দাঁড়িয়েই রইল কিশোর। সমস্ত প্রশ্নের জবাব না জেনে যেন বেরোতে ইচ্ছে করছে না তার। বলল, কিন্তু উলফ যদি আমাদেরকে মারার প্ল্যানই করে থাকে, তাহলে শুরু থেকেই জায়গা দিতে চাইল না কেন? কেন সময়। থাকতে আমাদের পালাতে বলল?
আরে বাবা, এসব কথা তো বাইরে গিয়েও ভাবা যাবে! পুরোপুরি অধৈর্য হয়ে পড়েছে রবিন। ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগল দরজার দিকে। মিলার ঢুকে পড়লে আর রক্ষা থাকবে না। কিশোরের হাত ধরে টান দিল সে, এসো।
হলওয়েতে বেরিয়ে এল ওরা। এদিক ওদিক তাকাল। কাউকে চোখে পড়ল না। ফিসফিস করে কিশোর বলল, সামনে দিয়ে বেরোনো যাবে না। উলফ কিংবা মিলারের চোখে পড়ে যেতে পারি। পেছন দিক দিয়ে পথ আছে, দেখেছি। ওটা দিয়ে বেরোব।
আমিও দেখেছি, মুসা বলল। কিন্তু ওটা তো রান্নাঘর দিয়ে গিয়ে বেরিয়েছে। যদি উলফ থাকে সেখানে?
থাকবে না। খেতে তো আর নিয়ে যায়নি মিলারকে। কথা বললে ওরা। ডাইনিং রুমে বসে বলবে।
যার যার ঘরে ঢুকে দ্রুতহাতে ব্যাগ গুছিয়ে নিল ওরা। ঘর থেকে বেরিয়ে পা টিপে টিপে চলে এল হলওয়ের মাথায়। কয়েক ধাপ সিঁড়ি আছে। নিচে আরেকটা করিডর। নামতে শুরু করল। মচমচ করে উঠছে পুরানো কাঠের সিঁড়ি। ওদের মনে হচ্ছে বোমা ফাটার শব্দ হচ্ছে যেন। মিলার কিংবা উলফের চলে আসার ভয়ে সারাক্ষণ সন্ত্রস্ত রইল।
সিঁড়ির গোড়ায়, করিডর এগিয়ে গেছে রান্নাঘরের দিকে। করিডরের একপাশে আরেকটা দরজা, অর্ধেক খোলা। সেটার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। কিশোর। কান পাতল কেউ আছে কিনা বোঝার জন্যে। কারও কথা শোনা গেল না। কানে আসছে শুধু ওদের নিঃশ্বাসের শব্দ।
ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। কৌতূহল হলো কিশোরের। কেউ যদি না-ই থাকবে আলো কেন? সাবধানে ভেতরে উঁকি দিল সে। কোনও ধরনের স্টোর রূম ওটা। একধরনের তেলতেলে ভাপসা গন্ধ। ভালমত দেখে বুঝল, স্টোর রূম নয়, ট্রফি রূম। শিকার করা জন্তু-জানোয়ারের স্টাফ করা। আস্ত দেহ সাজানো রয়েছে টেবিল আর বেদীতে। দেয়ালে বসানো হরিণ, ভালুক, আর নেকড়ের মাথা। আরেকদিকের দেয়ালে চোখ পড়তেই অস্ফুট শব্দ করে উঠল কিশোর।
কি হলো? জানতে চাইল মুসা।
নীরবে হাত তুলে দেখাল কিশোর।
তাকাল মুসা আর রবিন। পাথর হয়ে গেল যেন মুহূর্তে।
দেয়ালে হরিণের মাথার মতই বসানো রয়েছে চারজন মানুষের কাটা মুণ্ড।
*
বাইরে উষ্ণ রাত। ঝিঁঝির কর্কশ চিৎকার। গাঢ় অন্ধকার।
পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ওরা। উলফের চোখে পড়েনি। বেরিয়েই দৌড় দিল সৈকতের দিকে।
লম্বা ঘাসে পা লেগে হুবহুস শব্দ হচ্ছে। কেয়ারই করল না। ঢাল, বালি, ঘাসের বাধা, কোনটারই পরোয়া করল না। একটাই ভাবনা, কোনভাবে নৌকার কাছে পৌঁছে যাওয়া। ধরা পড়লে ভাগ্যে কি ঘটবে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। আরও তিনটে মানুষের মাথা যোগ হবে ট্রফি রূমের দেয়ালে বসানো চারটে মাথার সঙ্গে।
