কি যেন পড়ার শব্দ হলো। তারপর ঝনঝন করে কাচ ভাঙল। গাড়ির কাচ। চত্বরের পার্কিং লটে ইনডিয়ানার নম্বরপ্লেট ওয়ালা একটা গাড়ি তাড়াহুড়ো করে পিছাতে গিয়ে ওরিগনের প্লেট লাগানো একটা গাড়িকে গুতো মেরে দিয়েছে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে চেঁচিয়ে উঠল ওরিগনের ড্রাইভার, এই গাধা, দেখও না নাকি!
জবাব দিল না ইনডিয়ানা। গাড়ি সরাতে ব্যস্ত।
ঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে বোর্ডাররা। কাশছে, চোখ ডলছে। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্যে বিছানার কম্বল তুলেই গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে অনেকে। কেউ কেউ গাড়ির দিকে ছুটছে, গাড়িতে করে নিরাপদ জায়গায়। পালাতে চায়। অন্যেরা চত্বরে জড়ো হলো কি ঘটে দেখার জন্যে।
দমকলকে খবর দেয়া হয়েছে? জানতে চাইল এক মহিলা।
দিয়েছি, জবাব দিল কিশোর, আসছে।
কিশোর, দেখো, হাত তুলল মুসা।
বাড়িটার শেষ মাথার একটা দরজায় লেখা রয়েছে: EMPLOYEES (ONLY. ধোয়া আসছে ওই দরজার ফাঁক দিয়ে।
ওই ঘরেই লেগেছে, বলে উঠল কিশোর। সরুন, সরুন সবাই; আগুনের কাছ থেকে সরে যান।
দরজাটার কাছ থেকে সবাইকে সরিয়ে দিতে লাগল মুসা আর রবিন।
দমকলের সাইরেন শোনা গেল। দেখতে দেখতে সেটা বেড়ে গেল, তার সঙ্গে যুক্ত হলো ভারী ইঞ্জিনের শব্দ। এসে গেছে দমকল।
কোথায় লাগল? পুরানো বাথরোব পরা টাকমাথা ছোটখাট একজন লোক জিজ্ঞেস করল। পরিচয় দিল, আমি মোটেলের ম্যানেজার। একহাতে চাবির গোছা, আরেক হাতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র।
ওই যে দেখুন দরজাটা, হাত তুলে দেখিয়ে দিল কিশোর।
দ্রুত এগিয়ে গেল ম্যানেজার। খুলে ফেলল তালা। পাল্লা খোলার জন্যে নব চেপে ধরতেই বাধা দিল কিশোর, দাঁড়ান! খুলবেন না!
কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। টান দিয়ে ফেলেছে ততক্ষণে ম্যানেজার। হাঁ হয়ে খুলে গেল পাল্লা। ভেতর থেকে ঝাঁপিয়ে এল যেন আগুনের চাদর, ঝটকা দিয়ে পিছিয়ে গেল ম্যানেজার, হাত থেকে খসে পড়ল ফায়ার এক্সটিংগুইশার। দুহাত উঠে গেল মুখ ঢাকার জন্যে। প্রচণ্ড গরম বাতাসের ঢেউ এসে লাগল। গোয়েন্দাদের ওপরও।
লোকটাকে সাহায্য করতে ছুটল মুসা। এক্সটিংগুইশার তুলে নিল রবিন। আগুনের দিকে তাক করে টিপে দিল ট্রিগার। তরল রাসায়নিক ফেনা ফিনকি দিয়ে বেরোল, পড়তে লাগল আগুনের মধ্যে।
দমকলের দুটো গাড়ি এসে দাঁড়াল মোটেলের সামনে। হুড়াহুড়ি করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল ফায়ারম্যানেরা, মুহর্তে রবিনকে সরিয়ে দিল একপাশে। একজন একটা হোস তাক করে ধরল, তীব্র বেগে পানি গিয়ে পড়তে শুরু করল ঘরের মধ্যে। নিভে গেল আগুন। যেমন স্বয়ংক্রিয় ভাবে চালু হয়েছিল স্মোক অ্যালার্ম, আগুন নিভে যেতে ওটাও বন্ধ হয়ে গেল আপনাআপনি। ছোট ঘরটা একটা স্টোররুম। তেমন কিছু ছিল না। কয়েকটা পোড়া ন্যাকড়া, ঝাড়, একটা প্লাস্টিকের বালতি–পুড়ে গলে বিকৃত হয়ে। গেছে, আর একগাদা কঙ্কল পুড়ে ছাইয়ের স্তূপ হয়ে আছে।
