গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে আপন মনে হাসলেন তিনি। স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসার পর বেড়ে গেল হাসি। মিলারের ভড়কে যাওয়া চেহারার কথা মনে করেই হয়তো হাসছেন।
পেছনে চিৎকার শোনা গেল। এত কিছুর পরও আবার এসেছে হ্যারিস মিলার। ছুটে আসছে পেছন পেছন। মনে হলো কিছু বলতে চায়। এক হাতে স্ট্র হ্যাট, আরেক হাতে ক্যামেরার ব্যাগ। চিৎকার করে বলল, রাবাত, প্লীজ, একটা মিনিট দাঁড়াও!
দাঁড়ানো তো দুরের কথা, গাড়ির গতিও কমালেন না রাবাত, বরং এক্সিলারেটর চেপে ধরলেন আরও। লাফ দিয়ে আগে বাড়ল গাড়ি।
থামলে না কেন, নানা? মুসা বলল, কি বলতে এসেছে, শুনলে পারতে।
হু, কাজ নেই আর। থামি। ওই চোরটার সঙ্গে আবার কিসের কথা? নতুন কোন ফন্দি করে এসেছে নিশ্চয়। অত কাঁচা লোক নই আমি, আমার ফর্মুলা চুরির সুযোগ দেব তাকে। তার আগেই জেলে ঢোকাব!
রাগ হয়ে গেল মুসার। যা কাণ্ড শুরু করেছ, জেলে তো ঢুকবে তুমি, দেখতেই পাচ্ছি! মাথা গরম করে কখন মেরে বসবে বেচারাকে; সে মরবে, আর গোষ্ঠীসুদ্ধ আমাদেরকে নিয়ে জেলে ভরবে পুলিশ! তোমার সঙ্গে আসাটাই বোধহয় ঠিক হয়নি!
কিশোর আর রবিন মনে করেছিল রেগে যাবেন রাবাত। কিন্তু ওদের অবাক করে দিয়ে হাসলেন তিনি। বাকা চোখে মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, এক্কেবারে দেখি তোর মায়ের মত কথা বলিস! নাকি নানীর মত!
০৬.
পাগলামি শুরু হলেই বিপদ! নইলে নানা এমনিতে মানুষ খারাপ না। যখন ভাল থাকে, তখন তো খুবই ভাল! মুসা বলল। কজন লোক আছে, আমাদের বয়েসী ছেলেদের সহ্য করতে পারে, বলো? তারপর আবার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া! আসলে আমাদেরকে ভাল লেগে গেছে তার।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। মুসার নানাকে অনেক আগে থেকেই চেনে সে, তবে এ রকম ঘনিষ্ঠ ভাবে মেশার সুযোগ হয়নি। মুসারই হয়নি, তার আর কি হবে। তার আচরণে ক্রমেই অবাক হচ্ছে। ভাল না মন্দ, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ভদ্রলোকের। এই ভাল তো এই খারাপ। তবে একটা কথা ঠিক, মিলারকে না দেখলে মেজাজ ভালই থাকে তার। অন্তত এতদিন থেকেছে। ভবিষ্যতে কি হবে বলা যায় না।
দুপুর দেড়টা বাজে। বুইকের গায়ে হেলান দিয়ে কথা বলছে দুজনে। তাকিয়ে আছে রবিন আর রাবাতের দিকে। ঘাসে ঢাকা একটা ঢালের গা বেয়ে কিছু দূর উঠে গেছে ওরা। ক্যামেরা উঁচিয়ে ছবি তুলছে রবিন। স্যান ফ্রান্সিসকো বে আর গোল্ডেন গেট ব্রিজের দিকে তাকিয়ে আছেন রাবাত। মহাসুখী মনে হচ্ছে তাকে। মেজাজ অত্যন্ত ভাল। মুসা ভাবল, ইস, এ রকম মেজাজ যদি শেষ পর্যন্ত থাকত।
