বুঝে ফেলল কিশোর। মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে নেমে গেল ঠাণ্ডা শিহরণ। কল্পনায় ভেসে উঠল ট্রফি রূমের চারটে নরমুণ্ড।
কি করতে চাইছেন মিলার, মুসা আর রবিনও বুঝেছে। তাঁর হাতে হান্টিং রাইফেল। তিনি শিকারী, ওরা শিকার।
পাগল! উন্মাদ হয়ে গেছেন আপনি! কথাগুলো যেন বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এল কিশোরের মুখ থেকে।
ঝট করে রাইফেলটা তুলে নিলেন মিলার।
সরে যাওয়ার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু লুকানোর জায়গা দেখতে পেল না।
আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি তোমার! রেগে গেছেন মিলার। তোমাকে এলাম পার্টিতে দাওয়াত করতে, আর তুমি করছ আমাকে অপমান!
পার্টির দরকার নেই, অনুরোধ করে বলল মুসা, বেরোতে দিন আমাদের।
আমাকে পাগল বলছ কেন? আমি কি পাগল? রাইফেলটা আরও উঁচু করে ধরলেন মিলার। কিশোরকে নিশানা করলেন। দুপা আগে বাড়লেন আরও
মরিয়া হয়ে উঠল কিশোর। কোন রকম চিন্তাভাবনা না করে ছুটে গেল সামনের দিকে। একথাবায় সরিয়ে দিল নলের মুখ।
গুলি ফুটল বিকট শব্দে।
চিৎকার করে উঠলেন মিলার। রাইফেলের ধাক্কা এবং সেই সঙ্গে কিশোরের হাতের ঠেলা লেগে পেছনে উল্টে পড়ে গেলেন। একটা টেবিলের কোণায় বাড়ি খেল মাথা।
তার ওঠার অপেক্ষা করল না আর তিন গোয়েন্দা। ব্যাগগুলো যেখানে রেখেছিল সেখানেই রইল। খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল ওরা। মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে।
১৬.
এদিক দিয়ে! চিৎকার করে বলল মুসা।
সেদিকে ছুটল কিশোর। ভেজা মাটিতে জুতো পিছলে যাচ্ছে। মুসার পেছন পেছন বনে ঢুকে পড়ল। ফিরে তাকাল। ওর ঠিক পেছনেই রয়েছে রবিন। গাছপালার ফাঁক দিয়ে পুলহাউজটা দেখা যাচ্ছে। এখনও বেরোয়নি মিলার।
থামল না ওরা। যতটা সম্ভব দূরে সরে যাওয়া দরকার। বনের ভেতরের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটছে বৃষ্টি কমেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে এখন। কিন্তু। বাতাসে পাতা নড়লেই ঝরঝব করে বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে গায়ে।
চাঁদের ওপর থেকে সরে গেল মেঘ। গাছের মাথার ওপর দেখা গেল ফ্যাকাসে চাঁদ। ভূতুড়ে রূপালী করে তুলল বনভূমিকে। ভেজা পাতাগুলোকে কেমন বিকৃত দেখাচ্ছে। মাটি থেকে হালকা ধোয়ার মত উঠছে গরম বাষ্প।
যাচ্ছি কোথায়? জিজ্ঞেস করল রবিন।
কথা বোলো না, জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর, ছুটতে থাকো। কপালে ডালের বাড়ি খেয়ে আঁউক করে উঠল। ব্যথাটা এতই তীব্র, দাঁড়িয়ে গেল নিজের অজান্তে। ডলতে শুরু করল কপাল।
একঝলক দমকা বাতাস আবার পানির ফোঁটা ফেলল গায়ে। সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল।
বনের ভেতর আরও খানিকক্ষণ দৌড়াল ওরা। পথ শেষ হয়ে গেল হঠাৎ। সামনে যেন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে পথরোধ করে দিল কাটাঝোপ।
যাচ্ছি কোথায় আমরা? আবার জিজ্ঞেস করল রবিন। এভাবে দৌড়ে লাভটা কি?
