টাবের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে জানালার হুড়কো পরীক্ষা করল সে। এক জায়গার রঙ চটে গেছে সামান্য।
হুড়কো সরিয়ে কেউ জানালা খুলে ঢুকেছিল, পেছনে দরজায় এসে দাঁড়ানো রাবাতকে বলল কিশোর। বেরিয়েছেও হয়তো একই পথে। দরজা। দিয়েও বেরোতে পারে। আগুনের দিকে খেয়াল ছিল সবার, তাকে কেউ দেখেনি নিশ্চয়।
পাশের ঘর থেকে দৌড়ে এল রবিন। জানো কি কাণ্ড হয়েছে?
মুসা বলল, জানি, আমাদের ঘরেও ঢুকেছিল, সব তোলপাড় করে ফেলেছে।
মাথা ঝাঁকাল রবিন, হ্যাঁ। কিন্তু যতটা দেখলাম, কিছু খোয়া গেছে বলে মনে হলো না।
মিলার! মিলার! ওই ব্যাটা ছাড়া কেউ না! চেঁচিয়ে উঠলেন রাবাত। এখানেও এসেছে!
কি করে, নানা? প্রশ্ন তুলল মুসা। পিছুটা নিল কি করে? কাল রাস্তার ধারে যেটা দেখেছি সেটা কার গাড়ি জানি না। যদি মিলারেরও হয়, কালকের পর আর দেখা যায়নি ওটাকে। পিছে পিছে এলে আমরা যে এখানে আছি জানবেই বা কি করে?
পিছে আসাটা তেমন কঠিন না, রাবাত বললেন। লিংকনটা ভাড়া করা গাড়ি, ওর নিজের না। যেহেতু আমাদের চেনা হয়ে গেছে, ফেরত দিয়ে অন্য আরেকটা নিয়ে নিতে পারে। আমাদের একেবারে লেজে লেগে থাকলেও তখন আর চিনতে পারব না।
কিশোরের মনে পড়ল, লংভিউতে মোটেলে রাতে একটা বড় গাড়ি চলে যেতে দেখেছিল। কিন্তু বলল না রাবাতকে, চেপে গেল। শুনলেই খেপে যাবেন।
ঘরের ছড়ানো জিনিসপত্রের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, নানা, তোমার আবিষ্কারটা খোয়া গেছে কিনা দেখছ না?
জবাব দিলেন না রাবাত। দেখার প্রয়োজন বোধ করলেন না। যেন তিনি। জানেন, খোয়া যায়নি। লম্বা লম্বা পা ফেলে আবার চত্বরে বেরিয়ে এলেন। অনুসরণ করল ছেলেরা।
কিছু বোর্ডার তখনও আছে ওখানে। খেপে যাওয়া ম্যানেজারের লম্ফ ঝম্প দেখছে। আগুন লাগিয়েছে যে, তাকে হাতে পেলে এখন কি কি করত, গলাবাজি করে বলছে। নিষ্ফল আক্রোশ। রাস্তায় অপেক্ষা করছে দমকলের গাড়ি। ইঞ্জিন চলছে। ড্রাইভওয়েতে ঢুকেছে একটা পুলিশের গাড়ি। ছাতের বাতিটা ঘুরছে। ঝিলিক ঝিলিক করে কমলা আলো ছিটিয়ে দিচ্ছে যেন বাড়িটার সামনের দেয়ালে।
স্টোররুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একজন পুলিশ অফিসার। কথা বলছে। ফায়ারম্যানের সঙ্গে।
গটমট করে সেদিকে এগিয়ে গেলেন রাবাত। বললেন, কি করে লাগল সেটা নিয়ে অত মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আগুনটা লাগানো হয়েছে, ইচ্ছে করে।
ফিরে তাকাল অফিসার আর ফায়ারম্যান। চোখে কৌতূহল। ফায়ারম্যান জিজ্ঞেস করল, আপনি কি করে জানলেন?
জানি!
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। কিশোর, শুরু হলো আবার!
