ভাল হবে! উত্তেজনায় চকচক করে উঠল কোরির চোখ।
তা তো হবেই, মুখ গোমড়া করে ফেলেছে মুসা। খাব কি?
অ্যাই, গেট খোলা যাবে, বলে উঠল রবিন।
ঝট করে ফিরে তাকাল কিশোর, কি করে বুঝলে?
ওই যে, হুড়কো। ওটা সরালেই হয়। কারও অপেক্ষা না করে নিজেই হুড়কোটা সরিয়ে দিল রবিন। খুলে ফেলল পাল্লা।
চলো চলো, ঢুকে পড়ি! চিৎকার করে তাড়াতাড়ি সুটকেস দুটো তুলে নিল কোরি। দেরি করলে যেন আবার বন্ধ হয়ে যাবে গেট।
সৈকতে রাত কাটানো আর হলো না তাহলে আমাদের, কিশোরের কণ্ঠে কৃত্রিম হতাশা।
সারা গ্রীষ্মকালই পড়ে আছে সামনে, গেটটা খুলতে পেরে খুব খুশি রবিন, যত ইচ্ছে সৈকতে রাত কাটাতে পারব।
ঢাল বেয়ে উঠে চলল ওরা। দুধারে গাছপালা। মাথার ওপর পাখির কলরব। সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল একটা খরগোশ।
গাছপালার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ল হোটেলটা।
দারুণ তো! বলে উঠল রবিন।
দাঁড়িয়ে গেল সবাই। তাকিয়ে আছে। বিশাল পুরানো আমলের বাড়ি। সাদা দেয়াল। ঢালু লাল টিনের চাল। সাজানো লন। মূল বাড়ি থেকে দুটো শাখা বেরিয়ে উঠে গেছে দুদিকের পাহাড় চূড়ায়। বড় লাল সদর দরজাটার দুদিকে দুটো পর্দা টানা বারান্দা। দুই সারি করে চেয়ার পাতা।
আরও কাছে এগিয়ে হোটেলের পেছনে উপসাগরটা চোখে পড়ল ওদের। কাঠের সিঁড়ি নেমে গেছে সৈকতে। ছোট ডকে কয়েকটা নৌকা বাধা।
খাইছে! দারুণ একটা সৈকত, চোখ বড় বড় করে বলল মুসা।
হ্যাঁ, কিশোর বলল, খুব সুন্দর।
আন্ট জোয়ালিন যতটা বলেছে, তারচেয়ে সুন্দর, হাঁ করে তাকিয়ে আছে কোরি।
ওই দেখো একটা নুইমিং পুল, হাত তুলল রবিন। কত্তবড় দেখেছ! পেছনের ওটা কি? পুলহাউজ নাকি?
কিন্তু লোকজন তো কাউকে দেখছি না, নিচের ঠোঁট কামড়াল কিশোর।
সামনে বিছিয়ে থাকা রাজকীয় হোটেলটার দিকে তাকিয়ে আছে কোরি। তাই তো!
পুলেও কেউ নেই।
ডিনারে বসেছে হয়তো, মুসা বলল। আমারও এখন ওখানেই বসার ইচ্ছে।
কিন্তু আলো কই? ঘরে আলো নেই। বারান্দায় কেউ নেই। সৈকতে কেউ হাঁটছে না। হোটেলের সামনেও নেই কেউ। অস্বাভাবিক লাগছে না?
তাই তো! বলল কোরি।
মুখ দেখে মনে হলো চিন্তায় পড়ে গেছে কিশোর।
দামী পাথরে তৈরি সিঁড়ি বেয়ে লাল দরজাটার কাছে উঠে গেল ওরা। ডাবল ডোর। বিশাল কাঠামো। দরজা খোলার চেষ্টা করল কোরি। খুলল না। বেল বাজাল শেষে।
বাড়ির ভেতরে ঘণ্টা বাজল কোনখানে।
দুই মিনিট অপেক্ষা করল কোরি। তারপর আবার বাজাল।
কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হলো পাল্লা। ফ্যাকাসে চেহারার এক প্রৌঢ়কে উঁকি দিতে দেখা গেল। উষ্কখুষ্ক চুল। বিরক্তমুখে ওদের দিকে তাকিয়ে খড়খড়ে শুকনো গলায় বলল, যাও এখন। হোটেল বন্ধ।
দরজাটা টেনে আবার লাগিয়ে দিল সে।
.
