কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। হাঁটু ভাজ হচ্ছে না আর। গোড়ালির ওপরের মাংসে খিচধরা ভাবটাও কমেছে। পা বাড়াল আবার।
কি, অসুবিধে হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর, না। চলো।
যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে হোটেলের পেছন দিকে চলে এল ওরা। সামনে একচিলতে বালিতে ঢাকা জমি পেরোলে গিয়ে পড়বে ঘাসের মধ্যে। তারপর ঢাল বেয়ে উঠতে হবে।
জমিটা পেরোল ওরা। সামনে পাহাড়ের মত উঁচু বালির ঢিবির দিকে তাকিয়ে দমে গেল কিশোরের মন। বেয়ে ওঠা বড় কঠিন আর ভীষণ পরিশ্রমের কাজ।
কিন্তু উঠতেই হবে।
ওঠার পর কি দেখবে? মিলার কি কোনভাবে আন্দাজ করে ফেলেছেন। ওরা হোটেলে ফিরে যাচ্ছে? সেখানে গুলিভরা রাইফেল নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছেন? অন্ধকারে ওদের যাতে কায়দামত পেতে পারে, সেই সুযোগের জন্যেই কি সব আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে?
উলফ কোথায়? হান্টিং পার্টিতে যোগ দিয়েছে কি সে-ও?
এমনও হতে পারে মিলার যখন বনের মধ্যে ওদের তাড়া করে ফিরছেন, হোটেলে তখন রাইফেল হাতে ঘাপটি মেরে বসে আছে উলফ। ওদের ঢুকতে দেখলেই দেবে গুলি মেরে।
ভাবনাটা অস্থির করে তুলল কিশোরকে। বলল, ছড়িয়ে পড়ো। রাইফেল হাতে উলফ কিংবা মিলারকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে যে যেদিকে পারো। ঝেড়ে দৌড় মারবে। নিশানা করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাবে তাহলে ওরা।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল ওরা। মাথা নিচু করে, পিঠ বাঁকিয়ে উঠতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। পেছন থেকে গায়ে এসে লাগছে বাতাস।
পেছনের আঙিনায় উঠে এল কিশোর। পুল হাউজের দরজাটা খোলা। তবে আলো নেভানো। সারা বাড়ির সমস্ত আলো নেভানো।
অন্ধকারে শিকার করতেই ভালবাসেন বোধহয় মিলার।
কাছেই একটা জোরাল শব্দ হলো। গুলির শব্দ ভেবে আরেকটু হলে চিৎকার করে উঠেছিল কিশোর। বুকের মধ্যে এত জোরে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা, মনে হচ্ছে পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসবে। মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে সব যেন সাদা হয়ে গেল। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে।
বুঝতে পারল কিসের শব্দ। একটা ধাতব ডেকচেয়ার সিমেন্টে বাধানো চত্বরে উল্টে ফেলেছে বাতাস।
শব্দটা রবিন আর মুসার কানেও গেছে। ওরা দুজনও যে যেখানে ছিল দাঁড়িয়ে গেছে পাথর হয়ে। কান পেতে আছে। মিলারের কানেও কি গেছে চেয়ার পড়ার শব্দ? ভাবছেন ওরাই ফেলেছে? তাহলে খুজতে চলে আসবেন। এদিকে।
অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।
এলোমেলো দমকা বাতাসে আরেকটা চেয়ার উল্টে পড়ল।
হোটেলের দিকে কোন নড়াচড়া নেই। রাইফেল হাতে এগিয়ে এলেন না মিলার।
চলো, ফিসফিস করে বলল কিশোর।
লম্বা দম নিয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়াল সে।
মিনিটখানেকের মধ্যেই অন্ধকার ডাইনিং রূমে ঢুকে পড়ল ওরা। বদ্ধ বলে বাইরের চেয়ে এখানে গরম কম। নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে এল মিস্ত্রিদের মঞ্চটার। লবির ডাবল ডোরটার দিকে এগোল।
কেউ নেই, লবিতে উঁকি দিয়ে কিশোরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল রবিন।
দুজনেই বোধহয় বনে চলে গেছে, অনুমান করল মুসা।
গেলেই ভাল, বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর।
দেয়াল ঘেঁষে থেকে লবির দিকে এগোল ওরা।
সামনের ডেস্কে যে ফোনটা আছে, রবিন বলল, সেটাই ব্যবহার করতে পারব আমরা।
লবিতে ঢুকে টেলিফোনের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।
রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল মুসা। ডায়াল টোন নেই, হতাশ ভঙ্গিতে রিসিভারটা ধরিয়ে দিল কিশোরের হাতে। দেখো।
সর্বনাশ! ফিসফিস করে কথা বলার কথা ভুলে গিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল রবিন। ফোন খারাপ হলে করবটা কি?
রিসিভার কানে চেপে ধরে বার কয়েক ক্রেডল খটখট করল কিশোর। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, টোন এসেছে!
জলদি করো! উত্তেজনায় কিশোরের কাঁধ খামচে ধরল মুসা।
নম্বর দেখব কি করে? অন্ধকারে তো কিছু দেখা যাচ্ছে না…
কোমরে ঝোলানো টর্চটা খুলে নিল মুসা। আলো ফেলল সেটের ওপর। করো।
নম্বরও তো জানি না। রবিন, জলদি গাইড দেখো।
নম্বর বলল রবিন।
বোতামগুলো দ্রুত টিপে দিয়ে মুসাকে বলল কিশোর, লাইট নেভাও।
অপারেটর, অন্যপাশ থেকে কিশোরের কানে ভেসে এল একটা নাকি কণ্ঠ।
পাইরেট আইল্যান্ড পুলিশকে দিন, প্লীজ!
জরুরী? সন্দেহ ফুটল নাকি কণ্ঠটায়।
হ্যাঁ। প্লীজ, তাড়াতাড়ি করুন।
এক মিনিট।
অন্যপাশে খটাখট শব্দ হচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে হোটেলে ঢোকার দরজার দিকে তাকাল কিশোর। মিলারকে ঢুকতে দেখলেই ঝট করে বসে পড়বে ডেস্কের আড়ালে।
অনেক সময়, যেন দীর্ঘ এক যুগ পর কানে বেজে উঠল একটা ভোতা গলা, পুলিশ! কণ্ঠটা এমন কেন? যেন মাউথপিসে রুমাল চাপা দিয়ে কথা বলছে।
ভাবার সময় নেই। তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, অ্যাঁ!…হালো, আমাদের সাহায্য দরকার। এখুনি।
শান্ত হোন। কি সাহায্য?
কয়েকজন লোক পাঠান এখানে। ফাঁদে ফেলে আমাদের খুন করার চেষ্টা চলছে…
কোনখান থেকে বলছেন?
আঁ?..নাইট শ্যাডো…গোস্ট আইল্যান্ড। প্লীজ, এখুনি পাঠান। সাংঘাতিক বিপদে রয়েছি আমরা। ও আমাদেরকে খুন করতে চাইছে।
নাইট শ্যাডো? ওপাশে মনে হয় নামটা লিখে নিচ্ছে পুলিশ।
বড় বেশি ধীরে কাজ করছে মনে হলো কিশোরের। বলল, তাড়াতাড়ি করুন, প্লীজ।
শান্ত হোন। বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব আমরা। আরও কমও লাগতে পারে।
কট করে কেটে গেল লাইন।
ওরা আসছে, দুই সহকারীকে জানাল কিশোর।
কতক্ষণ লাগবে? জানতে চাইল রবিন।