কোথাও না কোথাও পথ একটা নিশ্চয় আছে, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল কিশোর। কারণ সুড়ঙ্গগুলো মানুষের তৈরি।
আই, কোরি বলল, পথ ভুল করে একই সুড়ঙ্গ দিয়ে ঘুরে মরছি না তো আমরা? বার বার একই জায়গায় ঢুকছি না তো?
পথ হারিয়েছি বলতে চাও? শঙ্কিত স্বরে বলল মুসা।
কিংবা এমনও হতে পারে ফাঁদ পেতেছিল কেউ আমাদের জন্যে। সেই ফাঁদে ধরা দিয়েছি আমরা। সুড়ঙ্গগুলো সব একই রকম লাগছে দেখতে। কোনদিনই আর এখান থেকে বেরোতে পারব না আমরা।
.
১০.
পারতেই হবে; দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। বেরোনোর পথ না পাওয়া পর্যন্ত এগিয়েই যেতে হবে আমাদের। নানা রকম প্রশ্ন মনে–কে বন্ধ করল দরজাটা? কেন করল? কি লাভ তার? কিন্তু প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবার সময় নেই। এখন।
একটা মোড় ঘুরে অন্যপাশে আসার পর দেখা গেল ক্রমশ খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গেছে সুড়ঙ্গ। কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে এটা? বেরোনোর পথ সত্যি পাওয়া যাবে তো? সন্দেহ দেখা দিল কিশোরের। শুধু শুধু ঘুরে মরছে না তো?
আতঙ্ক এসে চেপে ধরতে শুরু করল। বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করছে। হৃৎপিণ্ডটা।
দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে নিশ্চয়, টর্চের আলো ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখে বলল মুসা। আলো কমে যাওয়ায় চারপাশে ছায়া বাড়ছে এখন। উলফ আমাদের খোঁজাখুঁজি করবে।
কি জানি! অনিশ্চিত শোনাল রবিনের কণ্ঠ।
তোমার কি মনে হয় সে-ই দরজাটা আটকে দিয়েছে? বুকের ওপর দুই হাত আড়াআড়ি চেপে ধরেছে কোরি। ভেজা বাতাসে ঠাণ্ডা লাগছে।
অসম্ভব কি?
সামনে কমে আসছে অন্ধকার। একটা মোড় ঘুরতেই আলো দেখা গেল। আলোর দুটো ঝিলমিলে বর্শা তেরছা হয়ে মেঝেতে এসে পড়েছে। দেখেই দৌড় দিল মুসা। পেছনে ছুটল অন্যরা।
ছোট একটা দরজা। তার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে। ঠেলে খুলতে দেরি হলো না। হুড়মুড় করে বাইরে বেরিয়ে এল সবাই। অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল সূর্যালোকে এসে চোখই মেলতে পারল না প্রথমে।
কিশোরের অনুমান ঠিক। সৈকতে বেরিয়েছে ওরা। উঁচু একটা ঢিবির ঢালে এমন জায়গায় এমন ভাবে রয়েছে সুড়ঙ্গমুখটা, সাগর থেকে দেখা যাবে না। নিচে সৈকতে দাঁড়িয়েও নয়। দেখতে হলে ঢাল বেয়ে উঠে আসতে হবে।
তাজা বাতাস কেমন লাগছে? হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
রোদ যে এত চমৎকার বুঝতে পারিনি কোনদিন, আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল রবিন।
এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোদ আর বাতাস খেলে পেট ভরবে না, তাগাদা দিল মুসা, হোটেলে যাওয়া দরকার।
হাসাহাসি করতে করতে ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে মুখে যেন খই ফুটছে। উঠে এল হোটেলের পেছনের নির্জন। আঙিনায়। সুইমিং পুলের পাশ কাটাল। কাচের দরজা ঠেলে পা রাখল ঘরের ভেতর।
ডাইনিং রূমে ঢুকেই থমকে দাঁড়াল কিশোর। তাকিয়ে রয়েছে মঞ্চটার দিকে। যেখানে ছিল ওটা সেখানে নেই। ঠেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সুড়ঙ্গে ঢোকার দরজার কাছে।
কেন খোলা যায়নি দরজাটা বুঝতে অসুবিধে হলো না কারও। মঞ্চটা দিয়ে ইচ্ছে করেই আটকে দেয়া হয়েছে যাতে সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে শত ঠেলাঠেলিতেও না খোলে।
বোঝা গেল না কে করেছে এই অকাজটা।
*
বিকেলটা সৈকতে কাটিয়ে উত্তেজনা দূর করার চেষ্টা করল ওরা। পারল না। থেকে থেকে মনে আসছে কেউ একজন ইচ্ছে করে ওদেরকে সুড়ঙ্গে আটকে মারতে চেয়েছিল। কে লোকটা? উলফ? মিলার?
মিস্টার রোজারকে কথাটা জানানো দরকার, কিশোর বলল। সবাই একমত হলো ওর সঙ্গে।
কিন্তু ডিনারের সময় পাওয়া গেল না ব্যারনকে। খেতে এলেন না তিনি। চামচ দিয়ে এক টুকরো মাংস নিয়ে সবে মুখে দিয়েছে কিশোর, এই সময় রাইফেলে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঘরে ঢুকলেন মিলার। রাগে মুখ। লাল। এলোমেলো চুল। সেই সাফারি জ্যাকেটটাই পরে আছেন এখনও। বুকের কাছে ভোলা। নিচে হলদে স্পোর্টস শার্টের দুটো বোম নেই।
মিস্টার মিলার…এই যে, আমার বন্ধুরা:…সকালে দেখা হয়নি আপনার সঙ্গে, অস্বস্তি কাটানোর জন্যে কথা শুরু করতে গেল কিশোর।
এমন ভঙ্গিতে তাকালেন মিলার, যেন ওকেও চিনতে পারছেন না। মুসা, রবিন আর কোরির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল সে।
আনমনে ঘোৎ-ঘোৎ করলেন কেবল মিলার। হাত মেলালেন না। বিড়বিড় করে কি বললেন বোঝা গেল না। রাইফেলটা মেঝেতে শুইয়ে রেখে তার ভাই রোজারের চেয়ারটায় বসে খাবারের প্লেট টেনে নিলেন। হাপুস হুপুস করে খেতে শুরু করলেন নিতান্ত অভদ্রের মত।
সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সুপ শেষ করে সালাদের বাটিটা টেনে নিলেন। চামচের পর চামচ মুখে পুরে আধ চিবান দিয়ে দিয়েই গিলে ফেলতে লাগলেন।
শেষে আর সহ্য করতে না পেরে ভয়ানক অস্বস্তি দূর করার জন্যে কথা শুরু করল কিশোর, আপনার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে? …তিনি খেতে আসবেন না?
কিশোরের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখভর্তি খাবার চিবাতে থাকলেন মিলার। গিলে নিয়ে কোনমতে বললেন, না, রোজার এখানে নেই, বলেই আবার বড় এক চামচ সালাদ মুখে পুরলেন।
কোথাও গেছেন?
মাথা ঝাঁকিয়ে দায়সারা জবাব দিলেন মিলার। সশব্দে সালাদ চিবাতে লাগলেন।
অবাক লাগছে কিশোরের। এত বুনো কেন এই লোক? ভাইয়ের ঠিক উল্টো! দুই যমজ ভাইয়ের মধ্যে স্বভাবের এতটা পরিবর্তন কল্পনা করা যায় না।
কিশোরকে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবশেষে ঘোৎ-ঘোৎ করে বললেন মিলার, রোজার গেছে শহরে। শোরটাউন। তারপর আরও কি যেন বললেন, এতই অস্পষ্ট, বোঝা গেল না কিছু।