বিশ মিনিট। বা তারও কম।
এই সময়টুকু উলফ আর মিলারের কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে পারলেই বেঁচে যাব, মুসার কণ্ঠে স্বস্তি। চলো, লুকিয়ে পড়ি।
কোথায় লুকাব? রবিনের প্রশ্ন।
কেউ কোন জবাব দেয়ার আগেই দপ করে জ্বলে উঠল লবির লাইট। অফিসের খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল একজন মানুষকে।
খাইছে! হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা। দৌড়ানো দেয়ার কথাও ভুলে গেছে।
.
১৮.
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন রোজার মেলবয়েস। পরনে, সেই সাদা স্যুট। গলায় লাল রুমাল জড়ানো। উজ্জ্বল আলোর দিকে মুখ করে চোখ মিটমিট করছেন। দ্বিধায় পড়ে গেছেন মনে হলো।
কয়েক সেকেন্ড কেউ কোন কথা বলল না। তারপর চিৎকার করে উঠল রবিন, মিস্টার মেলবয়েস! আপনি বেঁচে আছেন।
কি বলছ? এগিয়ে এসে ডেস্কের ধার খামচে ধরলেন তিনি। অবাক হয়েছেন। বেঁচে আছি মানে?
হুড়াহুড়ি করে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। খুব খুশি হয়েছে। এই দ্বীপে একমাত্র তিনিই ওদের বন্ধু।
সাদা গোফের কোণ টানতে টানতে বললেন তিনি, তোমাদের এখানে দেখতে পাব ভাবিনি।
আমরাও ভাবিনি আপনাকে দেখব, রবিন বলল। আপনি ঠিক আছেন তো?
আছি, প্রশ্নটাও যেন অবাক করল তাঁকে। না থাকার কি কোন কারণ আছে? এখানে হচ্ছেটা কি?
এখানে… বলতে যাচ্ছিল রবিন।
কিন্তু বাধা দিয়ে বললেন রোজার, এত রাতে তোমরা এখানে কেন? ঘরে কি হয়েছে? চেহারার এই অবস্থা কেন! ভিজে চুপচুপে, সারা গায়ে কাদামাটি– •এখানে করছটা কি তোমরা?
আপনি আমাদের সাহায্য করুন, তাড়াতাড়ি বলল রবিন। পুলিশকে ফোন করেছি আমরা…
সতর্ক হয়ে উঠল ব্যারনের চোখজোড়া। পুলিশ?
উলফ আর আপনার ভাই মিলার…
কোথায় ওরা?
কোরিকেও পাওয়া যাচ্ছে না, মুসা বলল। মিলার আর উলফ রাইফেল নিয়ে তাড়া করেছে আমাদের। বনের মধ্যে গুলিও করেছিল।
দ্বিধান্বিত ভাবটা অনেক কমল। গাল ডললেন ব্যারন। রবিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, নিশ্চয় আরেকটা হান্টিং পার্টি?
হ্যাঁ। তাই তো বললেন মিস্টার মিলার, রবিন বলল। আপনি আমাদের বাঁচান। থামান ওদের।
থামাব? অদ্ভুত হাসি খেলে গেল ব্যারনের মুখে। পিছিয়ে গেলেন এক পা। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বললেন, থামাব?
হ্যাঁ। আমাদের খুন করতে চায় ওরা। একমাত্র আপনিই আমাদের বাঁচাতে পারেন…
থেমে গেল রবিন। বদলে যাচ্ছে ব্যারনের চেহারার ভাব। হাসিটা। বাড়ছে। হাসছেন কেন ওরকম করে? ওই অদ্ভুত হাসি মুখটা বিকৃত করে দিয়েছে। চেহারাটাও কেমন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।
মুসাও তাজ্জব হয়ে গেছে। বেঁচে আছেন তো রোজার? না মরে ভূত হয়ে গেছে।
জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার কি অসুস্থ লাগছে, ব্যারন?
