ওদের দিকে কিছু একটা ছুঁড়ে দিয়েছিলে তুমি। পিস্তল ফোঁটার মত শব্দ হয়েছিল। কিসের শব্দ? বাজি?
না না, বাজি হবে কেন! বাজি পোড়ানো অনেক শহরে নিষেধ। আমার খুদে আবিষ্কারগুলোর একটা ব্যবহার করেছি। বাজারে ছাড়লে খুব জনপ্রিয়তা। পাবে। চলবে ভাল। অতি সাধারণ একটা জিনিস, অথচ ভয়াবহ শব্দ করে, ধোয়া ছড়ায়, কিন্তু শরীরের ক্ষতি করে না; সুতরাং বেআইনী বলতে পারবে না পুলিশ। বরং অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে নিরীহ মানুষকে। দেখলেই তো, কি করে ভয় ঢুকিয়ে দিলাম শয়তানগুলোর মনে।
হাসল মুসা। দেখলাম। কিন্তু বাজারে ছাড়লেই তো অপরাধীদের জানা হয়ে যাবে ওটা কি জিনিস, আর ভয় পাবে না। তখন কি হবে?
তখন আমি ওগুলো ডাকপিয়নদের কাছে বিক্রি করব, হাসিমুখে জবাব দিলেন রাবাত। কল্পনা করতে পারবি না চিঠি বিলি করতে গিয়ে কি বিপদে পড়ে ওরা। জঘন্য সব কুত্তা পালে আজকাল লোকে।
আবার মেন্যুতে মন দিলেন তিনি।
পরদিন দুপুর একটা নাগাদ অরিগনের পোর্টল্যান্ড পেরোল ওরা। রাস্তার পাশে সাইনবোর্ড দেখে মুসা বলল, নানা, এখানে থামবে? সেইন্ট হেলেনস পর্বতমালা দেখার ইচ্ছে আমার বহুদিনের।
থামব তো বটেই, রাবাত বললেন। একসঙ্গে অতগুলো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি দেখার ভাগ্য কজনের হয়? সুযোগ যখন পাওয়া গেছে সেটা অবশ্যই কাজে লাগানো উচিত।
হাইওয়ে থেকে সরে এলেন তিনি। মোচড় খেয়ে খেয়ে উঠে যাওয়া পাহাড়ী পথ ধরে উঠতে আরম্ভ করলেন। আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে আসতে লাগল দিনের আলো। ঝপাঝপ করে যেন গাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। মেঘের ভেলা। আকাশময় এখানে উড়ে বেড়াচ্ছে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ।
শেষ মাথায় উঠে এল ওরা। ভেবেছিল এখানে উঠলেই চোখে পড়বে। মাউন্ট সেইন্ট হেলেনস। মেঘের ওপরে উঠে এসেছে, অনেক নিচে ভাসছে মেঘের ভেলাগুলো। পুবে তাকাল। পর্বতমালাটা ওদিকেই থাকার কথা। কিন্তু প্রচণ্ড বিস্ময় অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে। পর্বত চোখে পড়ল না। কেবল ঘন ধূসর ধোয়া ভলকে ভলকে ওপরে উঠছে, ছেয়ে দিয়েছে আকাশ।
খাইছে! কোনমতে বলল মুসা।
হেসে তার নিরাশা দূর করার চেষ্টা করলেন রাবাত, অত মন খারাপ করছিস কেন? পুরো দেশটাই আমাদের সামনে পড়ে আছে। ভাল ভাল দৃশ্য প্রচুর দেখতে পাবি।
গাড়ি ঘুরিয়ে আবার নামতে লাগলেন তিনি। কিছুদূর নামার পর হঠাৎ নামল ঝমঝম করে বৃষ্টি। ভিজিয়ে দিল গাড়ির কাচ। অস্পষ্ট হয়ে গেল সামনের আর আশপাশের সব কিছু।
হাইওয়ে ফাইভ-এ পৌঁছে দেখা গেল অনেক গাড়ি হেডলাইট জ্বেলে দিয়ে চলছে। বৃষ্টিতে অন্ধকার হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলেন রাবাত, সেদিন এর বেশি আর এগোবেন না, ওয়াশিংটনের লঙভিউতে রাত কাটাবেন। নিজের পরিকল্পনা নিয়ে এতই মগ্ন রইলেন, রাস্তার ধারে থেমে থাকা লিংকন গাড়িটাকে শুরুতে খেয়াল করলেন না। আলো জ্বালেনি ওটা। ওয়াইপার চলছে। এগজস্ট থেকে একঝলক সাদা ধোয়া বেরিয়ে মিশে গেল ভেজা বাতাসে।
গাড়িটা চোখে পড়তেই শক্ত হয়ে গেল কিশোর।
লিংকনের ড্রাইভিং হুইলে ঝুঁকে রয়েছে একজন লোক। কে? হ্যারিস মিলার? সান্তা মনিকায় এ রকম একটা গাড়ি দেখেছিল, ওটাই কিনা নিশ্চিত হতে পারল না। এ পথে ধূসর লিংকনের অভাব নেই। তার মধ্যে কোনটা মিলারের কে বলবে? নম্বর প্লেট একবার দেখেই মুখস্থ করে ফেলল নম্বরটা : 111-XTJ.
