বেটে, মোটা, মাঝবয়েসী এক মহিলা গটগট করে হেঁটে এসে ঢুকলেন স্টেজে। সোনালি চুল ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। কোলাহল ছাপিয়ে চিৎকার করে বললেন তিনি, অ্যাটেনশন, প্লীজ! আমার কথা শোনো তোমরা!
ধীরে ধীরে কমে এল চিৎকার-চেঁচামেচি, হট্টগোল। আমি মিসেস রথরক। স্যান্ডি হোলোর এই কমিউনিটি থিয়েটারের পরিচালক। একসঙ্গে তোমাদের এতজনকে দেখে খুব ভাল লাগছে আমার।
নাটকটা সম্পর্কে বলতে আরম্ভ করলেন তিনি। আগ্রহ হারাল মুসা। অডিটরিয়ামের সীটে বসা ছেলেমেয়েদের দিকে নজর ফেরাল আবার। ওসব। হাসিমুখের যে কোনটার আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারে মারাত্মক শ্বদন্ত। সুন্দর চেহারাগুলোর যে কোনটা নিমেষে পরিবর্তিত হয়ে রূপ নিতে পারে। ভয়াবহ দানবে।
কেশে গলা পরিষ্কার করলেন মিসেস রথরক। আবার তার দিকে ফিরল মুসা।
শুরু করা যাক, বললেন তিনি। রবিন মিলফোর্ড, উঠে এসো। তোমাকে দিয়েই শুরু করি।
সীটের সারির পাশ দিয়ে মঞ্চের দিকে এগোল রবিন। চেহারায় উত্তেজনার ছাপ। মঞ্চে উঠলে তার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন মিসেস, রথরক। তাতে সংলাপ লেখা। পড়া আর অভিনয় একসঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে।
শুরু করল রবিন।
মুসার চোখ ওর দিকে। পাশ থেকে চমকে দিল ডলি, মুসা, আমি এসে গেছি।
ফিরে তাকাল সে। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ডলি। বলল, দেরি করে। ফেললাম নাকি?
না, মাত্র শুরু করেছে। রবিনই প্রথম। যে রকম ঢিলামি শুরু হয়েছে, কয়েক ঘণ্টা লাগিয়ে দেবে। হয়তো দেখা যাবে আজ আর সবার টেস্ট নেয়াই হলো না।
তুমি কোন পার্টটা করছ?
ডলির গায়ের পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছে মুসা। পরিচিত লাগছে গন্ধটা। মনে করতে পারছে না। আমার এসব নাটক-ফাটক ভাল্লাগে না। তবু যদি করতেই হয় সবচেয়ে ছোটটা নেব, ডেলিভারি বয়। মাত্র পাঁচ লাইনের সংলাপ। দিলে দিল দিলে নাই।
লেডি ভ্যাম্পায়ারের পার্ট করার ইচ্ছে আমার, গর্বের সঙ্গে বলল ডলি। ডায়লগ আগেই নিয়ে গিয়ে মুখস্থ করে ফেলেছি। আশা করছি পেয়ে যাব। চরিত্রটা।
পরীক্ষা দেয়া শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে এল রবিন। ডলিকে জিজ্ঞেস করল, কণিকা আসেনি?
এসেছে, হাত তুলে দেখাল সে, ওই তো।
আমাকে খুঁজছ? এগিয়ে এল কণিকা। পেছনে কিমি।
কেন খুঁজছ? জানতে চাইল কণিকা।
না, এমনি। এলে একসঙ্গে, তারপর আর দেখা নেই…
ও। চলো, বসি।
আগের সীটটায়ই গিয়ে বসল রবিন। পাশে কণিকা। কিমি বসল টনির পাশে।
মুসার দিকে তাকাল ডলি। লম্বা চুলে ঝাঁকি দিয়ে হেসে বলল, আবার সেই তুমি আর আমি। একা।
জবাব দিল না মুসা।
মিসেস রথরক বললেন, টনি হাওয়াই, অভিনয় করবে? বলে ঘুরতেই ডলির ওপর চোখ পড়ে গেল, ও, ডলিও এসে গেছ। ভাল। তোমার কথাই ভাবছিলাম।
এখানকার ছেলেমেয়েদের অনেকেই তার পরিচিত।
হ্যাঁ, এসেছি, এক পা এগিয়ে গেল ডলি।
টনির আগে তুমি টেস্ট দিতে চাও?
