ভুরু কুঁচকে গেল কোরির।
আরে বসো বসো, নিজের পাশে মাটিতে বিছানো ক্যানভাসে চাপড় দিল কিশোর। এই রবিন, বাজে কথা বোলো না তো। দেখি সরো, কোরিকে জায়গা দাও। বসো, কোরি। এত সুন্দর দিনটা রাগারাগি করে নষ্ট কোরো না।
কিন্তু তাই বলে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি সহ্য করব? মেজাজ দেখিয়ে ক্যানভাসের ওপর বসে পড়ল কোরি।
সারাদিন ছিলে কোথায়? জানতে চাইল কিশোর।
ঘুম থেকেই উঠেছি দেরি করে, ব্যাগ থেকে বড় একটা তোয়ালে টেনে বের করল কোরি। তারপর হোটেলের মধ্যে এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করেছি খানিকক্ষণ। আন্ট জোয়ালিনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি পারিনি। মেলবয়েস বললেন, লঞ্চ আসার সময় হলে গাড়ি নিয়ে ডকে যাবেন আন্টিকে নিয়ে আসতে।
যদি আজকে আসেন।
হ্যাঁ।
জায়গাটা কিন্তু ভারি সুন্দর! কিশোরের পাশে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল রবিন। C. কোরি তখনও নানা জিনিস বের করছে। সানট্যান লোশনের শিশিটা বের করে রাখল একপাশে। সাঁতার কাটতে যাবে কেউ?
নাহ, মাথা নাড়ল কিশোর। আমার বসে থাকতেই ভাল লাগছে। মুসাকে গিয়ে বলো, তোমার সঙ্গে নামবে।
দেখো, একটা পাখি, ওপর দিকে তাকিয়ে আছে রবিন। ইস, আমিও যদি ওরকম করে উড়তে পারতাম!
কোরি আর কিশোর দুজনেই মুখ তুলে তাকাল। ধূসর আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে বড় একটা পাখি।
বাজপাখি, কোরি বলল।
এখানে বাজও আছে নাকি? পাখিটার সঙ্গে সঙ্গে নজর সরছে তার। চশমার কাঁচে ফ্যাকাসে নীল আকাশের প্রতিবিম্ব।
মনে হয় না, কোরি বলল। পাখিটাকে বেমানান লাগছে এখানে। এই দ্বীপের সব কিছু রঙিন, ঝলমলে, সুন্দর। অন্য কোনখান থেকে উড়ে এসেছে হয়তো মাছের আশায়। ক্ষণিকের জন্যে মনে হলো বাজপাখির ডানায় ভর করে অবাঞ্ছিত- অশুভ কোন কিছু কালো ছায়া ফেলতে এসেছে দ্বীপের সাদা সৈকতে। ভাবনাটাকে জোর করে মন থেকে তাড়াল সে।
পানিতে দাঁড়িয়ে আছে এখনও মুসা। ওদের দিকে পেছন করে। নীলচে সবুজ পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে বালি। চিকচিক করছে রোদে। ওর ডানে ঢেউয়ে ক্রমাগত দোল খাচ্ছে নিচু একটা কাঠের ডকে বাধা দুটো ক্যানু। ওদের দুদিকে ধনুকের মত গোল হয়ে বেঁকে গেছে সৈকত।
পেছনে বালির টিলার ওপরে রয়েছে হোটেলটা। সাদা দুর্গের মত বিছিয়ে থেকে যেন পাহারা দিচ্ছে সবকিছুকে। ডাইনিং রূমের বড় জানালার কাছে ঝিলিক দিচ্ছে বিকেলের সোনালি রোদ। বাড়িটার দুদিক থেকে শুরু হয়েছে। পাইন বন। নীলচে-সবুজ। মৃদু বাতাসে সুগন্ধ ছড়িয়ে দুলছে যেন তার ঘোরে।
উফ, বিশ্বাস করতে পারছি না আমি! দেখতে দেখতে বলে উঠল কোরি। এত সুন্দর। ভাল লাগছে অন্য কেউ নেই দেখে। স্বাধীনভাবে দ্বীপে ঘুরে বেড়াতে পারব আমরা। যা ইচ্ছে করতে পারব।
হ্যাঁ, একমত হলো রবিন। আমার কাছে তো স্বর্গ মনে হচ্ছে।
হাত বাড়িয়ে একমুঠো বালি তুলে নিয়ে ঝরঝর করে নিজের পায়ে। ছাড়তে লাগল কোরি। আজ যে আমাদের ছুটি দিয়ে দিয়েছেন এজন্যে মিস্টার মেলবয়েসকে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার।
হ্যাঁ, খুব ভাল লোক। গায়ে জমিদারের রক্ত আছে দেখেই বোঝা যায়।
কিন্তু উলফের ব্যাপারটা কি বলো তো? এরকম ভদ্র মালিকের ওরকম বুনো চাকর! উদ্ভট স্বভাব!
