রোজার সাইমন মেলবয়েস? ভুরু কুঁচকে ফেলল রবিন। ব্ল্যাক ফরেস্ট টাউনের গোস্ট লেনে আমাদের একটা বাড়ি আছে। সেখানে পথের মাথায়। একটা অনেক বড় পোড়া বাড়ি…
ওটা ছিল আমার দাদার ভাইয়ের, মেলবয়েস বললেন। রহস্যময় একজন মানুষ ছিলেন তিনি, নিশ্চয় শুনেছ। ব্ল্যাক ফরেস্টে বহুদিন যাই না। এখানেই থাকি এখন। অনেক বদলে গেছে নাকি ব্ল্যাক ফরেস্ট?
খুব একটা না।
ব্ল্যাক ফরেস্ট গোরস্থানের লাশেরা সব এখনও কফিনেই রয়েছে তো? মাথা পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে, চোখ বুজে হেসে উঠলেন মেলবয়েস। কেন এ প্রশ্ন করলাম নিশ্চয় বুঝতে পারছ। ওখানকার লাশ মাঝে মাঝেই ভূত হয়ে কফিন থেকে বেরিয়ে আসার বদনাম আছে তো।
পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর কোরি। চোখে অস্বস্তি।
সামনের লবিতে ঢুকল সবাই। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে লাগল কিশোর। বিশাল লবি। প্রচুর আসবাবপত্র। ডার্ক উডের দেয়াল। কাঠের তৈরি বড় বড় কড়িবরগা। একদিকের দেয়াল ঘেঁষে রাখা হয়েছে অনেকগুলো চেয়ার-টেবিল। ডার্ক উড, নরম মখমল আর চামড়ার গদির ছড়াছড়ি। হোটেলটাকে গ্রীবাস না বলে হান্টিং লজ বললেই মানায় ভাল।
ব্যাগ-সুটকেসগুলো এখানেই রেখে দাও, মেলবয়েস বললেন। তোমাদের ঘর গোছাচ্ছে উলফ। গুছিয়ে এসে এগুলো নিয়ে যাবে।
বোর্ডাররা কই? জানতে চাইল কোরি।
নেই। হোটেল বন্ধ। গোফের এককোণ ধরে টানতে টানতে কোরির দিকে তাকিয়ে বললেন মেলবয়েস। বোঝার চেষ্টা করলেন ওর কি প্রতিক্রিয়া হয়। তোমার আন্টি আমার চিঠি পায়নি?
চিঠি?
হ্যাঁ। গত সপ্তা থেকে ফোন খারাপ। সেজন্যে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। হোটেলের ডাইনিং রূম আর ওল্ড উইঙের কয়েকটা ঘর মেরামত করতে হচ্ছে আমাদের। নতুন করে আসবাব দেব ঘরে ঘরে, জোয়ালিন জানে। এতদিনে শেষ হয়ে যেত কাজ। কিন্তু কাজের মাঝখানে হঠাৎ করে চলে গেল ওরা। জোয়ালিনকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম, আরও দুতিন সপ্তা পরে আসে যেন তোমাদের নিয়ে। ততদিনে কাজ শেষ হয়ে যাবে আমাদের। হোটেল চালু করে ফেলব।
তারমানে চিঠিটা পায়নি আন্টি, হতাশ কণ্ঠে বলল কোরি। শুধু শুধুই কষ্ট করে এলাম আমরা এতটা পথ।
অত দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, মেলবয়েস বললেন। কাল বিকেলে লঞ্চ না আসা পর্যন্ত নিশ্চিন্তে থাকো। উলফ খুব ভাল রান্না করতে পারে। খাওয়ার অসুবিধে হবে না তোমাদের। ইচ্ছে করলে সুইমিং পুল আর সৈকতে সাঁতারও কাটতে পারবে।
কিন্তু মন ভাল হলো না কোরির। কত কিছুই না করবে ভেবে রেখেছিল। সৈকতে রাত কাটানো, চিংড়ি ধরে কয়লার আগুনে ঝলসে খাওয়া, অনেক ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হই-চই করে পার্টি দেয়া, সাগরে সাঁতার কাটা, আরও কত কি। কিন্তু সব গেল। গরমের ছুটিটাই মাটি।
