আমার আন্টির খোঁজ নিতে গেলেন নাকি? জানতে চাইল কোরি।
ভাল একটা চোখের দৃষ্টি কোরির ওপর স্থির করে মিলার বললেন, আন্টি? হ্যাঁ, তোমার আন্টি।
আবার খাওয়ায় মন দিলেন তিনি। সালাদ শেষ করে আস্ত একটা মুরগীর রোস্ট আর আলুভাজার বাটিটা টেনে নিয়ে খেতে শুরু করলেন। কারও জন্যে একটুও অবশিষ্ট না রেখে শেষ করে ফেললেন পুরোটাই।
তার এই কাণ্ড দেখে তাজ্জব হয়ে গেল সবাই।
কিন্তু কারও পরোয়া করলেন না তিনি। কোন রকম ভদ্রতার ধার ধারলেন না। খাওয়া শেষ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কাত হয়ে তুলে, নিলেন রাইফেলটা। চেয়ার থেকে উঠে সেটাতে ভর দিয়ে চলে গেলেন ডাইনিং রুম থেকে।
হাঁপ ছেড়ে বাচল যেন সবাই।
এ তো রাক্ষস, বলে উঠল মুসা। এর সঙ্গে খেয়ে আমিও পারব না।
রোজার না বললেন বিষণ্ণতা রোগ আছে? কোরি বলল।
আছেই তো, কিশোর বলল, নইলে এমন আচরণ করে নাকি কেউ!
বিষণ্ণতা না ছাই! মুখ ঝামটা দিয়ে বলল কোরি। আস্ত এক উন্মাদ!
মিলারের সমালোচনা চলছে, এই সময় রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল উলফ। মুখটা আগের চেয়ে গোমড়া। বলল, কি, বলেছিলাম না এখানে থাকা নিরাপদ নয়? এখনও সময় আছে, পালিয়ে যাও।,
আর না পালালে? ভুরু নাচাল মুসা। ভূত ছাড়া আর কিছুকে ভয় পাই না আমি। সত্যি করে বলুন, ভূত আছে কিনা? আপনাদের ওই মিলার ভূতফুত না তো?
দেখো, আমার কথা না শুনে ভুল করছ তোমরা… দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে গেল উলফ। বড় বড় হয়ে গেল চোখ।
ফিরে তাকাল কিশোর। রাইফেলে ভর দিয়ে ফিরে আসছেন মিলার। উলফের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলেন, থামলে কেন? চালিয়ে যাও তোমার বক্তৃতা।
কুঁকড়ে গেল উলফ। জ্যাকেটের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে চাইল যেন শরীরটা। না, স্যার, আমি তো কিছু বলছি না…
জ্বলন্ত এক চোখ মেলে উলফের দিকে তাকিয়ে রইলেন মিলার। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না উলফ। চোখ নামাতে বাধ্য হলো।
বরফের মত ঠাণ্ডা গলায় মিলার বললেন, তোমার ডিউটি রান্নাঘরে, সেখানেই যাও।
যাচ্ছি, স্যার! ভীত ইঁদুরের মত রান্নাঘরের দিকে ছুটে চলে গেল উলফ। পালিয়ে বাচল যেন।
সন্তুষ্টির হাসি ফুটল মিলারের ঠোঁটে। উলফকে ভয় দেখাতে পেরে খুশি হয়েছেন। এই প্রথম তার মুখে হাসি দেখল কিশোর। উলফ এত ভয় পায় কেন মিলারকে? রোজারকে পায় না। তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে।
এমনকি অনেক সময় চাপাচাপিও করে। তাতে মনে হয় মনিব-ভূতের স্বাভাবিক সম্পর্কের চেয়ে কিছুটা বেশিই সম্পর্ক রোজারের সঙ্গে। অথচ তারই ভাই মিলারকে দেখলেই যেন গুটিয়ে যায় উলফ।
উলফকে তাড়িয়ে ছেলেমেয়েদের দিকে ঘুরলেন মিলার। পলকে মিলিয়ে গেল হাসিটা। কুঁচকে গেল ভুরু। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত একভাবে তাকিয়ে থেকে রাইফেলে ভর দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। পা টানতে টানতে বেরিয়ে গেলেন আবার ঘর থেকে।
*
খাওয়ার পর ডাইনিং রূমের বড় জানালাটার ধারে বসে কথা বলছে ওরা। ঘণ্টাখানেক পর ঘরে ঢুকলেন রোজার। সেই সাদা পোশাক পরনে। হেসে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ তোমরা? জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন, শোরটাউনে গিয়েছিলাম।
হ্যাঁ, মিস্টার মিলার বলেছেন আমাদের, কোরি বলল। আন্টি কেমন। আছে?