অসুবিধে নেই। উনি আগে গেলেও হয়।
ঠিক আছে, তুমিই এসো আগে। তোমার চরিত্রটা বড়।
এগিয়ে গেল ডলি। মঞ্চের মাঝখানে গিয়ে দর্শকের দিকে ফিরে হাসল।
অনেকের মত মুসাও তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
ভ্যাম্পায়ার হওয়া বড়ই কঠিন কাজ, সংলাপ বলার আগে লেকচার দিতে শুরু করল ডলি। যে না হয়েছে, সে বুঝবে না। গুঙিয়ে উঠল সে।
বাই ভাবল অভিনয় করছে ডলি, কিন্তু কণিকা আর কিমি বুঝতে পারছে, গোঙানিটা সত্যি। খিদেয় এমন করছে।
একটা বিশেষ দৃশ্য অভিনয় করে দেখাতে বললেন মিসেস রথরক।
অভিনয় শুরু করল ডলি।
ভালই, বলে উঠল মুসার কাছে দাঁড়ানো একটা মেয়ে। তবে অতি অভিনয় করছে।
ফিরে তাকাল মুসা। মেয়েটা সুন্দরী। কখন এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে বলতে পারবে না। মঞ্চের দিকে চোখ থাকায় খেয়াল করেনি এতক্ষণ। মাথাভর্তি কালো চুল। এত নিঃশব্দে এল কি করে! ভ্যাম্পায়ার নাকি?
ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা, কি বললে?
বললাম, অতি অভিনয়। নাটক না হয়ে কার্নিভলের যাত্রা হয়ে যাচ্ছে।
আস্তে বলো। শুনতে পেলে দুঃখ পাবে।
পায় পাক। ভুল তো আর বলিনি।
খুব বেশি আত্মবিশ্বাস মনে হচ্ছে তোমার?
জবাবে হাসল মেয়েটা। ডান হাতটা মুসার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি অ্যানি। ওই চরিত্রটার জন্যেই টেস্ট দেব আমিও।
কয়েক মিনিট পর ডলিকে বিদেয় করে দিয়ে মিসেস রথরক ডাকলেন, এনিড ক্যামেরন, এবার তুমি এসো।
নড়ে উঠল অ্যানি। মুসার দিকে তাকিয়ে আরেকবার হেসে বলল, যাচ্ছি, দোয়া কোরো।
হালকা পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিঃশব্দে মঞ্চে উঠল সে।
ভ্যাম্পায়ার হিসেবে কাকে বেশি সন্দেহ করা উচিত, ভাবতে লাগল মুসা। ডলি, না অ্যানি? অ্যানিই হবে। ডলি অতিমাত্রায় সরব। অ্যানি শান্ত। ছায়ার মত নিঃশব্দ চলাফেরা তার।
অ্যানি অভিনয় শুরু করতেই নীরব হয়ে গেল সমস্ত অডিটরিয়াম। যেন কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে সে। নাক কুঁচকাল, মোরগের মত ঘাড় কাত করল, হাসল, ভ্রূকুটি করল।
তাকিয়ে আছে সবাই।
মুসা নাটক বোঝে না। কিন্তু অ্যানি আর ডলির অভিনয় দেখে এটুকু অন্তত বুঝল, দুজনের মধ্যে কে ভ্যাম্পায়ারের অভিনয় ভাল করতে পারবে।
ডায়লগ বলা শেষ হতেই তুমুল হাততালি পড়তে লাগল। লজ্জা পেল অ্যানি। লাল হয়ে গেল। মঞ্চ থেকে নেমে এগিয়ে এল মুসার দিকে।
তুমি দারুণ অভিনয় করো! প্রশংসা করল মুসা। সত্যি বলছ? পার্টটা পেলে খুব খুশি হতাম।