উপায় এখন একটাই, কিশোর বলল, রিস্ক নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি পারি গিয়ে হোটেলে ঢুকে ফোন করে আবার পালাব। ওরা না আসা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকব কোথাও।
কোথায়?
জানি না, অধৈর্য শোনাল কিশোরের কণ্ঠ, হোটেলের ভেতরই কোনখানে।
বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকাটা বরং নিরাপদ।
কতক্ষণ? মুসার প্রশ্ন।
হোটলের মধ্যেও বেশিক্ষণ লুকিয়ে বাঁচতে পারব না আমরা, মুসার। কথার পিঠে বলল কিশোর। ওরা আমাদের খুঁজে বের করবেই। যে ভাবেই হোক বাঁচার একটা বুদ্ধি বের করতে হবে। আরেকটা কথা ভুলে গেলে চলবে, না, কোরিকে খুঁজে পাইনি আমরা এখনও। হোটেলে গিয়ে কোনমতে আগে একটা ফোন যদি করতে পারি, পরের ভাবনা পরে ভাবব।
আরও কয়েক সেকেন্ড আলোচনার পর রওনা হলো ওরা। কিশোর বলল, রাস্তা থেকে সরো। যতটা সম্ভব গাছপালার আড়ালে থেকে এগোব…
কথা শেষ হলো না তার। বাতাসে ঝরে পড়ল পানির ফোঁটা। পরক্ষণে শোনা গেল গুলির শব্দ।
চমকে মুখ তুলে তাকাল সবাই। সামনে দুটো গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন মিলার। রাইফেলটা ওদের দিকে তাক করা। গুলি করেছেন ওদের লক্ষ্য করেই।
.
১৭.
আবার গুলি করলেন মিলার।
বিকট শব্দ গাছের গায়ে বাড়ি খেয়ে খেয়ে ফিরল দীর্ঘ সময় ধরে। মনে হলো যেন চতুর্দিক থেকে গুলি চলছে।
বুকে কিংবা মাথায় গুলি লাগার অপেক্ষায় ছিল কিশোর। লাগল না দেখে মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল। কার গায়ে লেগেছে? ওরাও কেউ আর্তনাদ করল না। দেরি না করে প্রায় ডাইভ দিয়ে লুকাল এসে একটা গাছের। আড়ালে। উপুড় হয়ে পড়ায় হাঁটুতে ব্যথা পেল।
হামাগুড়ি দিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়ল তিনজনেই। এখানে। থাকলেও বাঁচতে পারবে না। নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ঝোপের অন্যপাশে। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল। দুহাতে গাছের ডাল সরাতে সরাতে ছুট লাগাল প্রাণপণে।
আবার শোনা গেল গুলির শব্দ।
খুব কাছে থেকে।
তারপর শোনা গেল কুৎসিত, কর্কশ হাসি। খুব মজা পাচ্ছেন উন্মাদ মিলার।
একটা বিখ্যাত গল্পের কথা মনে পড়ল রবিনের–দা মোস্ট ডেঞ্জারাস গেম! লেখকের নামটা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ঝড়ের মধ্যে জাহাজডুবী হয়ে বনে ছাওয়া এক দ্বীপে উঠতে বাধ্য হয় এক নাবিক। দুর্গের মত এক পুরানো বাড়িতে ওঠে রাতের আশ্রয়ের জন্যে। প্রথমে খুব খাতিরযত্ন করে তাকে বাড়ির মালিক। তারপর হাতে একটা অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে বলে পালিয়ে যেতে। রাইফেল আর শিকারী কুকুর হাতে নাবিকের পিছু নেয় সে, খুন করার জন্যে। রাতের অন্ধকারে তাড়া খেয়ে ভীত জানোয়ারের মত বনের মধ্যে প্রাণভয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে বেচারা নাবিক…অবিকল সেই গল্পের নকল চলছে এখন, ওদের ওপর। ওই ভয়ঙ্কর গল্প পড়েই কি হান্টিং পাটির উদ্ভট আইডিয়া মাথায় এসেছে মিলারের?
