সমস্যা আর বিপদ থেকে পালানোর স্বভাব তিন গোয়েন্দারও নয়, বরং মুখোমুখি হতেই ওরা ভালবাসে। কিন্তু এই কেসটাতে এখন পর্যন্ত কেবল পালিয়েই চলেছে ওরা। মিলার যদি পেছনে লেগে থাকে, সামনাসামনি এসে কিছু না করা পর্যন্ত ওদের কিছু করার নেই। আক্রমণটা আগে তার তরফ থেকেই আসতে হবে। মিলার পেছনে লেগেছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি এখনও। কেবল সন্দেহের ওপর নির্ভর করে একজন। ভদ্রলোকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করাটা ঠিক নয়।
মাঝরাতের পর হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেল কিশোরের। কানে এল পাশের ঘরে রাবুনোর বিকট নাক ডাকানোর শব্দ। তবে এই শব্দ আর এখন বিরক্ত করে না ওকে, গা সওয়া হয়ে গেছে, এর জন্যে ঘুম ভাঙেনি ওর। ভেঙেছে জানালায় হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো পড়ায়। মোটেলের ড্রাইভওয়েতে ঢুকে চলতে চলতে যেন থেমে গেল একটা গাড়ি।
দরজা খোলার শব্দ হলো। ইঞ্জিন বন্ধ করল না ড্রাইভার। দ্রুত পদশব্দ থমকে গেল আচমকা, তারপর আবার শোনা গেল।
বিছানা থেকে নামল, কিশোর।
সে জানালার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল, বড় একটা গাড়ি ঘুরে নেমে যাচ্ছে রাস্তায়।
লিংকনটাই? নিশ্চিত হতে পারল না।
বিছানায় ফিরে এল আবার সে বুঝতে পারছে, রাবুমানার মত সে-ও মিলারকে সন্দেহ করতে আরম্ভ করেছে। অথচ এখন পর্যন্ত মিলার কোন ক্ষতি করেনি ওদের। বুইকটার ক্ষতি করেনি। রাতের বেলা চুপি চুপি ঘরে ঢুকে খোঁজাখুজি করেনি। পিছু পিছু আসার ব্যাখ্যা সহজেই দেয়া যায় হয়তো সে ও বেড়াতে বেরিয়ে একই দিকে চলেছে।
আচ্ছা, কি জিনিস আবিষ্কার করেছেন রাবুমানা? কি নিয়ে চলেছেন নিউ ইয়র্কে? কোথায় রেখেছেন ওটা? ছোট জিনিসই হবে, যা সুটকেসে ভরে রাখা যায়। বড় কিছু লুকানোর জায়গা নেই, গাড়িটাতেও না, তাহলে ওদের চোখে পড়তই। আর গাড়িতে রাখার জায়গাই বা কোথায়?
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল সে। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখল তার অনেক আগে উঠে পড়েছে মুসা আর রবিন। কাপড় পরে তৈরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি করতে হবে ওকে।
ওয়াশিংটনের ভেতর দিয়ে সেদিন পুবে এগোল ওরা। ওপরে উঠছে পথ। কাসকেড মাউনটেইন রেঞ্জ পার হয়ে এসে পড়ল খোলা অঞ্চলে। দুই পাশে রুক্ষ ছড়ানো প্রান্তর।
হায় হায়, এ যে মরুভূমি! নিরাশা ঢাকতে পারল না মুসা। আমি তো। ভেবেছিলাম পুরো ওয়াশিংটনটাই শুধু পাইনের জঙ্গল।
বোকার মত ভাবলে তো কত কিছুই ভাবা যায়, নানা বললেন।
