দূর, বেশি বেশি দুশ্চিন্তা করছ তুমি।
দেখ, আমার বাপকে আমি চিনি! না শব্দটা শুনতে রাজি নয় বাবা। তার হলো বদমেজাজ। যার কাছে যাচ্ছে যদি সে দেখা করেও, বাবার ধারণার সঙ্গে একমত হতে না পারে, তাহলেও যাবে রেগে। তুলকালাম কাণ্ড বাধিয়ে বসতে পারে।
মা, তুমি শুধু শুধু…
মুসার কথায় কান দিলেন না মিসেস আমান। আমি জানি এইই ঘটবে! খেপে গিয়ে অনর্থ ঘটাবে বাবা। ওরা তখন পুলিশ ডাকবে। মনে নেই, সৌরশক্তির সাহায্যে পানি ফুটানোর যন্ত্র আবিষ্কার করে কি গোলমালটাই না পাকিয়েছিল? ঘরের আর্দ্রতা দূর করার যন্ত্র নিয়েও একই অবস্থা। যন্ত্রটা ঠিকমতই কাজ করছিল, ভাঁজ করা ছাতের মত হয়নি। তবে বাবার আগেই নাকি ওই যন্ত্র আবিষ্কার করে বসেছিল আরেকজন। বাবা গেল খেপে। বলে। বেড়াতে লাগল, তার ফর্মুলা চুরি করেছে ওই লোক। ভাবো একবার! সেই লোক থাকে আইওয়ায়। কোথায় রকি বীচ আর কোথায় আইওয়া। এত দূরে বসে কি করে চুরিটা করল? এ সব ফালতু কথা বলার কোন মানে আছে? সেই লোকের কানে গেলে নির্ঘাত কেস ঠুকে বসত, দিত মানহানির মামলা করে।
চুপ হয়ে গেল মুসা।
পরস্পরের দিকে তাকাল কিশোর আর রবিন। বিস্কুট খাওয়া ভুলে গেছে।
মিসেস আমান বললেন, বুঝতে পারছি না, রওনা হয়েই না আরেকটা অঘটন ঘটিয়ে দেয়!
দেবে না, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল মুসা। অর্থাৎ তাকে করতে দেয়া হবে না। তুমি কিছু ভেব না, মা। আমরা পাহারা দিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে প্লেনে তুলে দিয়ে আসব।
প্লেনে গেলে তো! ঠিক করেছে, মোটরগাড়িতে যাবে। নিজে গাড়ি চালিয়ে। মনটানার ভেতর দিয়ে নাকি যায়নি কখনও। ওরিগন আর ওয়াশিংটনও দেখেনি। এবার সব দেখতে চায়। আরও যুক্তি আছে, গাড়ি চালানোর সময় নাকি তার মগজ সবচেয়ে বেশি কাজ করে। তার বিশ্বাস, সাংঘাতিক কোন আবিষ্কারও করে বসতে পারে ওই সময়! এ সুযোগ। কোনোমতেই হারাতে রাজি নয়।
হেসে ফেলল মুসা। মা, এতই যখন দুশ্চিন্তা, নানার সঙ্গে তুমিও চলে যাও না কেন? ঘর নিয়ে ভেব না। আমি আর বাবা মিলে সামলে নিতে পারব।
আমি! মাথা খারাপ! ভাল করেই জানিস, বাবার সঙ্গে দশটা সেকেন্ডও বনে না আমার! গাড়িতেই খুনোখুনি বেধে যাবে! তার চেয়ে এক কাজ কর, তুইই চলে যা। বেড়াতে খারাপ লাগবে না।
চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। মা, সত্যি বলছ!
বলছি। যাওয়ার ব্যবস্থা আমি করব। তবে একটা শর্ত আছে–বাবাকে সব গোলমাল থেকে দূরে রাখতে হবে। পুলিশ তাকে ধরবে না, সে কারও মাথা ফাটাবে না, তুই সব ঠেকাবি।
আমার সাধ্যমত চেষ্টা আমি করব। কিন্তু নানাকে একা সামলানো…
খুব কঠিন, এই তো? আমিও সেটা জানি। সেজন্যেই ভাবছি, আরেক কাজ করা যেতে পারে–তোরা তিনজনেই চলে যা। ঘোষণা করলেন তিনি, তিন গোয়েন্দাকে ভাড়া করতে রাজি আছি। প্রয়োজনে খরচাপাতিও দেব। আমার বাবাকে পাহারা দিয়ে নিরাপদে নিউ ইয়র্ক পৌঁছে দিতে হবে। সেখানেও তার নিরাপত্তার দিকে লক্ষ রাখতে হবে।
হাসল কিশোর। চকলেট মেশানো বড় একটা বিস্কুটের আধখানা কামড়ে কেটে নিয়ে বলল, কিন্তু, আন্টি, আমরা গোয়েন্দা, বডিগার্ড নই।
তা ঠিক, গোয়েন্দা আর বডিগার্ড এক নয়, মেনে নিলেন মিসেস আমান। কিন্তু গোয়েন্দারা আর কোন কাজ করতে পারবে না, এমনও কোন বিধিনিষেধ নেই। বডিগার্ডই ভাবছ কেন? বেড়াতে যাচ্ছ, সেই সময়ে একজন লোকের কিছুটা খেয়াল রাখছ, এই তো। বিনিময়ে বেড়ানোর খরচটা পাবে।
বডিগার্ডের চেয়ে খারাপ, ফোড়ন কাটল মুসা, মানুষের কেয়ারটেকার। তবে গাড়িতে করে নিউ ইয়র্ক যাওয়া সত্যি লোভনীয়। এ দিক বিবেচনা করে যে কোন কাজ করতে রাজি আছি আমি। কিশোরের দিকে তাকাল সে। কি বলো?
কিশোর তাকাল রবিনের দিকে। নথি-গবেষকের মতামত চায়।
আমি রাজি, বলে দিল রবিন। মুসার নানা আমাদেরও নানা। তাঁর কেয়ারটেকার হতে আপত্তি নেই আমার।
কিন্তু নানাটা কি জিনিস ভাবতে হবে! চিন্তায় পড়ে গেছে মুসা। বেরিয়ে না শেষে পস্তাতে হয়!
কেন? ভুরু নাচাল কিশোর।
নানার কেয়ারটেকার হওয়ার চেয়ে খেপা গণ্ডারের কেয়ারটেকার হওয়া অনেক সহজ। সব কিছুতে সন্দেহ। মেজাজের ঠিকঠিকানা নেই। এই ভাল তো এই খারাপ। প্রতি মুহূর্তে কত আর সামলানো যায়!
তা বটে, একমত হলেন মা। বাবার ধারণা, তার মত সৃষ্টিশীল মানুষদের পেছনে সব সময় লোক লেগে থাকে–বলে, পাগল, মাথায় ছিট। আড়চোখে তাকায়, ব্যঙ্গ করে, উল্টোপাল্টা কথা বলে। রেগে গিয়ে তাদের। সঙ্গে ঝগড়া বাধালে দোষ দেয়া যায় না। আরেক ধরনের লোক আছে, তারাও পিছে লাগে, তারা আবিষ্কারের ফর্মুলা ছিনিয়ে নিতে চায়। সেজন্যেই এত সন্দেহ…
টেলিফোন বাজল।
সেদিকে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করলেন মিসেস আমান। কে আবার করল?
উঠে দাঁড়াল মুসা। তুমি বসো। আমি ধরছি।
রিসিভার কানে ঠেকিয়ে হালো বলল সে। নীরবে শুনতে লাগল। ওপাশের কথা। তারপর বলল, মাকে বলছি!
রিসিভার রেখে ঘুরে দাঁড়াল সে। মা, মিস্টার পেইত্রি। নানার বাড়ির। উল্টোদিকে যার বাড়ি। আজ নাকি নানার সঙ্গে তার দাবা খেলার কথা ছিল। গিয়ে দেখেন নানা নেই। সারা বাড়ি খুঁজেছেন, কোথাও পাননি। পেছনের দরজা খোলা। রান্নাঘরে সিঙ্কের কল খোলা, পানি পড়ছে। এখুনি পুলিশকে খবর দিতে বললেন।