দ্বিধা করতে লাগল মুসা। তার নানা যে ওত পেতে আছেন ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে এ কথা বলে সাবধান করে দেবে মিলারকে? করতে গেলে এবং সেটা দেখে ফেললে তার ওপর খেপে যাবেন নানা। সেটা চায় না সে। মিলারের সঙ্গে আবার একটা বিচ্ছিরি এটে যাক, এটাও চায় না। কি করবে তাহলে? মুশকিলে পড়ে গেল।
ঘুরে তাকাল সে। দেখল, কিশোরও তাকিয়ে আছে। বুঝল, তার মত একই সমস্যায় পড়েছে কিশোরও।
কয়েক পা হেঁটে গিয়ে একটা বেঞ্চে বসল রবিন। ক্যামেরাটা ব্যাগে ভরে পাশে রেখে সাগরের দিকে তাকাল। মিলারকে না দেখার ভান করল।
ক্যামেরা হাতে হেঁটে এল মিলার। মুসার এত কাছে দাঁড়াল, আরেকটু হলে কাঁধে কাধ ঠেকে যেত, অথচ লক্ষ করল না তাকে। ভয়ানক অন্যমনস্ক। বার বার পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে আর ঘড়ি দেখছে। কারও আসার অপেক্ষা করছে বোধহয়।
মিনিট দুয়েক পর এল সে। সতর্ক দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে দেখতে ধীর পায়ে এগিয়ে এল। কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, মিলার?
কেমন একটু বিস্ময় আর অবজ্ঞা প্রকাশ পেল লোকটার কণ্ঠে। ফিরে। তাকাল কিশোর। বয়েস চল্লিশের কোঠায়, মাথায় মসৃণ কালো চুল, মুখটাও মসৃণ। পরনে সিল্কের পাজামা, গায়ে নরম কাপড়ের দামী শার্ট। চোখে বিরাট সানগ্লাস মুখের অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে। চোখা পাতলা নাক। পাতলা ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি। ছোট ছোট কান মাথার সঙ্গে প্রায় লেপ্টে আছে। তার পাশে কেমন আড়ষ্ট আর নগণ্য লাগছে জিনস আর সাদা শার্ট পরা গাট্টাগোট্টা মিলারকে।
জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে মিলার বলল, এনেছি।
কিশোরের দিকে তাকাল আগন্তুক।
নিরীহ ভঙ্গি করে সাগরের দিকে চোখ ফেরাল কিশোর।
আসুন, বলে হাঁটতে শুরু করল লোকটা।
নতুন জিনসের খসখস শব্দ তুলে তার পেছনে এগোল মিলার।
আবার ওদের দিকে ফিরল কিশোর। রবিনের কাছাকাছি চলে গেছে দুজনে। কেমন সন্ত্রস্ত লাগছে মিলারকে। স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বার বার তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। যেন লক্ষকোটি চোখ রয়েছে তার। ওপর। সেগুলোকে এড়ানোর চেষ্টা করছে। অমন করছে কেন লোকটা?
রবিন যে বেঞ্চটায় বসেছে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল সানগ্লাস পরা লোকটা। ফিতে ধরে ক্যামেরাটা ঝোলাতে ঝোলাতে তার সঙ্গে সঙ্গে গেল মিলার। তাকে লোকটা বলল, বসুন এখানে।
বসতে যাবে মিলার, এই সময় চোখ পড়ল রবিনের মুখের দিকে।
কুকড়ে গিয়ে যেন নিজেকে অদৃশ্য করে ফেলতে চাইল রবিন।
কিন্তু চিনে ফেলেছে মিলার। চমকে গিয়ে বলল, তুমি!