সকালে নাস্তা দেয়ার সময় মুখটাকে কিরকম করে রেখেছিল দেখেছ? একেবারে মরা চিংড়ি।
ওর সমস্যাটা কি? কাল রাতে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইল কেন আমাদের?
ভূত আছে ইঙ্গিত দিল, কোরি বলল, কিন্তু খোলাসা করল না কিছুই।
আমার তো মনে হলো অন্য ইঙ্গিত দিয়েছে, কিশোর বলল।
অন্য কি?
বুঝতে পারলাম না।
কিন্তু আমার বিশ্বাস, ভূতের কথাই বলেছে। এই দ্বীপে ভূত থাকাটা অসম্ভব কিছু নয়। সাড়ে তিনশো বছর আগে সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে এসে এখানে আস্তানা গেড়েছে মানুষ। খুনখারাপি হয়েছে প্রচুর। প্রেতাত্মা। থাকতেই পারে। শোরটাউনের আশেপাশে যত পুরানো বাড়ি, সরাইখানা, দুর্গ আর হোটেল আছে, সবগুলোতে ভূতের বদনাম। আমার মনে হয় না। মিথ্যে কথা বলেছে উলফ, কিংবা আমাদের শুধু শুধু ভয় দেখাতে চেয়েছে। কিছু না থাকলে আমাদের সাবধান করতে আসত না।
আচমকা উঠে দাঁড়াল কোরি।
কি হলো? জানতে চাইল রবিন।
একটা জিনিস ফেলে এসেছি।
কি?
জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করল কোরি। দ্রুত হেঁটে চলল হোটলের দিকে।
সেদিকে তাকিয়ে মন্তব্য করল রবিন, উলফের মত কোরিও আরেকটা উদ্ভটা চরিত্র…
আস্তে! শুনতে পেলে আবার রেগে যাবে।
ওর সঙ্গে জিনার স্বভাবের অনেক মিল, তাই না?
জবাব দিল না কিশোর।
*
সেদিন বিকেলে আকাশটাকে রক্তের রঙে রাঙিয়ে দিয়ে পাইন বনের আড়ালে যখন অস্ত গেল সূর্য, আকাশে দেখা দিল রূপালী চাঁদ, সৈকতে ফিরে এল। আবার ওরা। ফুরফুরে বাতাস শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছে।
ইস্, কি একখান সূর্যাস্ত! আবার বালিতে গড়িয়ে পড়ল রবিন। এভাবে গড়াগড়ি করার নেশা হয়ে গেছে যেন তার। আকাশের দিকে চোখ।
পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে মুসা আর কিশোর। সাগরের পানিতে আকাশের প্রতিবিম্ব দেখছে।
আমার কি মনে হচ্ছে জানো? স্বপ্নিল হয়ে উঠেছে কিশোরের সুন্দর দুটো চোখ। কোন স্বপ্নের জগতে পৌঁছে গেছি!
কোরির হাতে ডোরাকাটা একটা চাদর। এই, ধরো তো একটু, চাদরটা বিছাই।
চাদর বিছাতে ওকে সাহায্য করল কিশোর। দুই কোণে দুটো বড় পিকনিক বাস্কেট চাপা দিয়ে দিল যাতে বাতাসে উড়তে না পারে।