কোথায় যাব? ফিসফিস করে জানতে চাইল মুসা।
লবির দরজার দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। মিলার বেরোন কিনা। দেখল।
বেরোলেন না।
কিশোরের হাত খামচে ধরল মুসা। সুড়ঙ্গটায় ঢুকে পড়লে কেমন হয়?
ঠিক! সমর্থন করল কিশোর। পুলিশ না আসাতক লুকিয়ে থাকতে পারব ওখানে।
পুলিশ! কোথায় ওরা? বিশ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে।
আমারও মনে হচ্ছে ওখানেই নিরাপদ, ভীতকণ্ঠে বলল রবিন।
অন্ধকারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এগোল ওরা। খুঁজে বের করল মঞ্চটা। ফিসফিস করে কিশোর বলল, ধরাধরি করে এমনভাবে সরাতে হবে, যাতে শব্দ না হয়…
ঘরের অন্যপ্রান্তে খসখস শব্দ হলো।
মিলার নাকি?
অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মঞ্চটা খুঁজতে শুরু করল কিশোরের চোখ। সয়ে এসেছে। আবছামত দেখতে পাচ্ছে চেয়ার-টেবিলগুলোর অবয়ব।
কেউ নেই।
মঞ্চটা সরাল ওরা। সতর্ক থাকার পরেও শব্দ হয়েই গেল। চুপচাপ দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল কেউ আসে কিনা। এল না। দরজাটা খুলল তখন।
সুড়ঙ্গের মধ্যে আরও বেশি গরম। বাতাসে আর্দ্রতা বেশি। আঠা হয়ে যায় শরীর। ছত্রাকের গন্ধ।
পিঠ চুলকাচ্ছে কিশোরের। দুই কাঁধ ব্যথা করছে। পায়ে তো ব্যথা আছেই। অন্ধকারে আঁকাবাকা সুড়ঙ্গে পাগলের মত দৌড় দেয়ার ইচ্ছেটা। অনেক কষ্টে রোধ করল। তাড়াতাড়ি ছুটে কোন লাভ নেই।
রবিনও বুঝতে পারছে সেটা। মনের ভাবনাটাকেই প্রকাশ করে ফেলল, লুকানো হয়তো যায়, কিন্তু পালাতে পারব না।
ওর কাঁধে হাত রাখল মুসা, ভয় পাচ্ছ?
তুমি পাচ্ছ না?
পাচ্ছি।
হাঁটো, কিশোর বলল। এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটাও ঠিক নয়।
বেশি দূরে যাওয়াটাও ঠিক হবে না, রবিন বলল। পুলিশ এলে শুনতে পাব না।…মুসা, টর্চটা জালো তো। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না।
কোমরে হাত দিয়েই বলে উঠল মুসা, যাহ, গেল!
কি?
আনতে মনে নেই। লবির টেবিলেই রয়ে গেছে।
দারুণ! মরণ বোধহয় আজ ঠেকাতে পারলাম না।
দৌড়ে গিয়ে ডাইনিং রূমের আলমারি থেকে খুঁজে নিয়ে আসব নাকি?
না, সময় নেই, বাধা দিল কিশোর। হাঁটতে থাকো।
এগিয়ে চলল ওরা। কান পেতে রেখেছে। মিলার পিছু নিলে যাতে শুনতে পায়। মুখে, মাথায় জড়িয়ে যাচ্ছে মাকড়সার জাল। হাত দিয়ে সরাতে গিয়ে জ্যান্ত মাকড়সা লাগছে হাতে। কিলবিল করে উঠে যাচ্ছে গায়ের ওপর। থাবা দিয়ে সরাতে গিয়ে একটাকে ভর্তা করে দিল মুসা। ভেজা চটচটে পদার্থ লেগে গেল হাতে। প্যান্টে ডলে মুছল হাতটা।
কতক্ষণ হাঁটল ওরা বলতে পারবে না। অন্ধকারে সময়ের হিসেব রাখা কঠিন। ঢালু হয়ে আসছে সুড়ঙ্গের মেঝে। আচমকা চেঁচিয়ে উঠল মুসা, খাইছে!
কি?
কি হয়েছে?
জানতে চাইল রবিন আর কিশোর।
দরজা!