চমৎকার কথা বলেছ–ওদের থামান! থামান ওদের! হাহহাহহাহ! পাগলের মত হেসে উঠলেন রোজার।
আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। আপনি বসুন।
এমন করছেন কেন? ব্যারনের এই পরিবর্তন দেখে রবিনও অবাক। কি যে হলো: আজকের রাতটাই যেন কেমন…
ওদের থামাব? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ব্যারন, কেন থামাব? মাথার চুল খামচি দিয়ে ধরে টানতে শুরু করলেন। হ্যাঁচকা টানে গলা থেকে রুমালটা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। কোটের বোতাম খুলে ফেললেন।
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল রবিন। ব্যারন! কি হয়েছে আপনার? অমন করছেন কেন?
কথাটা কানেই তুললেন না ব্যারন। কোট খুলে ছুঁড়ে ফেললেন ডেস্কে। দুই হাতে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালেন ডেস্কের ওপর। কয়েক সেকেন্ড ওভাবে থেকে প্যান্টের পকেট হাতড়াতে শুরু করলেন। বের করে আনলেন একটুকরো কালো কাপড়। চোখে বাঁধার সেই কাপড়টা। বেঁধে দিলেন চোখের ওপর। এলোমেলো করে দিলেন মাথার সমস্ত চুল। মিলারের কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, হান্টিং পার্টি! হান্টিং পার্টি! কোন কিছুর বিনিময়েই পার্টি আমি বন্ধ করব না।
পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। পায়ে শেকড় গজিয়ে গেছে। যেন। স্তব্ধ বিস্ময়ে বোবা হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের পরিবর্তিত মানুষটার দিকে।
বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোরের, এই লোক রোজার নন, তার ভাই মিলার। কোন কারণে রোজার সেজেছিলেন। হয়তো ওদের বোকা বানানোর জন্যেই।
.
১৯.
হান্টিং পার্টি বন্ধ করব? ভয়ঙ্কর মূর্তি নিয়ে ওদের মুখোমুখি হয়েছেন এখন মিলার। রোজারের ভদ্র, সৌজন্যে ভরা চেহারা উধাও হয়েছে, সেই জায়গায় বেরিয়ে এসেছে মিলারের বন্য, হিংস্র মুখ। পেছনে মাথা হেলিয়ে অট্টহাসি হেসে ওদের দিকে এক পা এগিয়ে এলেন। তোমরা আমাকে হান্টিং পার্টি বন্ধ করতে বলছ?
মিস্টার রোজার মানে, মিলার-প্লীজ! অনুরোধ করল কিশোর।
গটমট করে একটা চেয়ারের কাছে হেঁটে চলে গেলেন মিলার। ঠেস দিয়ে রাখা রাইফেলটা তুলে নিলেন। তার দিকে তাকিয়ে ছিল বলে এতক্ষণ চোখে পড়েনি ওদের।
রাইফেলটা চোখের সামনে এনে দেখতে লাগলেন মিলার। পানি মুছলেন ব্যাট থেকে।
এদিক ওদিক তাকাল কিলোর। পালানোর পথ নেই। ডাইনিং রূমে যাওয়ার দরজাটা খোলা। কিন্তু ওটা দিয়ে বেরোতে হলে মিলারের পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। আর তা করতে গেলে দরজার কাছে যাওয়ার আগেই গুলি খাবে।
ইস, গাধার মত ইচ্ছে করে এসে ধরা দিলাম ভাবল সে। মরার জন্যে। এবার আর মুক্তি নেই। মিলারের হান্টিং পার্টি শেষ হওয়ার পথে।
চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল ট্রফি রূমের দেয়ালে বসানো চারটে নরমুণ্ড। আরও তিনটে যোগ হবে ওগুলোর সঙ্গে। ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা মন থেকে দূর করার জন্যে ঘনঘন মাথা নাড়তে লাগল সে।