তার চুপ করে থাকাকেই হ্যাঁ ধরে নিয়ে ওদেরকে ঘরে ফিরে আসতে বললেন রাবাত। ওরা এলে ঘোঁৎ-ঘোৎ করে বললেন, ও সন্দেহ করেছে, আমার কাছেই আছে জিনিসটা। খুঁজুক। যত ইচ্ছে উৎপাত করুক, নিতে আর পারবে না।
কি আছে তোমার কাছে, নানা? জানতে চাইল মুসা।
ও সব জেনে কাজ নেই তোদর। যত কম জানবি তত ভাল থাকবি। যা, শুয়ে পড়গে। রাত এখনও অনেক বাকি। ওই শেয়ালটার জন্যে ঘুম নষ্ট করার কোন মানে নেই। চেষ্টার কমতি করছে না, তবে ক্ষতি কিছু করতে পারেনি। কি বলিস?
তা পারেনি, জবাব দিল কিশোর।
মাথা ঝাঁকালেন রাবাত। পারবেও না। ওর স্বভাবই ওরকম। চোরের মত আসে যায়। মুখোমুখি হওয়ার সাহস নেই।
নিজের ঘরে চলে গেলেন রাবাত। গোয়েন্দাদের অবাক করে দিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নাক ডাকানো শুরু করলেন।
মুসা বলল, নানার কথা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে এখন। তার আবিষ্কারের পেছনেই লেগেছে মিলার। নিতে যখন পারেনি, আবারও আসতে পারে। তালা কিংবা জানালা ভেঙে গাড়িটার ক্ষতি করতে পারে। বাকি রাতটা আমি গাড়িতে ঘুমাব।
রাবাতের ঘরে ঢুকল সে। নাসিকা গর্জনের সামান্যতম ব্যাঘাত না ঘটিয়ে আলগোছে টেবিল থেকে গাড়ির চাবি তুলে নিয়ে ফিরে এল। নিজের বিছানা থেকে কম্বলটা তুলে নিয়ে কিশোরকে সহ নেমে এল নিচে, গাড়ির কাছে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল দুজনে। গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে টর্চ বের করল মুসা। কিন্তু সুইচ অনেক টেপাটেপি করেও আলো জ্বালতে পারল না।
দূর! ব্যাটারি শেষ মনে হয়। দেখা গেল না!
হতাশ খানিকটা কিশোরও হলো। বলল, যার জন্যে এসেছিল, নিতে পারেনি মিলার। আবার আসতে পারে। এলে একা কিছু করতে বেরিও না। আমাদের ডেকো।
মুসাকে গাড়িতে রেখে ঘরে ফিরে এল কিশোর।
পেছনের সীটে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে দিল মুসা। মনে হলো মুহূর্তের জন্যেও আর দুচোখের পাতা এক করতে পারবে না।
কিন্তু পারল। তবে গাঢ় হলো না ঘুম। একের পর এক দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল। আবার দেখল সেই স্বপ্নটান্যাংটো হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে আর তার নানা। লোকে হাসাহাসি করছে। সরে যাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে, কিন্তু নানা তাকে যেতে দিচ্ছে না।
ঘুম ভেঙে গেল তার। সবে সূর্য উঠছে তখন। গাছের ডালে কলরব করছে পাখিরা। মুসা দেখল, লাল জগিং স্যুট পরা মোটা এক মহিলা গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে তাকে।
মুসা চোখ মেলতেই জিজ্ঞেস করল, এখানে কি?
উঠে বসল মুসা। পরনে কেবল জাঙ্গিয়া। নামার সময় তাড়াহুড়োয় অন্য কাপড় না পরে কোমরে শুধু কম্বল জড়িয়ে বেরিয়েছিল। স্বপ্নটা সত্যি হয়ে যাচ্ছে দেখে ধক করে উঠল বুক। পিছলে সীট থেকে মেঝেতে নেমে গেল সে।
সন্দেহ হলো মহিলার। চোর-টোর নাকি? দরজার হাতল ধরে টান দিল।
খাইছে! ভাগ্যিস ঘুমানোর আগে তালা লাগিয়ে রেখেছিলাম। মরিয়া হয়ে চিৎকার করে বলল, আপনি যান! সরুন!
