দম বন্ধ করে ফেলল সে। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল নিথর হয়ে। স্তব্ধ, বিস্মিত। তারপর চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে গিয়ে বলল, কিশোর, দেখে যাও!
চোখের পলকে তার পাশে চলে এল অন্য দুই গোয়েন্দা। জানালা দিয়ে ওরাও দেখতে পেল মিলারকে। রাবাতের গাড়িটার চারপাশে ঘুরছে। একটা জানালার কাছে থেমে কাঁচে নাক ঠেকিয়ে ভেতরে উঁকি দিল। সরে গেল। পেছনে, বুটের ঢাকনা টেনে তোলার চেষ্টা করল। না পেরে ফিরে তাকাল। মোটেলের অফিস এবং তার ওপরের জানালাগুলোর দিকে।
ঝট করে নিচু হয়ে গেল তিন গোয়েন্দা, যাতে চোখে না পড়ে।
দ্বিধা করল মিলার। চিন্তিত ভঙ্গিতে বুইকটার দিকে তাকাল আরেকবার। তারপর লিংকনে উঠে স্টার্ট নিয়ে চলে গেল।
একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল তিনজনে।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল একবার কিশোর। বলল, মুসা, মনে হচ্ছে তোমার নানার সন্দেহই ঠিক, তার ফর্মুলা চুরির চেষ্টা করছে মিলার।
মাথা নেড়ে মুসা বলল, বুঝতে পারছি না। তবে কিছু একটা যে খুজতে এসেছিল মিলার, তাতে কোন সন্দেহ নেই। যা হোক, মিলারের কথা নানাকে বলার দরকার নেই। কি ঘটাবে কে জানে। শেষে পুলিশ তাকেই ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে ভরবে।
হু, আনমনে মাথা নাড়ল কিশোর।
মিলারের ব্যাপারটা কাকতালীয়ও হতে পারে, রবিন বলল, বিষ্যত্বর থেকে নাকি ছুটিতে আছে। হয়তো আমাদের মতই বেড়াতে বেরিয়েছে। এ দিকে এসেছিল মোটেলের খোঁজে। রাবুনানার গাড়িটা দেখেছে। ভাল করে দেখে যখন বুঝেছে এটা তারই, এই মোটেলে ওঠার সাহস করেনি আর, পালিয়েছে। পাগলকে সবাই ভয় পায়।
তোমার কথায় যুক্তি আছে। তর্জনী তুলল মুসা, কিন্তু একটা কথা। নতুন গাড়ি কোথায় পেল মিলার? তার তো একটা ঝরঝরে পুরানো শেভি গাড়ি ছিল দেখেছি।
ভাড়া নিয়েছে হয়তো, কিশোর বলল। অত পুরানো গাড়ি নিয়ে দূরের যাত্রায় বেরোনো ঠিক হবে না, তাই।
জবাব না পেয়ে চুপ হয়ে গেল মুসা। তবে সন্তুষ্ট হতে পারল না। মনটা খুঁতখুঁত করতেই থাকল।
আবার টেলিভিশন দেখায় মন দিল তিন গোয়েন্দা।
কিছুক্ষণ পর ছেলেরা কি করছে দেখতে এলেন রাবাত।
রাত সাড়ে দশটায় বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা।
শোয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লেন রাবাত। তাঁর নাক ডাকানোর বিকট গর্জন পাশের ঘরে অন্যদের কানে এসে পৌঁছল। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। রবিন। হেসে উঠল কিশোর। উঠে গিয়ে মাঝখানের দরজাটা লাগিয়ে দিল মুসা। তারপরেও পুরোপুরি বন্ধ হলো না শব্দ, পাল্লার ফাঁক দিয়ে আসতে লাগল এ পাশে। তবে ঘুমাতে আর অসুবিধে হলো না।