স্পোক্যানি পার হয়ে আবার পার্বত্য অঞ্চলে ঢুকল ওরা। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্না রাস্তার পাশ দিয়ে বইছে, থেকে থেকেই দুপাশ থেকে চেপে আসছে জঙ্গল।
ইডাহোর কয়েউর ডিঅ্যালিনিতে রাত কাটানোর জন্যে থামল ওরা। লংভিউতে শহরের অনেক ভেতরে অখ্যাত ছোট মোটেলটার মতই কোন মোটেলে ওঠার ইচ্ছে। অবশ্যই মিলারের ভয়ে। যাতে সে খুঁজে বের করতে না পারে।
সারাদিনে অবশ্য ছায়াও দেখিনি, বললেন তিনি। রিয়ারভিউ মিররে। পলকের জন্যেও দেখিনি গাড়িটাকে। তবু ঝুঁকি নেব না। লুকিয়েই থাকব। আমাদের খুঁজে না পেলে সে ভাববে হয় আমরা স্পোক্যানিতে রয়েছি, নয়তো আরও এগিয়ে মিসৌলাতে চলে গেছি।
যদি আমাদের পিছু নিয়ে থাকে, তবেই, মিলারের কথা শুনতে আর ভাল লাগছে না মুসার। মনেপ্রাণে চাইছে লোকটাকে নিয়ে আলোচনা বন্ধ হোক।
খাওয়ার টেবিলে পড়শীর কথা আর তুললেন না রাবাত। খাওয়ার পর গলফ খেলতে বেরোলেন। সামান্য সময় খেললেন। তখনও কিছু বললেন না। সবচেয়ে বেশি স্কোর করলেন তিনি। ছেলেদের নিয়ে মোটেলে ফিরে এলেন। বেশ হাসিখুশি লাগছে তাকে।
রাতের বেলা ওদের গভীর ঘুম ভাঙিয়ে দিল সাইরেনের তীক্ষ্ণ চিৎকার। সারা বাড়িতে আলোড়ন তুলে বেজেই চলল, বেজেই চলল।
খাইছে! বিছানায় উঠে বসে মুসা বলল, ঘটনাটা কি?
থামছে না সাইরেন। কানের পর্দা ছিদ্র করে দিয়ে যেন ঢুকে যাচ্ছে মগজে।
হঠাৎ জবাবটা পেয়ে গেল সে। চিৎকার করে উঠল, কিশোর, রবিন, জলদি ওঠো! লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে নিচে নামল। স্মোক অ্যালার্ম! আগুন লেগেছে মোটেলে!
.
০৯.
রাতের নীরবতা চিরে দিয়ে যেন বেজে চলেছে ধোয়ার সঙ্কেত।
লোকের ছুটাছুটি আর হট্টগোল কানে এল গোয়েন্দাদের। দড়াম দড়াম করে বন্ধ হলো গাড়ির দরজা। ধোয়ায় ভারী হয়ে গেছে বাতাস।
দমকলকে ফোন করল কিশোর।
পাজামা পরেই ছুটে বেরোল মুসা। নানার দরজায় থাবা দিয়ে চিৎকার করে বলল, নানা! নানা! ওঠো জলদি! মোটেলে আগুন লেগেছে!
কাশতে কাশতে টলোমলো পায়ে এসে দরজা খুলে দিলেন রাবাত।
সাইরেন বাজছে।
ইতিমধ্যে প্যান্ট পরে ফেলেছে রবিন। বেরিয়ে গিয়ে মোটেলের গেস্টদের দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডেকে তুলতে শুরু করল তাদের।
লাল গাউন পরা এক মহিলা দরজা খুলল। চোখ জ্বালা করছে। ডলতে ডলতে জানতে চাইল, কি হয়েছে?
মোটেলে আগুন লেগেছে, জানাল রবিন।
যেন আঁকুনি খেয়ে জেগে গেল মহিলা। ভেতরে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, পিটার, জলদি ওঠো! তখনই বলেছিলাম এই খোয়াড়ের মধ্যে থাকার দরকার
রাবাত আর অন্য দুই গোয়েন্দাও কাপড় পরে ফেলেছে। একপাশ থেকে দরজা ধাক্কাতে শুরু করল সবাই, বোর্ডারদের জাগিয়ে দিতে লাগল। ওদের চারপাশে ধোয়া উড়ছে। বাড়িটা U প্যাটার্নে তৈরি। মনে হচ্ছে U-র একটা মাথা থেকে আসছে।