ঘরে ঢুকল একজন ফায়ারম্যান। ভেজা ছাইয়ের স্তূপের দিকে তাকিয়ে রইল একটা সেকেন্ড, তারপর লাথি মেরে ছড়িয়ে দিল। পোড়া কম্বলের একটা টুকরো তুলে নিয়ে শুকল। আনমনেই বলল, তেল তেল গন্ধ। তারপিন হবে। রঙ করা হচ্ছিল নাকি এখানে? ম্যানেজারের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল সে।
আগুনের আঁচ লেগে ম্যানেজারের একটা ভুরু পুড়ে গেছে। সেখানে হাত বোলাতে বোলাতে জবাব দিল, না, রঙ করবে কে! কয়েক মাস ধরে রঙের। কাজ হয়নি মোটেলে।
নাক কুঁচকে আবার শুকল ফায়ারম্যান। কাঠের জিনিস বার্নিশ করা হয়েছে?
না! প্রার্থনা করার ভঙ্গিতে এক হাতের সমস্ত আঙুল আরেক হাতে গুঁজে দিল ম্যানেজার। আর করলেও এ ভাবে তারপিন ভেজানো ন্যাকড়া এখানে ফেলতে দিতাম না।
কি জানি! অনিশ্চিত শোনাল ফায়ারম্যানের কণ্ঠ। ফেলে দিল পোড়া টুকরোটা।
কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে শুনছেন রাবাত। নাক দিয়ে খেত-খোত করে বললেন, ফারগ্লো ব্যবহার করলেই আর এ সমস্যা হত না।
ফারগ্লোটা আবার কি জিনিস? জানতে চাইল রবিন।
নানার একটা আবিষ্কার, মুসা বলল। ফেলে দেয়া কাগজের প্যাড দিয়ে তৈরি। কাঠের জিনিস বার্নিশ করতে এর তুলনা হয় না। তারপর যেখানে ইচ্ছে ছুঁড়ে ফেলো, আগুন লাগার ভয় নেই। আগুন ধরে না ওতে।
আইডিয়াটা একটা সোপ কোম্পানির কাছে বিক্রি করেছিলাম আমি, তিক্তকণ্ঠে বললেন রাবাত। ওরা কাজে লাগায়নি, আলমারিতে ভরে রেখে দিয়েছে। সেই রাগেই যেন দুপদাপ পা ফেলে ঘরে ফিরে এলেন। ঢুকেই এমন চিৎকার দিয়ে উঠলেন যেন বোলতায় হুল ফুটিয়েছে।
চোর! বদমাশ! চেঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন তিনি, কিশোর! রবিন! মুসা! দেখে যা! চোরটার কাণ্ড দেখে যা!
ছুটে এল তিন গোয়েন্দা।
জলদি গিয়ে নিজেদের ঘর দেখো! কিছু নিয়েছে কিনা! দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের বিছানার দিকে তাকিয়ে আছেন রাবাত। ম্যাট্রেস উল্টে ফেলা হয়েছে। চাদর আর কম্বলগুলো মেঝেতে। ছড়িয়ে ফেলা হয়েছে তার কাপড়-চোপড়। মোজা আর আন্ডারওয়্যারগুলোও বাদ পড়েনি। শেভ করার আর দাঁত মাজার। সরঞ্জাম ছিল যে বাক্সটায়, সেটাও উল্টে ভেতরের জিনিস ঝেড়ে ফেলা হয়েছে।
হা হয়ে গেছে কিশোর। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নড়তে পারল না। তারপর রাবাতের পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে বাথরুমে চলে গেল। পেছনের দেয়ালে বাথটাবের বেশ ওপরে একটা জানালা। সেটা খোলা। বাথটাবে জুতোর ছাপ দেখে বোঝা গেল জানালা দিয়ে এটাতে কেউ নেমেছিল।