মিলার! আচমকা সবাইকে চমকে দিয়ে হিসহিস করে উঠলেন রাবাত। চোখে পড়ে গেছে লিংকনটা। ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলেন। বেজে উঠল একঝাক। হর্ন। তীব্র প্রতিবাদ জানাতে লাগল পেছনের গাড়িগুলো।
জলদি চালাও, নানা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
রাস্তার মাঝখানে এ ভাবে ব্রেক কষা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। ঠিক পেছনের গাড়িটা এসে বাম্পারে গুতো মারার আগেই আবার এক্সিলারেটরে পায়ের চাপ বাড়ালেন রাবাত। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল বুইক। অল্পের জন্যে গুতো খাওয়া থেকে বেচে গেল। দুর্ঘটনাটা ঘটল না। গায়ে কাপুনি উঠে গেছে ছেলেদের। কিন্তু রাবাতের কোন ভাবান্তর নেই, তিনি স্বাভাবিক রয়েছেন।
ভয় পেয়েছ! সরি! বললেন তিনি। গাড়িটা দেখে আর সামলাতে পারলাম নাঃ শিওর ওটাতে মিলার বসে আছে।
ফিরে তাকাল ছেলেরা। রাস্তার পাশে তেমনি দাঁড়িয়ে আছে লিংকন, বৃষ্টিভেজা ধূসরতার মাঝখানে ধূসর একটা অবয়বের মত।
থাকুক না, আমাদের কি? কিশোর বলল, অনুসরণ তো আর করছে না। রাস্তার ধারে পার্ক করে হয়তো রোড ম্যাপ দেখছে…গাড়ি খারাপ হয়েও থাকতে পারে।
আমাদের অনুসরণ করার জন্যে পিছে পিছে আসার দরকার পড়বে না তার। এই রাস্তা ধরে কতদূর যেতে পারব আমরা, জানে। সীটলের বেশি যে যেতে পারব না, তা-ও জানে। এ ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে হয়তো আমাদের সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করছে, বোঝাতে চাইছে পেছনে আসছে না।
আর কোন কথা হলো না। উত্তরমুখো গাড়ির ভিড়ে মিশে রাবাতও এগিয়ে চললেন। লংভিউতে পৌঁছে শহরের গভীরে ঢুকে গেলেন। হাইওয়ে থেকে দরে একটা মোটেলের ড্রাইভওয়েতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলেন। এখানে উঠলে তাদের খুঁজে বের করতে কষ্ট হবে মিলারের। অবশ্য যদি সে আদৌ বের করতে চায়।
ব্যাপারটা আমার পছন্দ হচ্ছে না, রাবাত বললেন। জীবনে কখনও কোন লড়াই থেকে পালিয়ে আসিনি। এখন যে এড়িয়ে থাকতে চাইছি, সেটাও সামান্য সময়ের জন্যে। শিক্ষা ওকে আমি একটা দিয়েই ছাড়ব, তবে সেটা পরে। আপাতত নিরাপদে নিউ ইয়র্কে পৌঁছতে চাই; আর চলার পথে যতটা সম্ভব আনন্দ। এখনই ঝগড়া বাধিয়ে সব পণ্ড করতে চাই না।