ওদের দিকে রাইফেল ঘোরালেন মিলার।
পুলিশ কই? ভাবল কিশোর। এতক্ষণে তো পৌঁছে যাওয়ার কথা।
জিজ্ঞেসপনি আকাশটা যেন হাত টোকা।
ওরা না আসা পর্যন্ত ঠেকানো দরকার মিলারকে। কথা বলানো দরকার, যাতে গুলি করার কথা ভুলে থাকে।
রাইফেলের সিলিন্ডার চেক করলেন মিলার। সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, লোডেড।
এ সব করে পার পাবেন না আপনি! চিৎকার করে উঠল রবিন। নিজের কানেই বোকা বোকা লাগল কথাটা।
কিশোর বলল মিলারকে, ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করতে পারি তো আমরা, নাকি?
আড়চোখে মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল সে। দরজার দিকে ঘন ঘন। তাকাচ্ছে ওরা। পুলিশ আসে কিনা দেখছে বোধহয়। রবিনের চেহারা ফ্যাকাসে। ঠোঁটের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট মুছছে। মুসা। বার বার ঢোক গিলছে। হাত ঢোকানো প্যান্টের পকেটে।
আলোচনা? প্রশ্নটা যেন অবাক করেছে মিলারকে।
আপনি…আপনি সত্যি এখন গুলি করবেন আমাদের? কোনমতে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
রাইফেল নামালেন মিলার। না… বিড়বিড় করে কি বললেন আরও, বোঝা গেল না। টান মেরে শার্টের কয়েকটা বোতাম ছিড়লেন। রাইফেলটা মাটিতে নামিয়ে তাতে ভর দিলেন। আরেক হাতে খোলা বুক চুলকালেন। একমাত্র ভাল চোখটা কিশোরের ওপর নিবদ্ধ।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। স্বস্তির। রবিনের চেহারা থেকেও দুশ্চিন্তা কমে গেল। গুলি করবেন না বলেছেন মিলার।
কিন্তু কিশোর স্বস্তি পেল না। এই পাগলের কথায় বিশ্বাস নেই। গুলি করবেন না?
মাথা নাড়লেন মিলার। লবিতে চোখ বোলালেন। রোজার গেল কই?
রোজার? জবাব দিল না কিশোর। তাকিয়ে আছে মিলারের মুখের দিকে। আশ্চর্য! ভাইকে গুলি করে মারার কথাটা বেমালুম ভুলে গেলেন নাকি? পাগল তো। যেতেই পারেন। মনে করাল না সে। আলোচনা চলুক। সময় নষ্ট হোক। ততক্ষণে পুলিশ চলে আসবে।
কোথায় ও? রাগত কণ্ঠে জানতে চাইলেন মিলার। আমার এই ভাইটাকে কোনদিন আর পার্টি পছন্দ করাতে পারলাম না। স্পোর্টস ও একদম বোঝে না।
শিকার পছন্দ করেন না নাকি তিনি?
