অ্যানির কথা ভাবতে লাগল। মনে পড়ছে ওর চকচকে চুল। উজ্জ্বল হাসি।
আস্তে চালান, শহরের কিনারে পৌঁছে অফিসারদের বলল সে। আরেকটু সামনেই। মসৃণ, রূপালী সৈকতটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। হঠাৎ বলে উঠল, হ্যাঁ, থামুন, এখানেই।
সঙ্গে সঙ্গে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল অফিসার।
গাড়ি থেকে নামল মুসা। ছোট বালিয়াড়িটার দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটতে গিয়ে ঠাণ্ডা বালি ঢুকছে জুতোর মধ্যে।
ওর ঠিক পেছনেই রয়েছে দুই পুলিশ অফিসার। ওদের হাতের শক্তিশালী টর্চের রশ্মি হলুদ আলোর বৃত্ত সৃষ্টি করছে বালিতে।
এখানেই হাঁটছিলাম আমরা, মুসা বলল। গালে এসে লাগছে সাগরের। ফুরফুরে হাওয়া। নোনা গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে পচা শ্যাওলার গন্ধ।
পেছনে দুদিকে সরে গিয়ে আলো ফেলে ফেলে দেখতে শুরু করল দুই অফিসার।
সৈকতের এপাশ-ওপাশ, সামনে-পেছনে চোখ বুলিয়ে অনুমানের চেষ্টা করল মুসা, কোথায় যেতে পারে অ্যানি?
রাতে এই সৈকত ভয়ানক বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। সর্বক্ষণ চলে ভ্যাম্পায়ারের আনাগোনা।
বালিয়াড়ির সাদা বালিতে উঁচু হয়ে আছে কালোমত একটা কি যেন। শেষবার এই বালিয়াড়িটার আড়ালেই হারিয়ে যেতে দেখেছিল অ্যানিকে। কৌতূহল হলো। এগিয়ে চলল ওটার দিকে। কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখল, টর্চ হাতে খুজতে খুজতে দূরে সরে যাচ্ছে দুই অফিসার। পানির কিনারে খুঁজছে দুজনে। হয়তো ভাবছে রিকির মত পানিতে ডুবে মারা গেছে অ্যানিও।
কালো ঢিবিটার কাছে চলে এল মুসা। ভালমত দেখার জন্যে নিচু হয়ে তাকাল। পরক্ষণে সোজা হয়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগল দুই অফিসারকে।
০৬.
বালিতে চিত হয়ে পড়ে আছে অ্যানি। একটা হাত বুকের ওপর, আরেক হাত পাশে ছড়ানো। চাঁদের আলোয় ফ্যাকাসে লাগছে সাদা চামড়া। নিথর হয়ে পড়ে আছে সে।
কোন কিছুতে হাত দিয়ো না, মুসাকে সাবধান করল মহিলা অফিসার। সরে যেতে বলল।
অ্যানির দিকে তাকিয়ে আছে মুসা। খোলা চোখ দুটো নিপ্রাণ, শূন্য চাহনি মেলে যেন তাকিয়ে রয়েছে রাতের আকাশের দিকে। হাঁ হয়ে থাকা মুখ বালিতে ভরে গেছে। নাকের ফুটোয়ও বালি।
জানা দরকার কি করে মারা গেল ও। কাছে যেতে মানা করেছে তাকে। অফিসাররা। করুক। শুনবে না কথা। জানতেই হবে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছে দুজনে। মুসার দিকে চোখ নেই। এই সুযোগে অ্যানির লাশের কাছে চলে গেল সে। বসে পড়ে হাত বাড়িয়ে গলার কাছের চুল সরিয়ে দিল।
চিৎকার করে উঠল দুই অফিসার। ওকে সরিয়ে নিতে এল একজন।
ততক্ষণে যা দেখার দেখে ফেলেছে মুসা। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা। গেল গলার শিরার ওপরের চামড়ায় দুটো ফুটো। দুই ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে কালো হয়ে আছে।
এই জিনিস দেখারই আশঙ্কা করেছিল। তারমানে তার সন্দেহ ঠিক। লীলা আর জন ছাড়াও আরও ভ্যাম্পায়ার আছে এই এলাকায়। ওগুলোকে থামানো দরকার। নইলে রিকি আর অ্যানির মত আরও কত জীবন যে নষ্ট করবে ঠিক নেই।
চাপা রাগ ফুঁসে উঠতে লাগল ভেতরে ভেতরে। ওখানে দাঁড়িয়েই আরও একবার প্রতিজ্ঞা করল, সবগুলোকে ধ্বংস না করে ক্ষান্ত হবে না।
খুঁজে বের করবে!