রাবাতের মেজাজ সেদিন খারাপ হচ্ছে না। সকালে মিলারের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সামান্য একটুক্ষণ খারাপ ছিল, আনমনে বিড়বিড় করেছেন, ঘোৎ-ঘোৎ করেছেন। হাইওয়ে ১০১-এ ওঠার পর মিলারের কথা উধাও হয়ে গেছে তার মন থেকে। শিস দিতে আরম্ভ করেছেন। উত্তরে স্যান। ফ্রান্সিসকোয় পৌঁছে কিছুক্ষণের জন্যে থেমেছিলেন। লাঞ্চ খাওয়ার জন্যে। কিছু সুভনিরও কেনা হয়েছে। লাঞ্চ খেতে খেতে শুনিয়েছেন ১৯০৬ সালে স্যান ফ্রান্সিসকোর ভয়াবহ ভূমিকম্পের কথা।
পুরো শহরটাতেই আগুন লেগে পুড়ে গিয়েছিল, তাই না? কিশোর বলেছে।
মাথা ঝাঁকিয়েছেন রাবাত। পানি আর গ্যাসের পাইপগুলো আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ভূমিকম্পে। তারপর যখন গ্যাসে আগুন ধরে গেল, নেভানোর জন্যে পানি আর পাওয়া গেল না।
বেলা দুটোয় গোল্ডেন গেট ব্রিজ পেরোল ওরা। সাউস্যালিটোতে এসে হাইওয়ে ছেড়ে পাহাড়ী রাস্তায় ঢুকে পড়লেন রাবাত। এক জায়গায় থেমে রবিনকে আরও কিছু ছবি তোলার সুযোগ দিলেন।
আড়াইটা বাজল। ফিল্ম শেষ হয়ে গেল রবিনের। অবাক হলো সে। এত তাড়াতাড়ি তো শেষ হওয়ার কথা নয়! এত ছবি কি তুলেছে? সন্দেহ হতে লাগল।
পাহাড় বেয়ে দৌড়ে নেমে এল সে। গাড়ির পেছন থেকে ক্যামেরার ব্যাগটা বের করে নতুন ফিল্ম নিয়ে ক্যামেরায় ভরল। কি যেন একটা পরিবর্তন হয়েছে কোথাও, ঠিক ধরতে পারছে না। চাপ লেগেই বোধহয় বেশি চ্যাপ্টা হয়ে গেছে ব্যাগের ওপরটা, ময়লাও লেগেছে বেশ। চিন্তিত মনে ফিরে গিয়ে আরও কয়েকটা ছবি তুলল।
আবার হাইওয়েতে ফিরে এল ওরা। আরও উত্তরে এগিয়ে চলল। রাস্তার দুধারে সুন্দর অঞ্চল। আস্তে আস্তে পশ্চিমে ঢলতে শুরু করল সূর্য।
ডিনারের সময় সান্তা রোজাতে পৌঁছল ওরা। একটা মোটেলে উঠে দুটো রুম ভাড়া করলেন রাবাত। পাশাপাশি ঘর। মাঝের দরজা দিয়ে একঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়া যায়। দরজাটার কোন প্রয়োজন পড়বে না ওদের, ভাল আর কোন ঘর পাওয়া গেল না বলেই নেয়া।
মোটেলের পুলে সাঁতার কাটার প্রস্তাব করলেন রাবাত। সাতারের পর মোটেলের ডাইনিং রুমে খাওয়া সারলেন। ঘরে এসে রবিন আর কিশোর টিভি দেখতে লাগল, মুসার পেল ঘুম।
এত তাড়াতাড়ি বিছানায় যেতে ইচ্ছে করল না তার। ঘুম তাড়ানোর জন্যে নিচে পুলের ধারে বসানো সোডা মেশিন থেকে একটা সোডা কিনতে চলল। জানালার ধার দিয়ে দরজার কাছে যেতে হয়। জানালার বাইরে চোখ পড়তেই সোডা খাওয়ার কথা ভুলে গেল সে।
ওদের ঘরটা দোতলায়। পার্কিং এরিয়াটা দেখা যায়। নিচে সারি সারি গাড়ি পার্ক করা আছে। নানার বুইকটাও আছে, ওদের ঘরের বেলকনির ঠিক নিচেই। পেছনে খানিক দূরে একটা চকচকে লিংকন গাড়ি। সেটা থেকে হ্যারিস মিলারকে বেরিয়ে আসতে দেখল মুসা।