বোঝে না, এটাই হলো কথা। সেজন্যেই আজ পার্টি শুরুর আগেই ওকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি চাইনি বাধা দিয়ে আমার সমস্ত মজা। নষ্ট করুক।
নাহ, বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন মিলার। গুলি করার পর বলেছিলেন রোজার মরে গেছে, এখন বলছেন সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বুক কাঁপছে কিশোরের। এই পাগলকে বিশ্বাস করে কে! বলছেন বটে ওদেরকে বেরোতে দেবেন, কিন্তু যদি না দেন? অকারণেই খেপে গিয়ে এখনই গুলি শুরু করেন? বাইরে বেরোনোর ছুতো খুঁজতে লাগল সে। বলল, চলুন না সবাই মিলে তাকে খুঁজে বের করি। আমরা কি দেখব গিয়ে? মুসা আর রবিনের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কিশোর, ওরা ওর চালাকিটা ধরতে পেরেছে। কিনা।
যাবে কোথায় ও, ঠিকই ফিরে আসবে, তিক্তকণ্ঠে বললেন মিলার। জঘন্য হয়ে উঠেছে মুখের ভঙ্গি। ওকে সরানোর কত চেষ্টাই না করলাম। কিন্তু ঠিকই বেঁচে যায়। ফিরে ফিরে আসে।
আমাদের কি বেরোতে দেবেন? মুসা জিজ্ঞেস করল। কিশোরের পেছনে দাঁড়িয়ে একটা হাত রাখল ওর কাঁধে হাতটা বরফের মত শীতল।
হ্যাঁ।
সত্যি দেবেন? বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর।
হ্যাঁ, হাসি ফুটল মিলারের মুখে।
হঠাৎ যেন শরীরটা পালকের মত হালকা হয়ে গেল কিশোরের। মনে হলো শূন্যে ভাসতে শুরু করেছে। ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে হোটেল থেকে দূরে, দ্বীপ পেরিয়ে, সাগর পেরিয়ে…
একঘন্টা আগে বেরোতে দেব তোমাদের, হাসছেন মিলার।
ওপর থেকে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল যেন কিশোর। কি করবেন?
এক ঘণ্টা সময় দেব, ঘড়ি দেখলেন মিলার। তারপর তোমাদের পিছু নেব। আলফ্রেড হিচককের বইতে সেই গল্পটা পড়োনি? দা মোস্ট ডেঞ্জারাস গেম?
কিন্তু…আ-আ-আপনি…
শিকারের এটাই আনন্দ। শিকারকে সুযোগ দেয়া। এ ধরনের স্পোর্টস খুব ভাল লাগে আমার।
দরজার দিকে তাকাল কিশোর। পুলিশ আসছে না কেন এখনও?
কথা বলার আর সময় নেই, ঘড়ি দেখলেন আবার মিলার। মুখ তুলেই চিৎকার করে উঠলেন, রেডি, গো! খেলা শুরু!
মিলার..প্লীজ… হাত তুলল কিশোর।
মুসার ঠাণ্ডা হাতটা এখনও খামচে ধরে আছে তার কাধ।
রবিন পাথর।
গুলি করবেন না, প্লীজ! আবার অনুরোধ করল কিশোর।
ভয়ানক রাগে লাল হয়ে গেল মিলারের মুখ। ঝটকা দিয়ে রাইফেল তুলে বাট ঠেকালেন কাঁধে। দেয়াল সই করে ট্রিগার টিপে দিলেন। দুবার। বদ্ধ জায়গায় কামানের গর্জনের মত শব্দ হলো।
চিৎকার করে উঠল রবিন।
যাও; বেরোও! তার চিৎকার ছাপিয়ে শোনা গেল মিলারের গলা। খেলা শুরু! তাকিয়ে আছেন রাইফেলের নলের দিকে। দুটো নলের মুখ দিয়েই ধোয়া বেরোচ্ছে।
হিংস্র লোকটার সামনে থাকার সাহস হলো না, আর গোয়েন্দাদের। দৌড় দিল দরজার দিকে।
.
২০.
আবার ছোটার পালা। কিন্তু যাবে কোনদিকে?
লবি থেকে বেরিয়ে অন্ধকার ডাইনিং রূমে ঢুকল ওরা। চোখ মিটমিট করে দৃষ্টির সামনে থেকে অন্ধকার দূর করতে চাইল কিশোর। বদ্ধ, ভাপসা, ভারী বাতাসে দম আটকে আসতে চাইছে।
ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল তিনজনে। বড় জানালাটা দিয়ে আকাশ চোখে পড়ছে। রাতের আকাশ, কিন্তু তারা নেই। মেঘে ঢাকা। ঘর আর বাইরে অন্ধকারের কোন তফাৎ নেই।
বাইরে চলে যাবে? বনে ঢুকে পড়বে আবার? বনই হলো তাড়া খাওয়া জানোয়ারের আশ্রয়স্থল।