খুন করবে একে একে!
কোনটাকে রেহাই দেবে না। স্যাভি হোলোকে পুরোপুরি মুক্ত করবে। ভ্যাম্পায়ারের কবল থেকে।
*
বালিতে বসে পড়ল মুসা। মাথার মধ্যে কেমন ঘোর লেগে আছে।
মোবাইল ফোনে খবর পেয়ে আরও অনেক পুলিশ এসে হাজির হয়েছে। কাজে ব্যস্ত ওরা। লাশটা যেখানে পাওয়া গেছে, সাদা রঙের প্লাস্টিকের খুটি দিয়ে তার চারপাশ ঘিরে দিয়েছে। সূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিভাবে মারা গেল মেয়েটা বোঝার চেষ্টা করছে।
বসেই আছে মুসা।
অবশেষে কাজ শেষ হলো পুলিশের। ওকে ডাকল একজন। একটা গাড়িতে তুলে নিল।
চুপচাপ বসে রইল সে। কারও সঙ্গে কোন কথা বলল না। ওরাও তাকে জিজ্ঞেস করল না কিছু। থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওকে। অন্ধকার শহরটা ওর পাশ দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে যেন স্বপ্নের মধ্যে।
মেইন স্ট্রীট আর ওশন অ্যাভেনিউটা যেখানে ক্রস করেছে, তার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। পাথরে তৈরি পুরানো বাড়ি। জানালায় মোটা। লোহার শিক লাগানো। জেলখানার মত। হাজত, না জেল?
অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সে।
শেষবার ওর সঙ্গে দেখা গেছে অ্যানিকে। লাশটাও খুঁজে বের করেছে সে। তার জন্যে কি সন্দেহ করা হচ্ছে ওকে?
ওকারিশ নামে একজন ডিটেকটিভ তার অফিসে নিয়ে ঢোকাল মুসাকে। তারপর শুরু হলো মুষলধারে প্রশ্ন। একই প্রশ্ন বার বার। কখনও কণ্ঠস্বর চড়িয়ে, কখনও নামিয়ে; কখনও ধমকের সুরে, কখনও কোমল স্বরে–কোথায় দেখা হয়েছে অ্যানির সঙ্গে, কতদিনের পরিচয়, শেষবার ওর সঙ্গে কোনখানে ছিল, কতক্ষণ, ইত্যাদি ইত্যাদি এবং আরও নানা প্রশ্ন।
জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেল মুসা।
ভোরের ঘণ্টাখানেক আগে ছাড়া পেল সে। হেঁটে চলল মেইন স্ট্রীট ধরে, বন্ধ দোকানগুলোর পাশ দিয়ে। একটা লোককেও দেখা গেল না এ সময়ে।
দ্রুত হাঁটতে লাগল সে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সরে যেতে চাইছে যেন। থানার কাছ থেকে। সে যে নির্দোষ এটা পুলিশকে বোঝাতে পেরেছে কিনা বুঝতে পারছে না।
মনে হয় পারেনি। ওকারিশ ওকে সন্দেহ করে বসে আছে। ছেড়ে দিয়েছে বোধহয় ওর গতিবিধির ওপর চোখ রাখার জন্যে।
দোতলার শিক লাগানো জানালাগুলোর কথা মনে পড়তে আবার কেঁপে উঠল সে। ওর মধ্যে আটকা থাকতে হলে মরেই যাবে।