ভাল করে কম্বল টেনে শরীরের নিচের অংশ ঢেকে দিল সে। গেল না মহিলা। জানালার কাছে নাক ঠেকিয়ে আরও বেশি করে উঁকি দিতে লাগল। আর কোন উপায় না দেখে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল মুসা। কোমরে কম্বল জড়ানো।
গাড়িতে কি করছিলে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল মহিলা।
ঘুঘুমাচ্ছিলাম। এটা আমাদেরই গাড়ি!
কেন, হোটেলে কি জায়গার অভাব?
না, তা নয়… কোমরে পেঁচানো কম্বল চেপে ধরে হাঁটতে শুরু করল। মুসা।
ভুরু কুঁচকে ফেলল মহিলা, ব্যাপার কি, অমন করছ কেন? তোমার বাবা-মা সঙ্গে আসেনি? এ ভাবে ছেলেকে গাড়িতে ঘুমাতে ছেড়ে দিল? কাজটা কি ঠিক করেছে?
না, ম্যাম, কোনমতে দায়সারা জবাব দিয়ে মোটেলের দরজার দিকে দৌড় দিল মুসা।
হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল মহিলা। বিড়বিড় করে বলল, কি সাংঘাতিক কিপটেরে বাবা! পয়সা বাঁচাল! ছেলেকে গাড়িতে পাঠিয়ে নিজেরা ঘরে শুয়ে আছে আরাম করে! আরেকটা ঘর ভাড়া নিতে এমন কি-ই বা খরচ হত!
সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ব্যাঙের মত লাফাতে লাফাতে ওপরে উঠে এল মুসা। দরজায় ধাক্কা দিল। খুলে দিল রবিন।
ভেতরে ঢুকে সব বলল মুসা। শেষে বলল, নানাকে বলার দরকার নেই। শুনলেই যাবে মহিলার সঙ্গে ঝগড়া করতে!
হাসতে লাগল রবিন।
রেডউড হাইওয়ে ধরে সেদিন আরও উত্তরে এগিয়ে চলল ওরা। ফুরফুরে মেজাজে আছেন রাবাত। পথের দুই ধারে রেডউডের জঙ্গল তার স্মৃতিকে নাড়া দিয়ে চলেছে। মনে পড়ছে বহুদিন আগের কথা। সেদিন এ পথে যাওয়ার সময় বয়েস ছিল অনেক কম, পাশে ছিল তরুণী স্ত্রী। আর আজ!
জিজ্ঞেস করলেন, মুসা, তোর নানীর কথা মনে আছে?
নানার এই আচমকা প্রশ্নে অবাক হয়ে গেল মুসা। আছে, অল্প অল্প। খুব ভাল অ্যাপল কেক বানাতে পারত নানী।
আরও অনেক কিছু পারত, বিষণ্ণ হয়ে গেলেন রাবাত। আমাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত থাকতে পারত না। আর এখন! মানুষ মরে গেলে কত দূর হয়ে যায়!
স্থির দৃষ্টিতে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। এক খোলসে যেন দুজন মানুষ। একজন অতি কোমল হৃদয়ের স্নেহপ্রবণ স্বামী এবং নানা, যিনি তার মৃত স্ত্রীর কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে যান, নাতিকে ভালবাসেন, ভালবাসেন তার বন্ধুদেরও। আরেকজন সাংঘাতিক বদমেজাজী পাগলাটে এক বৃদ্ধ, পড়শীকে যিনি সারাক্ষণ সন্দেহ করেন, দুচোখে দেখতে পারেন না, একবিন্দু সহ্য করতে পারেন না। যদিও সহ্য করার মত লোক নয় হ্যারিস মিলার। তারও দোষ আছে। বাগান করার যন্ত্রপাতি চুরি করে খামখেয়ালী একজন মানুষকে খেপানোর কি দরকার?