গায়ের শার্টে এমব্রয়ডারি করা বড় বড় গোলাপী রঙের ফুল। কানে ম্যাচ করা গোলাপী, রঙের দুল, ঠোঁটে গোলাপী লিপস্টিক। হেসে রাবাতের দিকে দুই কদম এগিয়ে এল।
কখনও সন্তান হয়নি আমার, মহিলার কণ্ঠে খুব হালকা হতাশা আছে। কি নেই। সবাই বলে, ডরোথি, খুব ভাল মা হতে পারতে তুমি। কিন্তু কারও কথায় কান দিইনি। অন্যের বাচ্চাকে আদর করতেই ভাল লাগে আমার।
সরাসরি মহিলার চোখের দিকে তাকালেন রাবাত। তাঁর চোখের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে চোখজোড়া। মহিলার অন্তর ভেদ করে ঢুকে গেল তার দৃষ্টির ছুরি। এক পা পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। টান লাগল হাতে। দেখেন, শার্টের হাতা আঁকড়ে ধরেছে মহিলার আঙুল। বড় বড় নখে গোলাপী রঙের নেলপলিশ।
নানার বিপদ বুঝতে পারল মুসা। ঘড়ি দেখল। খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করল। বলল, নানা, জলদি চলো। ভুলে গেছ, নানীকে বসিয়ে রেখে এসেছ মোটেলে? দেরি দেখলে রেগে কাঁই হবে, আস্ত রাখবে না আর।
চমৎকার একটা মিথ্যে বলেছে মুসা। মনে মনে বাহবা না দিয়ে পারল না। কিশোর। এই মুহূর্তে নানাকে বাঁচানোর এর চেয়ে ভাল কোন বুদ্ধি সে-ও বের করতে পারত না। পলকে উধাও হয়ে গেল মহিলার গোলাপী হাসি। রাবাতের হাত ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেল, যেন বিদ্যুতের শক খেয়েছে। শুকনো গলায় বলল, ও, তাই নাকি, তাই নাকি! যান, তাড়াতাড়ি যান! আপনার সঙ্গে কথা বলে খুব ভাল লাগল!