ও আমাদের উলফ, হেসে পরিচয় করিয়ে দিলেন মেলবয়েস, আগেই তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। সাক্ষাঙ্কারটা নিশ্চয় পছন্দ হয়নি তোমাদের?
লাল হয়ে গেল উলফ। কিন্তু তার চেহারার ভাব বদল হলো না।
উলফ, মেলবয়েস বললেন, আমাদের মেহমানদের খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরে কি আছে?
মুরগীর মাংস, অনেকটা চি-চি করে পাতলা গলায় কথা বলে, মনিবের ভারী গলার ঠিক উল্টো। সালাদও বানিয়ে দেয়া যায়। এমন ভঙ্গিতে শেষ কথাটা বলল সে, যেন বানানো না লাগলেই খুশি হত।
খুব ভাল, উলফের ইচ্ছার পরোয়া করলেন না ব্যারন। বিশাল হাত নেড়ে প্রায় মুরগী খেদানোর মত করে ওকে তাড়ালেন ঘর থেকে।
মাথা নিচু করে কোনদিকে না তাকিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের বড় দরজাটার দিকে চলে গেল উলফ।
.
০৪.
বসো তোমরা, একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন ব্যারন। কথা বলতে ভাল লাগছে। বোর্ডাররা চলে যাওয়ার পর খুব নির্জন হয়ে পড়েছে জায়গাটা। হোটেলে যখন লোক গমগম করে, দারুণ ভাল লাগে আমার।
চেয়ার টেনে বসল কিশোর। ব্যারনের দিকে তাকাল।
জুলাইয়ের শেষ দিকে আশা করি আবার চালু করে ফেলতে পারব, বললেন তিনি। যদি ঠিকমত ফিরে আসে শ্রমিকরা। আমি আর আমার ভাই। মিলারের ধারণা ছিল, মার্চে কাজ ধরলে গরমের ট্যুরিস্ট সীজনের আগেই সেরে ফেলতে পারব। কিন্তু ভুল হয়ে গেছে। ব্যাটারা যে টাকার লোভে এভাবে আমাদের ডুবিয়ে দিয়ে পালাবে ভাবতেই পারিনি।
এক এক করে সবার মুখের দিকে তাকালেন তিনি। আমার ভাই মিলার খুব মেজাজী মানুষ। সব সময় বিষণ্ণতায় ভোগে। কালো হয়ে গেল তার মুখ। তা ছাড়া রোগটা ইদানীং অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। বেশি মানুষ থাকলে নিচেই নামে না। অনেকটা সেকারণে, তাকে কিছুটা শান্তি দেয়ার জন্যেই বলতে পারো হোটেলটা কিছু দিনের জন্যে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই সুযোগে মেরামতটা সেরে ফেলব। এভাবে বন্ধ করলে ব্যবসার বিরাট ক্ষতি। কিন্তু কি করব? ভাই আগে না টাকা…
ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এল উলফ।
একটা প্লেটে বড় এক টুকরো মাংস তুলে নিল মুসা। আমরা আপনাদের সাহায্য করতে পারি। দেয়াল মেরামতের কিছু কিছু কাজ করে দিতে পারব।
হ্যাঁ, সালাদের বাটি থেকে চামচ দিয়ে নিজের প্লেটে সালাদ তুলে নিতে লাগল রবিন। আন্ট জোয়ালিন আমাদের বলেছেন, হোটেলের মালিকের সঙ্গে, অর্থাৎ আপনার সঙ্গে নাকি কথা হয়েছে তাঁর–গরমকালটা হোটেলে পার্ট টাইম চাকরি দেয়া হবে আমাদের। তাতে থাকাখাওয়ার জন্যে আর ভাবনা থাকবে না। পকেট থেকে নগদ পয়সা খরচ করতে হবে না।
বলেছি হয়তো। ঠিক মনে করতে পারছি না, ব্যারন বললেন। যাই। হোক, তোমাদের প্রস্তাবটা কিন্তু মন্দ না।
কিন্তু আমার কাছে মন্দই লাগছে, মুখ নিচু করে বলল উলফ। যার কাজ তাকেই সাজে। অপেশাদার দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজ হয় না।
কাজটা তো কঠিন কিছু নয়, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন ব্যারন। দেয়াল থেকে কিছু কাগজ ছিঁড়তে হবে…আরও কিছু টুকটাক.. আমার তো ধারণা ওই পয়সালোভী চামার শ্রমিকগুলোর চেয়ে ভাল পারবে এরা।
শক্ত হয়ে গেল উলফের চোয়াল। কাজটা নিরাপদ নয় মোটেও, কোরির দিকে তাকাল সে।
চমকে গেল কোরি। কি বলতে চায় লোকটা? মিস্ত্রির কাজে নিরাপত্তার প্রশ্ন কেন উঠছে?