হ্যারিস মিলার লাগিয়েছে ওই আগুন, বলতে কোন রকম দ্বিধা করলেন না রাবাত। লাগিয়েছে যাতে আমার ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র ঘাটতে পারে। আমার আর ওদের, তিন গোয়েন্দাকে দেখালেন তিনি, ঘর দুটোকে তছনছ করে ফেলেছে। আগুন লাগালে যে সারা বাড়িতে লেগে যেতে পারে, এতগুলো লোক বিপদে পড়বে, ভাবলও না একবার; নিজের উদ্দেশ্য সাধনটাই তার কাছে বড়। ভীষণ স্বার্থপর। পুরো বাড়িটা পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারত!
রাবাতের দিকে তাকিয়ে হাসল ম্যানেজার। সব দাঁত বেরিয়ে পড়ল। এই প্রথম একজনকে পেল, তার পক্ষে বলছেন। চেঁচিয়ে বলল, সেই তখন থেকেই বলছি, তেল লাগানো ন্যাকড়া আমি ফেলতে দিই না! কাজের লোকদের কড়া হুকুম দেয়া আছে। অসাবধানতার জন্যে লেগেছে এ কথা কিছুতেই বলতে পারবেন না। বাইরে থেকে কেউ এসে যদি লাগিয়ে দেয়, আমি কি করতে পারি বলুন?
স্টোর রুমে ঢুকল অফিসার। পেছনের দেয়ালে একটা জানালা। রাবাতের বাথরুমের জানালার মতই এটাও বাইরে থেকে খোলা হয়েছে, তবে খুলতে গিয়ে এটার হুড়কোটা ভেঙে ফেলেছে।
এটা এ ভাবে ভাঙা আছে কদ্দিন? জানতে চাইল অফিসার।
ভাঙা থাকবে কেন? জোর প্রতিবাদ জানাল ম্যানেজার, ভাঙা জিনিস আমি থাকতে দিই না! এটা ভাল ছিল। আজ রাতে খোলা হয়েছে। হুড়কো ভেঙেছে জানলে সঙ্গে সঙ্গে মেরামত করিয়ে ফেলি। একটুও দেরি করি না।
রাবাতের দিকে তাকাল অফিসার, আপনার ঘরটা দেখব।
সানন্দে দেখাতে রাজি হলেন তিনি। নিয়ে এলেন অফিসারকে। তার ঘরটা দেখার পর গোয়েন্দাদেরটাও দেখল সে।
নোটবুকে লিখে নিল অফিসার। গাড়ি থেকে নেমে এসে দরজায় নক করল তার সহকারী। দুজনে মিলে তখন বোর্ডারদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে লাগল। তদন্ত শেষ করার পর জানা গেল, কেবল রাবাত আর গোয়েন্দাদের ঘরেই ঢুকেছিল চোর।
হোটেলের লোকও হতে পারে, অবশেষে অফিসার বলল। কিন্তু এ ভাবে ঢুকে কোন কিছু না নিয়ে চলে গেল কেন…
অফিসারের কথা শুনে রেগে গেলেন রাবাত। খসখসে গলায় বললেন, কারণ হোটেলের লোক নয় ও! আমি বলছি, হ্যারিস মিলার! রকি বীচ থেকে আমাদের অনুসরণ করে এসেছে ও!
রকি বীচ?
কেন, চেনেন না? নাম শোনেননি? ক্যালিফোর্নিয়াতেই তো। শুনুন, পিজমো বীচে ওর সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে আমাদের, তারপর মনটিরেতে। আমি এখন শিওর, মোটর সাইকেলওয়ালা গুণ্ডাবাহিনীকেও সে-ই আমাদের পেছনে লাগিয়েছিল। ওকে গিয়ে গ্রেপ্তার করুন। ভয়ানক লোক ও!
তাই নাকি! কিন্তু সে আপনাদের ফলো করবে কেন? আপনাদের ঘর তল্লাশি করবে কেন? কি খুঁজেছে?
আমার আবিষ্কার।
তাই! সেটা কি?
সতর্ক হয়ে গেলেন রাবাত। চোখের তারায় ধূর্ত একটা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। সে-কথা তো আপনাকে বলা যাবে না। কাউকেই বলা যাবে না এখন।