কি করে বুঝলে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
এই তো, কাঠ। হাত দিলেই বোঝা যায়…নিশ্চয় ওই ঘরটা, যেটাতে মড়ার খুলি… ভয়ে কথাটা আর শেষ করল না মুসা।
কাছে সরে এল কিশোর। কই, দেখি?
ঠেলা দিতে খুলে গেল পাল্লা। ভেতরে ঢুকে পড়ল তিনজনে। দরজার পাশে দেয়ালে হাত রাখতে সুইচবোর্ডটা পেয়ে গেল কিশোর। আলো জ্বলল। ছাত থেকে ঝুলে থাকা মৃদু পাওয়ারের একটা বাল্ব।
ছোট ঘর। যে ঘরটাতে খুলি দেখেছিল, সেটা নয়। এটা অন্য ঘর। একটা বড় বিছানা আছে। একটা নাইটস্ট্যান্ড, দুই ড্রয়ারের ড্রেসার এবং একটা টেলিফোনও আছে।
আরেকবার ফোন করে দেখো না পুলিশকে, গলা থেকে মাকড়সার জাল টেনে সরাতে সরাতে বলল রবিন, ওরা লোক পাঠাল কিনা?
কথাটা মন্দ না। রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল কিশোর।
নীরব। ডায়াল টোন নেই।
ডেড, আনমনে বলল সে।
হু, আমাদের মত, বিড়বিড় করল মুসা। পার্থক্য শুধু এটা হয়ে গেছে, আমাদের হতে বাকি আছে…
কিশোরের দিকে তাকাল রবিন, এখানকার সব ফোনই কিন্তু একটা সুইচবোর্ডের ভেতর দিয়ে গেছে। মনে নেই সেদিন, গেট থেকে ফোন করার সময়…
ঝট করে রবিনের দিকে ফিরে তাকাল কিশোর। বড় বড় হয়ে গেছে। চোখ। তাই তো! ইস, কি বোকা আমি! সামনের অফিসে রয়েছে। সুইচবোর্ডটা।
তাতে কি হয়েছে? মুসার প্রশ্ন।
কি হয়েছে এখনও বুঝতে পারছ না? রিসিভারে আঙুলগুলো চেপে বসেছে কিশোরের। সমস্ত কল যায় সুইচবোর্ডের ভেতর দিয়ে। পাইরেট আইল্যান্ডে পুলিশকে যে ফোন করেছি সেটাও গেছে। রিসিভারটা ক্রেডলে রেখে দুর্বল ভঙ্গিতে বিছানায় বসে পড়ল সে।
অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছিল মিলার, রবিন বুঝে ফেলেছে। মুখ কালো হয়ে গেছে তারও। মুসার দিকে তাকাল, ওর মুখের রহস্যময় হাসিটা লক্ষ করোনি?
আমি করেছি, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল কিশোর, এতক্ষণে বুঝলাম পুলিশ এল না কেন। ওদের সঙ্গে কথাই বলতে পারিনি। বলেছি মিলারের সঙ্গে। কণ্ঠস্বরটা অমন ভোঁতা শোনাচ্ছিল কেন এখন পরিষ্কার। রিসিভারে রুমাল চেপে ধরে কথা বলছিল।
হু, পাগল হলেও বুদ্ধি ঠিক আছে ষোলোআনা, তিক্তকণ্ঠে বলল মুসা। ধপ করে কিশোরের পাশে বসে পড়ল সে। তারমানে আমাদের উদ্ধার। করতে আর আসছে না কেউ।
নাহ, দরজার দিকে তাকাল কিশোর। যা করার আমাদের নিজেদেরই করতে হবে এখন। ছাতের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, আন্ট জোয়ালিন!
কি?
আন্ট জোয়ালিনের কথা বলছি। কোরি যতবার ফোন করেছে, ততবার সুইচবোর্ডের কাছে বসে বোর্ডটা কন্ট্রোল করেছে মিলার। একটা কলও আন্ট জোয়ালিনের কাছে যেতে দেয়নি। সেজন্যেই মিস ভায়োলার বাড়িতে ফোন করে কোন জবাব পায়নি কোরি। আন্ট জোয়ালিন এখানে আসেন এটা চায়নি মিলার। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে খুশি হয়েছে। তার পার্টির ব্যাপারে নাক গলাতেন তিনি, ঝামেলা তো অবশ্যই করতেন…