আতঙ্কে মাথা গরম হয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো ওর। মনে হচ্ছে বাস্তবে ঘটছে না এই ঘটনা। সামনে পথজুড়ে থাকা ঝোপঝাড়, পিচ্ছিল ভেজা মাটি, চাঁদের আলোয় বিকৃত দেখানো ওই যে পাতাগুলো, কোনটাই বাস্তব নয়। রাইফেলের শব্দ, গুলি ফোঁটার পর প্রতিধ্বনি, সবই ঘটছে যেন ভয়াবহ কোন দুঃস্বপ্নে।
শিকারের উত্তেজনায় হেসে ওঠা মিলারের ওই শিকারী-হাসিও অবাস্তব।
কিশোরের চিৎকারে বাস্তবে ফিরে এল সে। কিশোর বলছে, অ্যাই দেখো, কোথায় বেরিয়েছি আমরা।
সাগরের কিনারে চলে এসেছে ওরা। ঝোড়ো বাতাসে ফুঁসে ওঠা বড় বড় ঢেউ চাঁদের আলোয় রূপালী হয়ে ভীমবেগে এসে আছড়ে পড়ছে নীলচে-সাদা বালিয়াড়িতে।
থমকে দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। সমতল, সরু এখানে সৈকত। কোথাও একটা বালির ঢিপিও নেই যে তার আড়ালে লুকাতে পারবে।
এখানে থাকা যাবে না, কিশোর বলল।
হ্যাঁ, একেবারেই খোলা, মুসা বলল।
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে মিলারের আসার অপেক্ষা করছে ওরা। কান পেতে আছে গুলির শব্দের জন্যে। কার গায়ে বুলেট লাগবে প্রথমে কে জানে!
যাব কোথায়? কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে রবিনের। মোছার চেষ্টা করল না আর। চুলে আটকে আছে ভেজা পাতা। সেটাও সরাল না।
হোটেলেই ফিরে যাব, বলল কিশোর। বাঁচার এটাই একমাত্র উপায়।
সে-ই ভাল, মুসা বলল। এখানে থাকলে ডানাভাঙা হাঁসের মত গুলি করে মারবে।
শব্দ কিসের? শোনার জন্যে ঘাড় কাত করল রবিন।
মূসা আর কিশোরও কান পাতল।
তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একটানা গুমগুম ছাড়া আর কোন শব্দ কানে ঢুকল না।
রাইফেলের গুলি হলো না আর। প্রতিধ্বনি নেই।
গাছের আড়াল থেকে ভেসে এল না উন্মাদের অট্টহাসি।
দাঁড়িয়ে থাকলে সময় নষ্ট। কিশোর বলল, চলো।
ফিরে এসে আবার বনে ঢুকল ওরা। সাবধান রইল আগের বার যেখান দিয়ে চলেছিল সেখানে যাতে আর না যায়। রাস্তায় উঠল না। গাছের আড়ালে আড়ালে খুব সাবধানে, নিঃশব্দে এগিয়ে চলল বাষ্প ওঠা গরম বনের ভেতর দিয়ে।
ভীত জানোয়ারের মত–ভাবল কিশোর। পা কাঁপতে শুরু করল হঠাৎ। ক্লান্তি, নাকি ভয়ে কাহিল হয়ে গেছে, বুঝতে পারল না। ভাঁজ হয়ে এল হাটু। বসে পড়ল ভেজা মাটিতে।
এগিয়ে এল মুসা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কি হলো?
না, কিছু না। পা দুটো চলতে চাইছে না আর। বেশি সাঁতরালে যেমন মাংসপেশীতে খিচ ধরে যায়, তেমন।
হু। জিরিয়ে নাও খানিক। ঠিক হয়ে যাবে।
শান্তিতে বসারও উপায় নেই। কোনদিক দিয়ে বেরিয়ে চলে আসবেন মিলার, বোঝা যাচ্ছে না। তবু হাঁটতে যখন পারছে না, না বসে উপায় কি?