তোমরা খেয়ে বেরিয়েছ? জানতে চাইলেন মেলবয়েস।
না, সারারাত না খেয়ে থাকার ভয়ে তাড়াতাড়ি জবাব দিল মুসা।
ওর ভঙ্গি দেখে হেসে উঠল রবিন আর কিশোর। কোরিও হেসে ফেলল।
এসো, ডাইনিং রূমে, বলে লম্বা লম্বা পা ফেলে জমিদারি চালে হাঁটতে শুরু করলেন মেলবয়েস। উলফকে বলি কিছু রান্না করে দিতে।
অনেক বড় কার্পেট বিছানো একটা ঘরে ঢুকলেন তিনি। সুইচ টিপে কয়েকটা ঝাড়বাতি জ্বেলে দিলেন। ঘরের একধারে বড় জানালার পাশে দুটো লম্বা টেবিল পাতা। টেবিলকুথে ঢাকা। চীনামাটি আর রূপায় তৈরি প্রচুর কাপ প্লেট, গ্লাস-বাটি সাজিয়ে রাখা। ঘরে আরও অনেকগুলো টেবিল আছে। ওগুলোর দুই ধারে যেসব চেয়ার ছিল, সব উল্টে রাখা হয়েছে। বায়ের দেয়ালের কাছে বাঁশ বাধা। কাঠের মঞ্চ। দাগ লাগা ক্যানভাসের কাপড় ঝুলে আছে। দেয়ালের কাগজ ছেঁড়া। ছাতের খানিকটা জায়গার প্লাস্টার খসানো। রাজমিস্ত্রিরা কাজ শেষ না করেই চলে গেছে বোঝা যায়।
সেদিকে দেখিয়ে গজগজ করে বললেন মেলবয়েস, আর সপ্তা দুই কাজ করলেই হয়ে যেত। কিন্তু বেশি পয়সার লোভ দেখিয়ে শোরটাউনের এক শয়তান লোক বিল্ডিং মেরামতের জন্যে ডেকে নিয়ে গেছে ওদের। কবে যে ফিরে আসবে এখন, কোন ঠিক নেই।
ডাইনিং রূমের পেছনের দেয়ালে বিশাল এক জানালা। সেটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কিশোর। আরিব্বাবা, কি দেখা যাচ্ছে!
সূর্য ডুবছে। পেছনের আঙিনায় ছড়ানো অসংখ্য ডেক চেয়ার, টেবিল আর বড় বড় ছাতা। তার ওপাশ থেকে শুরু হয়েছে সৈকত। কালো হয়ে আসা আকাশের পটভূমিতে রূপালী-ধূসর। তারও পরে উপসাগরের জল যেন জল নয়, শিল্পীর তুলিতে আঁকা বিচিত্র রঙের ছবি।
এত সুন্দর! পাশ থেকে বলে উঠল রবিন।
মুসা আর কোরিও দেখছে অপরূপ সূর্যাস্ত।
পেছন থেকে জিজ্ঞেস করলেন মেলবয়েস, কোরি, তোমার আন্টির শরীর কি খুব বেশি খারাপ?
কি জানি! ডাক্তার ডাকতে তো কোনমতেই রাজি হলো না। একটা ফোন করতে পারলে জানা যেত।
পারবে। কাল সকালে। লাইন ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু হোটেলের সুইচবোর্ড নষ্ট। পাইরেট আইল্যান্ড থেকে কাল লোক এসে ঠিক করে দিয়ে যাবার কথা।
কাশতে কাশতে ঘরে ঢুকল উলফ। সাদা রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছল। জানালার কাছে দাঁড়িয়েই ওর দিকে ফিরে তাকাল সবাই।
বেঁটে, রোগাপাতলা একজন মানুষ। কড়া মাড় দিয়ে ইস্তিরি করা খাটো হাতা সাদা শার্ট গায়ে, পরনে কালো প্যান্ট। কালো চুলের ডগা এমন করে মাথার দুই পাশে ছড়িয়ে আছে, যেন কতদিন ধরে আঁচড়ায় না। চোখা চেহারা, ছোট ছোট ধূসর চোখ, খাড়া নাক। চোয়ালের হাড় বেরিয়ে আছে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে আশপাশে যা কিছু দেখছে সব কিছুতেই তার বিরক্তি।