উলফ এসে ঢুকল ডাইনিং রূমে। মুখ সেই একই রকম গোমড়া। হাতে একটা লাল রঙের টুলবক্স। ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করল। কাজ শুরু করতে চাও?
কোরি জিজ্ঞেস করল, উলফ, হোটেলে কোন মহিলা আছে?
প্রশ্নটা অবাক করল উলফকে। মুখটাকে এমন করে ফেলল যেন বোলতায় কামড়ে দিয়েছে। দ্রুত সামলে নিয়ে বলল, না, নেই। কেন?
ব্যারনের সঙ্গে কোন মহিলা দেখা করতে এসেছে?
চোখ দেখেই বোঝা গেল এসব প্রশ্নে খুব বিরক্ত হচ্ছে উলফ। না, কেউ দেখা করতে আসেনি। রলিন মারা যাওয়ার পর আর কোন মহিলা ঢোকেনি। ব্যারনের ঘরে। রলিন ছিল তার স্ত্রী।
টুলবক্সটা নিয়ে ঘরের পেছনের অংশে চলে গেল উলফ। কিশোরের দিকে তাকাল কোরি। চোখে বিস্ময়। কিন্তু প্রসঙ্গটা নিয়ে আলোচনা করা গেল না। আর। এখন কাজের সময়।
এখান থেকে কাজ শুরু করবে তোমরা, দেয়াল জুড়ে থাকা লাইটহাউজের বিশাল একটা পেইন্টিং সরাল উলফ। ওয়ালপেপার সরাবে। সিরিশ দিয়ে ঘষে মসৃণ করবে।
*
সারাটা সকাল কাজ করল ওরা। পুরানো বাদামী রঙ ঘষে ঘষে তুলল। গরম হয়ে উঠেছে ঘরটা। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে বাদামী রঙের শুকনো কণা। বাতাসেও উড়ছে। ঘামে আঠা হয়ে গেছে শরীর। উলফ ঠিকই বলেছে–পরিশ্রমের কাজ। সাগরের নোনা হাওয়া কাঠের অনেক গভীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে রঙ, তোলা খুব মুশকিল।
সাড়ে এগারোটা নাগাদ কোরি বলল, একটা কোক খাওয়া দরকার। আন্টিকেও ফোন করতে হবে। ও মই থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল মুসা। কোরির সঙ্গে সঙ্গে এগোল। ওদের পেছনে গেল রবিন। কিশোর বলল, তোমরা যাও। আমি এটুকু শেষ করে আসি।
কথা বলতে বলতে যাচ্ছে তিনজনে। রান্নাঘরে ঢুকে যেতে আর শোনা গেল না। মইয়ে দাঁড়িয়ে নিজের কাজে মন দিল কিশোর। সিরিশ দিয়ে ঘষতে ঘষতে হাতের পেশী ব্যথা হয়ে গেছে। কিন্তু থামল না। ঘষেই চলল।
দশ কি পনেরো মিনিট পর কানে এল পদশব্দ। মুসারা নিশ্চয় ফিরে এসেছে।
ফিরে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেল কিশোরের হাত।
মুসারা নয়। অবিকল ব্যারনের মত দেখতে একজন অপরিচিত লোক এসে দাঁড়িয়েছেন। সাদা চুল, সাদা গোঁফ। কিন্তু ব্যারনের মত হাসিখুশি নন, বরং উল্টো। পোশাকও পরিচ্ছন্ন নয়। কানা জলদস্যুদের মত এক চোখ কালো কাপড়ে ঢাকা। পরনে ঢোলা জিনস। প্যান্টের হাটুতে দাগ। গায়ে। সাফারি জ্যাকেট। অসংখ্য পকেট তার। কাগজ, কলম, রুমাল আর নানা। রকম জিনিসে উঁচু হয়ে আছে সেগুলো। ডান হাতে একটা হান্টিং রাইফেল। নল ধরে বাটটা ঠেকিয়ে রেখেছেন মেঝেতে। ভয়ানক বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে রাইফেলটাকে লাঠির মত ব্যবহার করে কাঠের মেঝেতে ঠুকঠুক শব্দ তুলে এগিয়ে এলেন কিশোরের দিকে।
হাই, হাসিমুখে বলল কিশোর।
জবাবে ঘোৎ করে উঠলেন তিনি। কালো একটা চোখ মেলে তাকিয়ে। রইলেন কিশোরের দিকে।
আমি কিশোর পাশা। আশা করল নিজের পরিচয় দেবেন ভদ্রলোক। দিলেন না দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি নিশ্চয় মিলার মেলবয়েস?