পরের লঞ্চে ওদের ফিরে যাওয়াটাই ভাল মনে করি আমি, উলফ বলল।
কিন্তু আমি মনে করি না, তর্ক শুরু করলেন ব্যারন। কয়েকটা ছেলেমেয়েকে কাজ করতে দেখলে খুশিই হবে মিলার। জানালা দিয়ে বাইরের কালো হয়ে আসা আকাশের দিকে তাকালেন তিনি। হাসি হাসি ভঙ্গিটা চলে গেছে তার।
না। চলে যাওয়াই ভাল, থেমে থেমে একটা একটা করে শব্দ উচ্চারণ করল উলফ। যেন কোন ছোট্ট ছেলেকে বোঝাচ্ছে।
না। ভাল নয়। বরং কয়েকটা ছেলেমেয়েকে এখানে কাজ করতে দেখলেই আমার ভাল লাগবে, কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন হলো না ব্যারনের।
কান খাড়া করে ফেলল কিশোর। ব্যারন একবার বললেন মিলারের ভাল লাগবে। এখন বলছেন আমার ভাল লাগবে। কথাবার্তাগুলো কেমন গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে।
সব কিছু মেরামত করে আবার যখন হোটেল খুলব আমরা, উলফ বলল, অনেক ছেলেমেয়ে আসবে তখন। তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে তার কণ্ঠ। অধৈর্য হয়ে উঠেছে।
বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না মুসার। এসেছে যখন, কয়েকদিন থেকে যেতে পারলে ভাল হত। ব্যারনকে রাজি করানোর জন্যে বলল, আমাদের মধ্যে কিন্তু কোন ফাঁকি পাবেন না। আন্তরিক ভাবে খাটব। আমরা।
রবিনেরও ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আমাদের কাজ দেখে আপনি খুশি হবেন, কথা দিতে পারি।
ঠিক আছে তাহলে, গোঁফের কোণ ধরে এক টান মারলেন ব্যারন। উলফের দিকে তাকালেন, ওরা থাকছে। কাঠমিস্ত্রির কাজ করবে। আমি ওদের বহাল করলাম।
কি প্রতিক্রিয়া হয় দেখার জন্যে উলফের দিকে তাকাল কিশোর।
কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। ভাবলেশহীন চেহারা। খুদে খুদে ধূসর চোখে শূন্য দৃষ্টি। একটা মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল খালি ট্রে-টা। চি-চি করে বলল, ঠিক আছে, আমি যাই।
খুশি হয়ে উঠল মুসা আর রবিন। কোরির মুখেও হাসি। একসঙ্গে কলরব। শুরু করল তিনজনে। কিশোর তাকিয়ে আছে ব্যারনের দিকে। একটা হাত তুললেন তিনি। হাসিমুখে বললেন, আমি আশা করব আন্তরিক ভাবেই খাটবে তোমরা। তবে তোমাদের সময় সবটুকু কেড়ে নিতে চাই না আমি। কাজের সময় কাজ। বাকি সময়টা পুলে সাঁতার কেটে, সৈকতে বেড়িয়ে কাটাতে পারবে, বাধা নেই। ফুর্তি করার জন্যেই তো এসেছ তোমরা, তাই না?