ভাল। ফোন করেছিলেন। মিলার ধরেছিল। আমরা হোটেল বন্ধ করে দিয়েছি জেনে আর আসেননি। দুদিন ভালমত বিশ্রাম নেয়ার জন্যে থেকে গেছেন। তোমরা কাজ করছ এখানে, সেটাও জানানো হয়েছে তাঁকে। সবই করেছে মিলার, কেবল তোমাদের বলতে ভুলে গেছে, খবরটা। দুশ্চিন্তায় রেখে দিয়েছে। আজকাল আর কোন কথা মনে থাকে না ওর।
যাক, আন্টি তাহলে ভালই আছে। একটা দুশ্চিন্তা গেল। কিন্তু আমি যে ফোন করলাম, ধরল না কেন? বাড়িতে কেউ ছিল না নাকি?
কি জানি, জিজ্ঞেস করিনি। ভায়োলা চলে যায় হাসপাতালে। তোমার আন্টিও বোধহয় সাগরের ধারে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল, তুমি যখন ফোন করেছিলে ওই সময়।
তাই হবে। খবরটা এনে দেয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ও ঠিক আছে। কোন খবর না পেয়ে দুশ্চিন্তা আমারও হচ্ছিল। জোয়ালিন বললেন, কাল-পরশু নাগাদ চলে আসবেন এখানে।…তো ঠিক আছে, তোমরা গল্প করো। আমি যাই।
১১.
পরদিন সকালে নাস্তা খেতে এল না কোরি। অস্বাভাবিক লাগল না সেটা তিন গোয়েন্দার কাছে। এর আগেও এমন করেছে সে। দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছে। কাজ করার চেয়ে বিছানায় পড়ে থাকাটা ওর কাছে বেশি পছন্দের। ওকে নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাল না কেউ।
ডিমভাজায় চামচ বসিয়ে দিয়ে বিশাল জানালাটা দিয়ে সাগরের দিকে তাকাল মুসা। সাঁতার কাটার দিন নয় আজ। আকাশের অবস্থা ভাল না।
কিশোর আর রবিনও তাকাল। ভারী মেঘে ধূসর হয়ে আছে আকাশ। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। জোরাল বাতাস বালির ঢিবিতে জন্মানো ঘাসের মাথাগুলোকে চেপে নুইয়ে দিচ্ছে।
না বেরোতে পারলে নেই, কিশোর বলল। ঘষাঘষির কাজ যতটা পারি সেরে ফেলব।
আজকেও যদি আবার আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ বেরিয়ে পড়ে? রবিনের প্রশ্ন।
অবাক হব না। পুরানো বাড়ি। সুড়ঙ্গ, গুপ্তকুঠুরি থাকতেই পারে।
সারাটা সকাল একনাগাড়ে কাজ করল ওরা। দেড়টায় লাঞ্চ খাওয়ার আগে আর থামল না।
রান্নাঘরের বড় সিংকে হাত ধুতে ধুতে কিশোর বলল, কোরি কি এখনও উঠল না? এতক্ষণ তো ঘুমানোর কথা নয়।
ওর ঘরে গিয়ে দেখা দরকার, মুসা বলল।