হ্যাঁ, হ্যাঁ! সমস্বরে চিৎকার করে উঠল মুসা, রবিন আর কোরি।
কিশোরের দিকে তাকালেন ব্যারন, তুমি কিছু বলছ না কেন?
অ্যাঁ!..হ্যাঁ, আমারও ভাল লাগবে।
লাগারই কথা। এখানে তোমাদের বয়েসী যারা বেড়াতে আসে, সবারই ভাল লাগে।
মুখের হাসিটা বজায় রেখে পেছনে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন ব্যারন। লম্বা, সাদা চুলে আঙুল চালালেন। কোরির দিকে তাকিয়ে বললেন, কাল। তোমার আন্টির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করব। ও না আসাতে খারাপই লাগছে।
কালকে নাগাদ চলে আসতে পারে। ভায়োলা আন্টি খুব ভাল নার্স।
ট্রে রেখে এঁটো বাসন-পেয়ালা নিয়ে যেতে ফিরে আসছে উলফ। তাকে বললেন ব্যারন, শোনো, ওদের ঘর দেখিয়ে দাও।
জবাব না দিয়ে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল উলফ। বাসন-পেয়ালাগুলো জড়ো করতে গিয়ে ইচ্ছে করে আছড়ে ফেলতে লাগল একটার ওপর আরেকটা।
নিউ সেকশনে ওদের থাকার ব্যবস্থা করেছ নাকি? জানতে চাইলেন ব্যারন।
নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল উলফ, না, ওল্ড উইং।
পলকের জন্যে হাসিটা চলে গেল ব্যারনের মুখ থেকে। পরক্ষণে ফিরে এল আবার। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাতটা গিয়ে সেঁটে ঘুম। দাও। কাল সকালে দেখা হবে। তখন কাজের কথা বলব।
তাকে ধন্যবাদ জানাল ছেলেমেয়েরা। তারপর কথা বলতে বলতে উলফের পেছনে চলল একটা করিডর ধরে। আলো খুব কম এখানে। কীটনাশক তার একধরনের বদ্ধ ভাপসা গন্ধ বাতাসে।
পুরানো বাড়িতে এ রকম গন্ধ থাকে, জানে মুসা। আর ওগুলোই হয় ভূতের আস্তানা।
কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা হেঁটে চলেছে উলফ। একটা মোড় ঘুরল। আরেকটা লম্বা করিডর পেরোল। দুই ধারে সারি সারি বদ্ধ দরজা। আবার একটা মোড় ঘুরল। থামল না।
অবাক লাগছে মুসার। কোথায় ওদের নিয়ে চলেছে লোকটা?
অবশেষে একটা খোলা দরজার সামনে থামল উলফ। দরজায় ব্রোঞ্জের প্লেটে নম্বর লেখা রয়েছে: ১৩২-সি।
বাইরে থেকে যতটা মনে হয়, মুসা বলল, ভেতরটা তারচেয়ে অনেক বড়।
তার মন্তব্যের জবাব দিল না উলফ। এখান থেকে চারটা ঘর তোমাদের জন্যে রেডি করেছি। কে কোনটাতে থাকবে নিজেরাই ঠিক করে নাও।
থ্যাংক ইউ, মোলায়েম স্বরে বলল কোরি।
দেখো, তোমাদের এখানে থাকাটা আমার ভাল লাগছে না, উলফ বলল।
কি?