ব্যারন মিলার ডি মেলবয়েস, রাইফেলে ভর দিয়ে কিছুটা সামনে ঝুঁকে কুঁজো হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। গলাটা তার ভাই রোজারের মত গমগমে হলেও অতটা মসৃণ নয়। আচরণ ভদ্র তো নয়ই, বুনো।
চেহারা এক, অথচ দুই ভাইয়ের মধ্যে অত অমিল হয় কি করে?–ভাবল কিশোর। বলল, আমরা বেড়াতে এসেছি এখানে। আমি আর আমার তিন বন্ধু। থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে কাজ করে দিচ্ছি। মিলারের দৃষ্টির সামনে অস্বস্তি বোধ করছে সে।
শুনেছি, কিছুতেই সহজ হচ্ছেন না ভদ্রলোক। রাইফেলটাকে লাঠির মত ব্যবহার করে হেঁটে গেলেন জানালার কাছে। বাইরে তাকিয়ে রইলেন। উজ্জ্বল, রোদে আরও স্পষ্ট দেখা গেল তার পোশাকগুলো। অতিরিক্ত কুঁচকানো আর ময়লা।
রোজার বলেছেন, তাঁর ভাই বিষণ্ণতা রোগে ভুগছেন। কেন এই বিষণ্ণতা? আলাপ জমানোর জন্যে বলল কিশোর, দিনটা খুব সুন্দর, তাই না? জায়গাটাও দারুণ আপনাদের। মই থেকে নামবে কি নামবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না সে।
কোথায় সুন্দর? বিরক্তকণ্ঠে প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন মিলার। প্রচণ্ড গরম! সাগরের দিকে তাকিয়ে থেকে নল ধরে ধীরে ধীরে ঘোরাচ্ছেন রাইফেলটা।
ঘরের মধ্যে গরম।
জবাব দিলেন না মিলার। অস্বস্তি আরও বাড়ল কিশোরের। ইচ্ছে করেই এমন পরিস্থিতি তৈরি করছেন তিনি যাতে সহজ হতে না পারে সে? মুসারা এত দেরি করছে কেন?
তোমার বন্ধুরা কোথায়? জিজ্ঞেস করলেন মিলার।
কাজ করতে করতে ঘেমে গেছিল, পানি খেতে গেছে। আমি এই কোণাটা শেষ করে যাব, হাত তুলে দেখাল কিশোর।
দেখার জন্যে ঘুরলেন না মিলার। বিষণ্ণকণ্ঠে বললেন, জায়গাটা অতিরিক্ত চুপচাপ।
হবেই। এতবড় জায়গা। মাত্র পাঁচ-সাতজন লোক।
তার কথাটা মনে হয় পছন্দ হলো না মিলারের। মুখটাকে বিকৃত করে ঘনঘন রাইফেল ঠুকতে লাগলেন মেঝেতে। এগিয়ে আসতে শুরু করলেন। মইয়ের কাছে।
ভয় পেয়ে গেল কিশোর। মই থেকে টান মেরে ফেলে দেবেন না তো?
কিন্তু মইয়ের ফুটখানেক দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। এক পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে সশব্দে নাক ঝাড়লেন, গোফ মুছলেন, রুমালটাকে দলা পাকিয়ে ভরে রাখলেন আরেক পকেটে। কিশোরের দিকে চোখ তুলে বললেন, মন দিয়ে কাজ করো।
হ্যা করছি… ভয়ে ভয়ে বলল কিশোর। কি বললে আবার খেপে যান। কে জানে।
আমার ভাইকে দেখেছ?
না তো। সকালে নাস্তা খেতেও আসেননি।