আসলেই ভাল নয় ওরা। বেশির ভাগেরই দাড়ি আছে। কারো ঘন চাপদাড়ি বিচিত্র ছাঁটে কাটা হয়েছে, কারও বা পাতলা ফিনফিনে, লম্বা লম্বা দাড়ি। সেগুলো এমনিতেই বিচিত্র, কাটার আর প্রয়োজন পড়েনি। কোমরে চওড়া চামড়ার বেল্ট, কব্জিতে রিস্টব্যান্ড, হাতে গ্লাভস–সব কিছুতেই ছোট বড় নানা আকারের লোহার কাটা বসানো। হলিউডের ছবিতে দেখানো। ভয়ঙ্কর মোটর সাইকেল গ্যাঙের এ যেন বাস্তব রূপ।
হাই, কালু নানা! কাছে এসে চিৎকার করে উঠল এক আরোহী। মোটর সাইকেলের সামনের চাকা রাবাতের গায়ে তুলে দেয়ার ভঙ্গি করে সরে গেল। হি-হি করে গা জ্বালানো হাসি হাসল।
তিন গোয়েন্দা ভাবল এখনই ভীষণ রাগে ফেটে পড়বেন রাবাত। কিন্তু। পড়লেন না। ওদের অবাক করে দিয়ে বরং দলটার দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি হাসলেন। বললেন, এদের মধ্যে একটা ছেলেও ভাল নেই। সব পচা ডিম।
নানা, চলো চলে যাই! ঘাবড়ে গিয়ে বলল মুসা।
চত্বরের শেষ মাথায় চলে গেছে দলটা। প্রায় একসঙ্গে ঘুরে গিয়ে পাশাপাশি দাঁড়াল। ক্লাচ চেপে ধরে, এক্সিলারেটর বাড়িয়ে দিয়ে ইঞ্জিনের বিকট গোঁ-গোঁ শব্দ তুলে রাবাতকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করল। তিন কিশোর আর একজন বুড়োর ক্ষমতা কতখানি আন্দাজ করছে।
হাত ধরে টানল মুসা, নানা, চলো!
ইইইই-ইআআআ! বলে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল এক আরোহী। দলটার দলপতি।
গর্জে উঠল তার ইঞ্জিন। সোজা ছুটে আসতে লাগল রাবাত আর ছেলেদের লক্ষ্য করে।
কাছাকাছি থাকো, ছেলেদের আদেশ দিলেন রাবাত, নড়বে না! আগে চলে গেলেন তিনি, লোকটার আক্রমণের মোকাবেলা করার জন্যে।
ভয়ে পেটের ভেতরে খামচি দিয়ে ধরল যেন কিশোরের।
নেতার পেছনে ভয়ানক গতিতে ছুটে আসছে বাকি ছয়জন। দাঁত বের করে হাসছে। একটা জিনিস শূন্যে ছুঁড়ে দিল একজন। কাটা বসানো একটা বেল্ট। ওটার বাড়ি শরীরে পড়লে কি অবস্থা হবে কল্পনা করে শিউরে উঠল কিশোর।
গোয়েন্দাদের চারপাশে জেটির লোক আর ট্যুরিস্টরা ছুটাছুটি করে সরে যাচ্ছে। কে যেন চিৎকার করে বলল, পুলিশকে ফোন করো।
ইঞ্জিনের গর্জন তুলে রাবাতের পাশ কেটে চলে গেল মোটর সাইকেলগুলো। কয়েক গজ গিয়ে ঘুরে আবার ছুটে আসতে লাগল। আরোহীদের অট্টহাসি তুঙ্গে উঠেছে।
রাবাত আর তিন গোয়েন্দাকে ঘিরে ফেলল ওরা। ঘুরতে ঘুরতে ছোট করে আনছে বৃত্ত। ভেতরে আটকা পড়েছে ওদের শিকার। এক মারাত্মক খেলায় মেতেছে।
আচমকা বৃত্ত ভেঙে দিয়ে রাবাতের দিকে সাইকেলের নাক ঘোরাল দলপতি। তীব্র গতিতে ছুটে এল রাবাতের দিকে। মাত্র হাতখানেক দূরে এসে ঘ্যাচ করে ব্রেক কষল। ওর ফিনফিনে দাড়ির ওপরে চৌকো একটা চোয়াল, বড় বড় দাঁত, কালো কুতকুতে চোখ। সাতটা ইঞ্জিনের গর্জনকে ছাপিয়ে হা হা করে হেসে উঠল সে।