কিশোর ভাবছে হতভাগ্য মানুষগুলো কে ছিল? নিশ্চয় হোটেলের গেস্ট। কোন কারণে হোটেল যখন বন্ধ ছিল, তিন গোয়েন্দার মতই হয়তো তখন এসেছিল বেড়াতে। উন্মাদ খুনী মিলারের পাল্লায় পড়ে আর ফিরে যেতে পারেনি। মরে গিয়ে ট্রফি রূমের শোভা বাড়াচ্ছে ওরা।
হঠাৎ একটা কথা মনে হতেই ঠাণ্ডা হয়ে আসতে চাইল হাত-পা। কোরিকে ইতিমধ্যেই খুন করে ফেলেনি তো মিলার? করে হয়তো গুম করে রেখেছে কোনখানে। ওদের তিনজনকেও শেষ করার পর ধীরেসুস্থে মুণ্ড কেটে নেবে। আর ভাবতে চাইল না সে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডকের গেটে পৌঁছে গেল ওরা। গেট খোলার জন্যে পাল্লা ধরে টান দিয়েই থেমে গেল মুসা। খাইছে! আটকানো!
ডিঙিয়ে যাব, রবিন বলল।
যাওয়া যাবে না। গেটের ওপর কাঁটা বসানো।
তাহলে?
চিন্তিত ভঙ্গিতে কিশোর বলল, হোটলে ফেরা ছাড়া উপায় নেই।
কি বলছ!
হ্যাঁ, আর কোন উপায় নেই।
তর্ক করল না মুসা বা রবিন। কিশোর যখন বলেছে, নিশ্চয় না ভেবে বলেনি।
দেরি না করে ছুটল আবার ওরা।
কিছুদূর এসে ফিরে তাকাল হোটেলের দিকে। ওপরতলার আলো দুটোও এখন নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আছে বাড়িটা। কালো। আকাশের পটভূমিতে হালকা কালো এক বিশাল ছায়ার মত দেখাচ্ছে।
ঢালে জন্মে থাকা লম্বা ঘাসের পরে বন। সেদিক দিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ওদের। হোটেল থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে চায়।
বৃষ্টিতে ভেজা ঢাল বেয়ে নামাটা তেমন কঠিন না হলেও ওঠা খুব মুশকিল। তার ওপর সঙ্গে রয়েছে ব্যাগের বোঝা। কয়েক মিনিটেই হাঁপিয়ে গেল।
মেঘের ফাঁকে উঁকি দিল মলিন চাঁদ। ঘোলাটে আলোয় অন্ধকার কাটল কিছুটা। বনের মধ্যে একটা পেঁচা ডেকে উঠল।
বালির ঢিপির মাথায় সবার আগে উঠল রবিন। ডকের দিকে তাকিয়েই থমকে গেল।
সেটা লক্ষ করল কিশোর। কাছে উঠে এসে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে?
হাত তুলে দেখাল রবিন।
ডকের দিকে তাকিয়ে একই অবস্থা হলো কিশোরেরও। চাঁদের আলোয় দেখা গেল, ছোট্ট ডকে যেখানে নৌকাগুলো বাধা থাকত, সেখানটা এখন। খালি। একটা নৌকাও নেই।
খাইছে! মুসার মনে হচ্ছে বরফের মত শীতল একটা হাত খামচি দিয়ে ধরেছে তার মেরুদণ্ড। যাব কি করে?
যেতে পারব না, বিড়বিড় করে বলল কিশোর। দ্বীপ থেকে বেরোনোর পথও বন্ধ করে দিয়েছে।
.
১৫.
কোন রকম জানান না দিয়ে বৃষ্টি এল। ভিজিয়ে দিতে লাগল ওদের। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল কিশোর। আবার কুচকুচে কালো হয়ে গেছে আকাশটা। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ।