মুসা বলল, আমার মনে হয় সাগরের দিকে গেছে সুড়ঙ্গটা। পানির ধারে গিয়ে শেষ হয়েছে।
বানিয়েছিল কারা? রবিনের প্রশ্ন। জবাবটাও নিজেই দিল, বোধহয় প্রাচীন চোরাচালানির দল। রাতে জাহাজ থেকে গোপনে মাল খালাস করে। এনে হোটেলে লুকিয়ে রাখত।
টর্চের আলো সামনে ধরে রেখে সাবধানে নিচে নামতে লাগল কিশোর। আরও কয়েক মিনিট এগোনোর পর দেখা গেল দুভাগ হয়ে গেছে সুড়ঙ্গ। মূল সুড়ঙ্গটা বাঁয়ে মোড় নিয়ে সোজা এগিয়েছে। ওটা থেকে বেরিয়ে আরেকটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে ডানে।
রসিকতা করে কিশোরকে জিজ্ঞেস করল মুসা, কোনদিকে যাব এবার, ক্যাপ্টেন কিড?
চলো আগে ডানেরটা ধরেই যাই, কোরি বলল।
কেন, কোন বিশেষ কারণ?
না না, তাড়াতাড়ি জবাব দিল কোরি, কোন কোন ভূত বিশেষজ্ঞ বা দিকটাকে অশুভ মনে করে তো…
আর কিছু বলা লাগল না। মুহূর্তে ডান দিকে ঘুরে গেল মুসা।
কয়েকশো গজ এগোনোর পর চিৎকার করে উঠল কোরি।
কি হলো? জানতে চাইল কিশোর।
মুখে কি জানি লাগল!
আলো ফেলল কিশোর। মাকড়সার জাল। তুমি কি ভেবেছিলে?
জবাব দিল না কোরি।
কি আর ভাববে, হাসতে হাসতে বলল রবিন, ভ্যাম্পায়ারের ছোঁয়া।
জালে দুলন্ত হালকা বাদামী মাকড়সাগুলো দেখতে দেখতে উত্তেজিত হয়ে উঠল কিশোর, সৈকতে বাস করে এসব মাকড়সা, পানির কিনারে। তারমানে বাইরে থেকে এসেছে এগুলো। আর বাইরে থেকে যেহেতু এসেছে, ঢোকার পথ আছে। এবং ঢোকার পথ মানেই বেরোনোর পথও।
গতি বাড়িয়ে দিল ওরা।
আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গের আরও কয়েকটা মোড় ঘুরে এসে দাঁড়াল একটা কাঠের দরজার সামনে। কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হয়ে আছে। ওপাশে ঘন অন্ধকার।
দরজায় হাত রাখল কিশোর। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে ঠেলা দিল। কাচকোচ আওয়াজ তুলে খুলে গেল পাল্লা। টর্চের আলোয় দেখা গেল ছোট একটা ঘর। মাঝখানে একটা কাঠের টেবিল। দুই পাশে বেঞ্চ পাতা। টর্চের আলোয় দেখা গেল দেয়ালগুলোতে লাল রঙ লেগে আছে। যেন রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
টেবিলের দিকে চোখ পড়তে খাইছে! বলে উঠল মুসা। হাত থেকে খসে গেল টর্চ।
কিশোরের টর্চটা জ্বলছে।
বিড়বিড় করে কোরি বলল, মরার খুলি!
এগিয়ে গেল কিশোর। চটচটে কি যেন লেগে রয়েছে। আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। আঠা আঠা জিনিস। গন্ধ শুকল। কিছু বুঝতে পারল না।
প্রোটোপ্লাজম! ফিসফিস করে বলল কোরি। ভূতেরা যেখান দিয়ে চলে, সেখানে নরকঙ্কাল দেখলেই তাতে লাগিয়ে রেখে যায়। এবার তো বিশ্বাস করবে আমার কথা? খানিকক্ষণ আগে এখানে বসে ছিল একটা ভূত, মরার খুলিতে করে নিশ্চয় কফি কিংবা চা খেয়েছে, এটা তারই প্রমাণ।
হেসে ফেলল রবিন, অতিরিক্ত ভূতের সিনেমা আর ভূতের গল্প পড়ার ফল এসব। ধরতে গেল খুলিটা। নাড়া লাগতেই গড়িয়ে গেল ওটা। চোখ দুটো ওর ঘুরে গেল সে দিকে। ঝটকা দিয়ে হাতটা সরিয়ে আনল সে।
মাগো! খেয়ে ফেলল! বলে চিৎকার দিয়েই পেছন ফিরে দৌড় মারতে গেল মুসা।
খপ করে তার হাত ধরে ফেলল কিশোর। আরে থামো! কি করছ। পাগলের মত?
মুসাকে শান্ত হওয়ার সময় দিল সে। আগেই লক্ষ করেছে দরজার পাশে সুইচবোর্ড আছে। আলো জ্বেলে দিল। তুলে নিল মাটিতে পড়ে যাওয়া টর্চটা।
আর কিছু দেখার নেই। ফিরে চলল ওরা ডাইনিং রূমে।
সুড়ঙ্গটা যেখানে দুভাগ হয়েছে সেখানে পৌঁছে রবিন জিজ্ঞেস করল, বাঁয়েরটায় ঢুকবে না?
ঘড়ি দেখল কিশোর, নাহ, এখন আর সময় নেই। কাজে অনেক ফাঁকি দিয়েছি। মিস্টার রোজার জানতে পারলে রাগ করবেন।
যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিল সেটার কাছে ফিরে এল ওরা।
কিন্তু দরজা বন্ধ। শত ঠেলঠেলিতেও খুলল না। আটকে গেছে কোন কারণে। এই সময় লক্ষ করল কিশোর, আলো কমে এসেছে টর্চের। ফুরিয়ে এসেছে ব্যাটারি।
শঙ্কিত কণ্ঠে রবিন বলল, আটকা পড়লাম না তো!
*
দরজায় দুই হাতে কিল মারতে মারতে চিৎকার করে উঠল কোরি, অ্যাই, শুনছেন? কেউ আছেন ওপাশে? দরজাটা খুলুন!
জবাব দিল না কেউ।
পদশব্দের আশায় কান পেতে রইল ওরা। কেউ এগিয়ে এল না।
বাইরে থেকে তালা আটকে দেয়নি তো? ককিয়ে উঠল কোরি।
দরজার কাছ থেকে সরে গেল কিশোর। বেরোনোর অন্য কোন পথ নিশ্চয় আছে। সময় থাকতে থাকতে সেটা খুঁজে বের করা দরকার। টর্চ নিভে গেলে মহাবিপদে পড়ব।
কি করবে? জিজ্ঞেস করল রবিন।
সুড়ঙ্গের অন্য মাথা দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করব।
মৃদু প্রতিবাদ করতে চাইল কোরি, কিন্তু কেউ তার কথা শুনল না। ফিরে চলল আবার ওরা।
সুড়ঙ্গের মাথাটা যেখানে দুই ভাগ হয়েছে সেখানে পৌঁছে এবারও ডানের সুড়ঙ্গটায় ঢুকল ওরা। কারণ কিশোরের ধারণা এটা দিয়ে সৈকতে বেরোনো যাবে। প্রায় গা ঘেঁষাঘেষি করে এগোল সরু সুড়ঙ্গ ধরে। ব্যাটারি ফুরিয়ে যাবার ভয়ে একনাগাড়ে জ্বেলে না রেখে মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে পথ দেখে নিচ্ছে মুসা আর কিশোর।
পার হয়ে এল দরজাটা।
কিছুদূর এগোনোর পর আবার ভাগ হয়ে গেল সুড়ঙ্গ।
ডানেরটা দেখিয়ে বলল কোরি, এটাতেই ঢুকি, কি বলো?
সেটাতে ঢুকল ওরা। কিছুদূর এগোনোর পর মনে হলো অনেক বড় বাক নিয়েছে,সুড়ঙ্গটা। ঘুরে এগোচ্ছে। ছাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঝরে পড়ছে কংক্রীটের মেঝেতে। অসংখ্য মাকড়সার জাল। হাতে, মুখে, মাথায় জড়িয়ে যাচ্ছে।
চলেছে তো চলেছেই। পথ আর ফুরায় না। রবিন বলল, এ কোথায় চলেছি? বেরোনোর পথ পাওয়া যাবে তো?