একটা আজব স্বপ্ন দেখল মুসা। হোটেলের লবিতে নানাকে অনুসরণ করে যাচ্ছে সে। অনেক বড় লবি। সুদৃশ্য কাপড় পরা মানুষেরা সব ভিড় করে আছে সেখানে, নানা-নাতিকে দেখছে আর হো-হো করে হাসছে। কেন। হাসছে প্রথমে বুঝতে পারল না মুসা। নানার দিকে চোখ পড়তে দেখল তার। পরনে শুধু লাল গেঞ্জি আর লাল জাঙ্গিয়া। তারপর চোখ পড়ল নিজের দিকে। নানার তো তা-ও কিছু পোশাক আছে, তার পরনে একেবারেই নেই। পুরোপুরি দিগম্বর।
চমকে জেগে গেল মুসা। ঘামে নেয়ে গেছে। পানি খাওয়ার জন্যে উঠে বাথরুমের দিকে চলল সে। জানালা দিয়ে চোখ পড়তে থমকে দাঁড়াল।
পার্কিং লটের উজ্জ্বল আলোগুলো নেভানো। পাশের প্যাসেজ থেকে এসে পড়া আলোয় দেখা গেল বুইকের কাছে ঘাপটি মেরে আছে একটা ছায়ামূর্তি।
কিশোরের বিছানার পাশে প্রায় উড়ে চলে এল মুসা। তাকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে, বলল, কিশোর! জলদি ওঠো! গাড়ির কাছে আবার। এসেছে ও!
.
০৭.
খালি পায়েই ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল তিনজনে।
দুপদাপ করে নামতে গিয়ে হোঁচট খেলো কিশোর। উল্টে পড়তে পড়তে কোনমতে রেলিঙ ধরে সামলে নিল।
গাড়ির পাশে ঝুঁকে থাকা মূর্তিটা ঝট করে সোজা হলো। সিঁড়িতে চোখ পড়তেই আর দাঁড়াল না, দৌড় মারল রাস্তার দিকে মুখ করে রাখা গাড়িগুলোর দিকে।
তাড়া করল তিন গোয়েন্দা। খালি পা বলে সুবিধে করতে পারল না। কিশোর তো খোঁড়াতেই শুরু করল। সবার আগে রাস্তায় পৌঁছল মুসা। কিন্তু লোকটাকে ধরতে পারল না!
ধূর! বিরক্তিতে বাতাসে থাবা মারল সে।
গেল! দাঁড়িয়ে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন।
মিলারকেই দেখেছ তো? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কোন সন্দেহ নেই, জবাব দিল মুসা। পালাচ্ছিল যখন তখনও দেখেছি। বারান্দার আলো পড়েছিল তার মুখে।
বুইকের কাছে ফিরে এল ওরা। ঘুরতে শুরু করল চারপাশে। দরজা টান দিয়ে দেখল। তালা লাগানো। বুটের ঢাকনায়ও তালা। চার হাত-পায়ে ভর রেখে উবু হয়ে গাড়ির নিচে উঁকি দিল কিশোর। নিচেটা অন্ধকার বলে কিছু দেখতে পেল না।
টর্চ লাগবে, উঠে দাঁড়িয়ে হাত ঝেড়ে বালি ফেলল কিশোর।
এই সময় মাথার ওপরে একটা দরজা খুলে গেল। ব্যালকনিতে বেরিয়ে এলেন রাবাত। কি ব্যাপার? চারটেই বাজেনি এখনও, এত সকালে গাড়ির। কাছে কি?
সমস্ত হোটেল ঘুমিয়ে আছে। কেউ যাতে বিরক্ত না হয় সেজন্যে আস্তে করে বললেন তিনি। কিন্তু সেই আস্তেটাই আধ মাইল দূর থেকে শোনা গেল। গলা বটে একখান। পটাপট আলো জ্বলে উঠল জানালায়, দরজা খুলে উঁকি দিল কয়েকজন গেস্ট।
কে জানি ঘোরাফেরা করছিল এখানে, নানাকে জানাল মুসা।
মিলার না তো!
জবাব দিল না মুসা।