বড় একটা গাছের নিচে দাঁড়াল ওরা। মাটি এখানে অনেকটাই শুকনো। গাছের পাতা এত ঘন, বৃষ্টির পানি নিচে পড়তে বাধা পেয়েছে।
দমকা বাতাস বয়ে গেল। জোরো রোগীর মত কাঁপিয়ে দিয়ে গেল গাছের পাতা।
পাগলটা কি আসবে নাকি? গাছের গায়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল রবিন।
কান পেতে আছে তিনজনেই। কোন শব্দ নেই, শুধু বাতাসের ফিসফাস আর ওদের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া।
জানোয়ারের মত খুঁজে বের করে আমাদের খুন করবে সে, কিশোর বলল। দেয়ালের চারটে নরমুণ্ড আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর। আগের বছরের হান্টিং পার্টিতে ওদেরকেও নিশ্চয় এভাবেই দ্বীপময় তাড়িয়ে নিয়ে খুন করেছেন মিলার।
আসলেই এ ভাবে দৌড়াদৌড়ি করার কোন মানে হয় না, শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে বাড়ি লাগা জায়গাটায় ব্যথা পেল কিশোর। কেয়ার করল না। একটা প্ল্যান দরকার আমাদের।
এ দ্বীপ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, রবিন বলল। পেছনে তাকিয়ে দেখল মিলার আসছেন কিনা।
সে চেষ্টা তো ইতিমধ্যেই করেছি, হাতে বসা একটা মশাকে থাপ্পড় মারল কিশোর। নৌকা ছাড়া যাব কি নিয়ে?
গাছের বাকল দিয়ে বানিয়ে নিতে পারি, মুসা বলল, আমাজানের ইনডিয়ানদের মত।
হাত নেড়ে ওর কথাটা উড়িয়ে দিল কিশোর, ফ্যান্টাসি বাদ দাও এখন। গাছ কাটবে কি দিয়ে? বাধবে কি দিয়ে? কাটার শব্দ শুনে মিলার চলে আসবে না? তা ছাড়া অত সময় কই?
চুপ হয়ে গেল মুসা। ভাবতে লাগল তিনজনেই। বৃষ্টি এখন পুরোপুরি থেমে গেছে।
রবিন বলে উঠল, পাইরেট আইল্যান্ডের পুলিশকে একটা ফোন করা। গেলেই হত …
ফোনগুলো রয়েছে সব হোটেলে। চাপড় মেরে আরেকটা মশা তাড়াল কিশোর।
তাহলে ওখানেই যাওয়া উচিত আমাদের, মুসা বলল।
পাগল নাকি! ওর কথাটা নাকচ করে দিল রবিন।
ও ঠিকই বলেছে, মুসার সঙ্গে একমত হলো কিশোর। চুপি চুপি হোটেলে ঢুকে পুলিশকে ফোন করব।
কিন্তু উলফ আর মার্টিন যদি…
আমরা হোটেলে ঢোকার সাহস করব এটা এখন কল্পনাও করবে না ওরা। চটাস করে বাহুতে চাপড় মারল মুসা, শালার মশা!
কল্পনা করবে না এটা বলা যায় না, গাল থেকে টিপে একটা মশা মারল কিশোর। উলফ নিশ্চয় জানে না আমরা কোথায় আছি। রান্নাঘর কিংবা ডাইনিং রূমেই হয়তো এখন বসে আছে সে।
দুজনেই বন্দুক নিয়ে তেড়ে আসবে না তো আমাদের? কেঁপে উঠল রবিনের গলা। চটাস চটাস চাপড় মারতে আরম্ভ করেছে সে-ও। উফ, ড্রাকুলার বাচ্চা সব! খেয়ে ফেলল!…যেমন মনিব, তেমনি তার চাকর। দুজনেই হয়তো মানুষ শিকারে আনন্দ পায়। এ দ্বীপের সবাই রক্তলোভী। দেখছ না মশাগুলোর কাণ্ড!