কিশোর দেখল, ফ্যাকাসে হয়ে গেছে তার মুখ।
বসা আর হলো না মিলারের। সোজা হয়ে চারপাশে তাকাল। কিশোর আর মুসাকেও দেখতে পেল এতক্ষণে। তবে তার চোখ ওদের খুঁজছে না। কাকে খুঁজছে, বুঝতে পারল কিশোর। বিশাল ঝিনুকের খোলার ওপর দিয়ে সেই মুখটাকে দেখতে না পেলেও ধূসর কোকড়া তারের মত চুল বেরিয়ে থাকতে দেখল।
ধরা পড়ে গেছেন বুঝে আর লুকানোর চেষ্টা করলেন না রাবাত। সোজা হলেন। রাগে জ্বলছে চোখ।
মড়ার মুখের মত সাদা হয়ে গেল মিলারের মুখ।
খাইছে! আঁতকে উঠল মুসা। মিলারের দিকে ছুটল। কিন্তু দেরি করে ফেলেছে।
তীব্র গতিতে দোকান থেকে ছুটে বেরোলেন রাবাত। মুঠো করে ফেলেছেন হাত। পিটিয়ে বালির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন বুঝি আজ মিলারকে!
হাতের ক্যামেরাটা বেঞ্চে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দুই হাত তুলে ফেলল মিলার। পিছিয়ে গেল বেঞ্চের কাছ থেকে। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল যে লোকটা, বিপদ বুঝতে পারল সে-ও। যেন পিছলে বেরিয়ে চলে গেল।
তার দিকে নজর নেই তিন গোয়েন্দার, রাবাত আর মিলারকে দেখছে।
মিলারের কলার খামচে ধরলেন রাবাত। চেঁচাতে লাগলেন, দেখে ফেলব ভাবোনি, না! আশা ছাড়তে পারোনি। বলেছি না, পাবে না। আমার কাছ থেকে জিনিস নেয়া অত সহজ না।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজাল মিলার। কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু বেরোল কেবল ঘড়ঘড় শব্দ। কণ্ঠনালীতে চাপ পড়ায় কাশতে শুরু করল। বাধা দেয়ার চেষ্টা করল না, রাবাতকে ঠেলে সরাল না; এমনকি পিছিয়ে যাবার কিংবা দৌড় দেয়ার চেষ্টাও করল না–প্রচণ্ড ভয়েই বোধহয় আড়ষ্ট হয়ে গেছে। হাঁ করে তাকিয়ে রইল মারমুখো কালো মুখটার দিকে। নিজের মুখের যে কি ঘনঘন পরিবর্তন হচ্ছে জানতে পারল না।
মিলারকে ভয় দেখাতে পেরে সন্তুষ্ট হলেন রাবাত। শার্ট ছেড়ে দিয়ে বললেন, যাও, ছেড়ে দিলাম এবারও! আবার যদি পিছে লাগতে দেখি…! কথাটা শেষ না করে ইঙ্গিতেই বুঝিয়ে দিলেন কি করবেন। ছেলেদের কাছে। সরে এসে বললেন, চলো, ভিড় জমে যাচ্ছে।
দম বন্ধ করে ফেলেছিল মুসা। বিপদ কেটে যেতে নিশ্বাস ছাড়ল।
গা ঘেষাঘেঁষি করে পড়ে আছে দুটো ক্যামেরার ব্যাগ। ছোঁ মেরে একটা তুলে নিয়েই রওনা হয়ে গেল উত্তেজিত রবিন। ভিড় জমে গেলে মিলার কি করবে, কে জানে! পুলিশ ডাকার জন্যে অনুরোধ করলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কাজটা ঠিক করেননি রাবাত। পুলিশ এলে তিনিই ফাসবেন। লোকে দেখেছে, মিলার কিছু করেনি, তিনিই দোকান থেকে ছুটে এসে তাকে আক্রমণ। করেছেন। অতএব যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালানো দরকার।
রাবাতের পেছনে প্রায় উড়ে চলল তিন গোয়েন্দা। খুব জোরে হাঁটতে পারেন তিনি। পানির ধার ধরে পার্কিং লটের দিকে এগোলেন। বুইকটা আছে ওখানে।