০৩.
চিন্তিত ভঙ্গিতে লাল দরজাটার দিকে তাকিয়ে রইল কিশোর।
রবিন বলল, ভুল হোটেলে চলে এলাম তো?
দরজার পাশে দেয়ালে গাঁথা ব্রোঞ্জের, চকচকে প্লেটটা দেখাল কিশোর। তাতে লেখা:
হোটেল নাইটশ্যাডো।
এসটাবলিশড ১৮৫৫
এক নামের দুটো হোটেল আছে তাহলে, বলল রবিন। চলো, আমাদেরটা খুঁজে বের করি।
হাত নেড়ে মুসা বলল, আরে নাহ, এত ছোট দ্বীপ। আর হোটেল তুলবে কোথায়? তা-ও আবার এক নামে দুটো। এটাই।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের সুটকেসে লাথি মারল কোরি, নাহ, কিছু বুঝতে পারছি না। কোন রকম ফাঁক রাখেননি আন্ট জোয়ালিন। ফোনে কয়েকবার করে কথা বলেছেন হোটেলের মালিকের সঙ্গে…
কিন্তু এখানে তো লোকই নেই, মুসা বলল। খালি হোটেল। বোর্ডার নেই। হোটেল বন্ধ। লোকটা ঠিকই বলেছে।
আর কি কর্কশ গলা লোকটার, নাক কুঁচকাল রবিন। আরেকটু ভাল করে বলতে পারল না?
আমার কি মনে হয় জানো? কোরি বলল। লোকটা নিশ্চয় মাটির নিচের ঘরে কোন দানব বানাচ্ছে। আজ রাতে প্রাণ সঞ্চার করবে ওটাতে। তাই কারও নাক গলানো পছন্দ করছে না।
চমকে গেল মুসা। খাইছে! ফ্রাঙ্কেনস্টাইন! লোকটাকে লাগলও কিন্তু ডক্টর
আরে দূর, থামো তো! হাত নেড়ে থামিয়ে দিল ওকে কিশোর। কিসের মধ্যে কি। জ্বালাবে তোমরা, বুঝতে পারছি।
ওদেরকে অবাক করে আবার হাঁ হয়ে গেল দরজাটা। লম্বা, সুদর্শন চেহারার একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। সাদা এলোমেলো চুল, সাদা গোফ। গায়ে সাদা সাফারি শার্ট, পরনে সাদা প্যান্ট। ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। চোখের কালো মণি দুটো ঝিলমিল করে উঠল তারার মত।
গুড ইভনিং, ভারী গমগমে কণ্ঠস্বর। হাসিটা মোছেনি মুখ থেকে। ওদের দিকে তাকিয়ে পরিচিত কাউকে খুঁজলেন যেন।
কথা বলতে গেল কোরি। ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন তিনি, আমার চাকর উলফের ব্যবহারে কিছু মনে কোরো না। তোমাদের বয়েসী ছেলেমেয়েদের ও পছন্দ করে না। কোরির দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের এখানে একা দেখে আমারও অবাক লাগছে। জোয়ালিন এল না? ওরও তো আসার কথা ছিল।
হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ল, জবাব দিল কোরি। শোরটাউনে– ছোটখালার বাড়িতে আছে। আমাদের চলে আসতে বলল। কাল শরীর ভাল হলে আন্টি আসবে। আপনাকে ফোন করে বলেনি কিছু?
ও, তুমি নিশ্চয় কোরি, কোরির প্রশ্নের জবাব দিলেন না তিনি। লম্বা একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে ওর হাতটা চেপে ধরে ঝাঁকালেন। চেহারায় অনেক মিল আছে।
থ্যাংক ইউ, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে কোনমতে হাতটা ছাড়িয়ে নিল কোরি।
এক্সকিউজ মী। আমিও তো উলফের মত অভদ্র হয়ে গেলাম দেখি। ঢুকতেই দিচ্ছি না তোমাদের, বলে তাড়াতাড়ি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি। নিজের পরিচয়টা দিয়েই ফেলি। আমি ব্যারন রোজার সাইমন ডি মেলবয়েস। মেলবয়েস দি থার্ড। এই হোটেলের মালিক।