এখানে থাকা তোমাদের জন্যে বিপজ্জনক।
কি বলতে চান? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ছুতোর মিস্ত্রির কাজ, কিশোরের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল উলফ, খুব কঠিন। মিস্টার মেলবয়েস বুঝতে পারছেন না।
কিন্তু খাটতে তো আমাদের আপত্তি নেই, মুসা বলল, যত কঠিনই হোক, আমরা করব।
এখানে থাকতে ভাল লাগবে না তোমাদের, কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছে উলফ। খালি থাকলে সাংঘাতিক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে এই বাড়ি। পুরানো তো। পুরানো বাড়ি সব সময়ই খারাপ।
আপনারা থাকতে পারলে আমরাও পারব, কোন অসুবিধে হবে না, কোরি বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।
নিশ্চিন্ত থাকতে পারছি নানানা রকম ব্যাপার ঘটে এখানে, বিশেষ করে হোটেলের গেস্টদের বেলায় এমন সব ব্যাপার যা তোমাদের বলতে পারছি না, কণ্ঠস্বর খাদে নেমে এল উলফের।
জায়গাটাতে কোন সমস্যা আছে নাকি? জানতে চাইল কোরি। ভূতের উপদ্রব?
তাকিয়ে রইল উলফ কোরির দিকে। কতটা বলা যায় ওদের চিন্তা করছে। যেন। দেখো, আমি তোমাদের সাবধান করছি…
আসল কথা বলছেন না কেন? ভুত আছে? দেখেছেন?
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল উলফ। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলল, অদ্ভুত অনেক কিছুই দেখতে হয় আমাকে, রহস্যময়, শীতল শোনাল ওর কণ্ঠ। বিচিত্র হাসি ফুটল পাতলা ঠোঁটে। ভূত বিশ্বাস করো নাকি তোমরা?
কিশোর বা রবিন কিছু বলে ফেলার আগেই তাড়াতাড়ি বলল মুসা, করি।
কোরি বলল, প্লীজ, বলুন না, কি দেখেছেন?
বাঁচতে চাইলে এখান থেকে চলে যাও, কোরির প্রশ্নের জবাব দিল না। উলফ। কালই।
ছায়ায়, ঢাকা পড়েছে ওর মুখের বেশির ভাগ অংশ। চেহারা দেখে মনের ভাব বোঝার উপায় নেই। তবে ওর কণ্ঠস্বরই বলে দিল, মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে না সে। আচমকা ঝটকা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। আর একটা কথাও না বলে যেন নিঃশব্দে ভেসে চলে গেল অন্ধকার, শূন্য করিডর ধরে।
.
০৫.
কোরি কোথায়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
বুঝতে পারছি না, রবিন বলল। চোখে মিররড় সানগ্লাস। কাচের ভেতর। দিয়ে মুসার দিকে তাকিয়ে আছে। সৈকতের কিনারে গোড়ালি পানিতে হেঁটে বেড়াচ্ছে মুসা।
সকালে নাস্তার সময় এল না, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল কিশোর। দুপুরে খাওয়ার সময়ও দেখা নেই। গেল কোথায়?
গেছে হয়তো কোথাও ভূতপ্রেত খুঁজতে, ঠোঁট উল্টে বলল রবিন। কিংবা হোটেলের পুরানো কোন কামরায় ধ্যানে বসে প্রেতাত্মার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। ওর তো এইই কাজ।
মেয়েটা কেমন অদ্ভুত…
আমি শুনে ফেলেছি! পেছন থেকে শোনা গেল তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর।
চিত হয়ে ছিল কিশোর। লাফ দিয়ে উঠে বসে ফিরে তাকাল। গোলাপী বিকিনি পরেছে কোরি। হাতে একটা ক্যানভাসের বড় বীচ ব্যাগ। চোখেমুখে রাগ।
কোরি…না বলে কোথায় চলে গেলে তুমি….আমরা এদিকে চিন্তায় বাঁচি না
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তোমাদের সব কথাই আমি শুনেছি। আমি কেমন অদ্ভুত, তাই না?
কোরি…
আমি পাগল? আধিভৌতিক ব্যাপারে আমার কৌতূহল তোমাদের কাছে আমাকে হাস্যকর করে তুলেছে, এই তো বলতে চাও?
তোমাকে হাস্যকর না করলেও, জবাব দিল রবিন, তোমার কাজকর্মকে যে হাস্যকর করেছে, এটা ঠিক।