নড়ে উঠলেন রাবাত। নড়াটা এত সামান্য, প্রায় চোখেই পড়ল না গোয়েন্দাদের। মনে হলো, কি যেন ছুঁড়ে দিলেন।
পিস্তলের গুলি ফোঁটার মত টাসস করে শব্দ হলো। দেখা দিল এক ঝলক, কালো ধোয়া। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে ঢেকে দিতে লাগল মোটর সাইকেল আরোহীকে।
কুতকুতে চোখে ভয় দেখা দিল। হাসির বদলে মুখ থেকে বেরিয়ে এল চিৎকার। মেঘের ভেতর থেকে সরে যাওয়ার জন্যে এত জোরে মোটর সাইকেল ঘোরাতে গেল, চাকা পিছলে পড়ে গেল কাত হয়ে।
আবার নড়ে উঠলেন রাবাত। আবার শোনা গেল তীক্ষ্ণ শব্দ, এবং তারপর ধোয়া।
পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল বিমূঢ় আরোহীরা। দিশেহারা হয়ে গেছে। যেন। পাগলের মত এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজছে অদৃশ্য রহস্যময় পিস্তলধারীকে। কার গায়ে গুলি লেগেছে বোঝার চেষ্টা করছে।
হাইওয়েতে সাইরেন শোনা গেল। পুলিশ আসছে।
ছাতের ওপরে আলো ঘোরাতে ঘোরাতে জেটির দিকে ছুটে এল। পুলিশের দুটো গাড়ি।
মোলায়েম হাসি হেসে রাবাত বললেন, চলো, ছেলেরা, খিদে পেয়েছে।
পানির কিনারের একটা রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। তাকে অনুসরণ করল তিন গোয়েন্দা।
রেস্টুরেন্টের দরজায় লোকের ভিড়। রাবাত কাছাকাছি হতেই সরে গিয়ে ঢোকার জায়গা করে দিল।
তার কাঁধে হাত রেখে সহানুভূতির সুরে জিজ্ঞেস করল একজন, কোথাও লাগেনি তো?
ওদের সঙ্গে লাগতে যাওয়া উচিত হয়নি আপনার, আরেকজন বলল। নরকের ইবলিস একেকটা। পুলিশ আসাতে বাচলেন!
পুলিশ আসাতে আমি নই, শান্তকণ্ঠে জবাব দিলেন রাবাত, ওরা বেঁচেছে। কতটা ক্ষতি যে করতে পারতাম জানেই না!
.
০৮.
রেস্টুরেন্টের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন রাবাত। মোটর সাইকেল গ্যাঙের লোকগুলোকে ধরেছে পুলিশ। লাইসেন্স দেখছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখাতে বাধ্য হচ্ছে আরোহীরা।
তাড়া না থাকলে ওদের বিরুদ্ধে নালিশ করতাম, বললেন তিনি। জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়তাম ব্যাটাদের। কিন্তু এখন ওসব করার সময় নেই। খাবারের একটা মেনু খুললেন।
একে একে স্টার্ট দিতে আরম্ভ করল লোকগুলো। একসঙ্গে দল বেঁধে। পাশাপাশি এগিয়ে চলল পানির কিনার ধরে। গাড়িতে উঠল পুলিশ অফিসারেরা। দলটার পেছনে চলল।
হাজতে নিয়ে যাচ্ছে নাকি? রবিনের প্রশ্ন।
মনে হয় না, রাবাত বললেন। শহর থেকে বের করে দিয়ে আসতে যাচ্ছে হয়তো।
নানা, শব্দটা কি করে হয়েছিল? জিজ্ঞেস করল মুসা।
শব্দ? কিসের শব্দ? মেন্যুতে মনোযোগ রাবাতের, মোটর সাইকেল। আরোহীদের কথা যেন ভুলেই গেছেন।