রাস্তা?
না, রাস্তা এখনও পুরোপুরি হয়নি। হেঁটে যাওয়ার ফলে একটা পায়ে চলা পথ তৈরি হচ্ছে। নেকড়ের কাজ?
ধূর! অত চিন্তা করে কিছু করতে পারবে না। নিজেকে ধমক লাগাল সে-যা হোক একটা কিছু করে ফেলো, নয়তো ভ্যাম্পায়ার খোঁজা বাদ দিয়ে মানে মানে কেটে পড়ো এখান থেকে।
কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাতুড়িটা বাগিয়ে ধরে পা বাড়াল সে। বনে এসে ঢুকল। বনটা এদিকে বেশ গভীর। এগিয়ে চলল গাছপালার মাঝখান দিয়ে। গায়ে বাড়ি লেগে সড়াৎ সড়াৎ করে সরে যাচ্ছে ডাল। পাতায় লেগে থাকা পানি মুহূর্তে ভিজিয়ে দিল শরীর। ঘন হয়ে জন্মে আছে মোটা মোটা লতা ঝুলে আছে রাস্তার ওপর। হাঁটতে গেলে জড়িয়ে ধরে।
এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পড়তে বাধ্য হলো সে। সামনে ডালপাতা জড়িয়ে ধরে দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করে রেখেছে লতার দঙ্গল। তার ওপাশে বাড়ির দেয়ালের মত কি যেন চোখে পড়ছে। নিশ্চিত হওয়ার জন্যে ডাল সরিয়ে দেখতে যেতেই খোঁচা লাগল হাতে। কুটুস করে কি যেন বিধল।
আউক! করে হাতটা সরিয়ে এনে তাকাল। খাইছে! দুটো ফুটো। ভ্যাম্পায়ারে দাঁত বসালে যেমন হয়। দুই ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এসেছে। চুষে ফেলতে গিয়ে থমকে গেল। ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপে এসে এ ভাবে রক্ত খাবে! নিজেও ভ্যাম্পায়ার হয়ে যাওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি মুখ সরিয়ে আনল।
যাবে কি করে ওপাশে, ভাবনায় পড়ে গেল সে। কাটার জন্যে ছোঁয়াও যাচ্ছে না।
ব্যাকপ্যাক থেকে একটা গজাল টেনে বের করল। ঢুকিয়ে দিল লতার দঙ্গলের মধ্যে। চাড় মেরে মেরে ফোকর বড় করতে লাগল। তাকাল তার ভেতর দিয়ে।
বাড়িই আছে ওপাশে একটা। দ্বীপের অন্য বাড়িগুলোর তুলনায় মোটামুটি অক্ষত। আলো ফুরিয়ে আসার আগেই কাজ সারার তাগিদে দ্রুত হাত চালাল সে। ফোকরটা বড় করে ফেলল যাতে কোনমতে গলে অন্যপাশে চলে যেতে পারে। গজালটা আবার ব্যাগে ভরল।
কিন্তু কাঁটার জন্যে ফোকর গলে যাওয়াও এক ঝকমারি। কাপড়ে আঁকড়ে ধরল কাটা, ব্যাগ টেনে ধরল, হাতের, মুখের চামড়া ছড়ে গেল। সব কিছু সহ্য করেই আসতে হলো অন্যপাশে।
আকাশের দিকে তাকাল। বন্ধ হওয়ার পর আর শুরু হয়নি বৃষ্টি। মেঘের দল টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে ছুটতে আরম্ভ করেছে। কেউ যেন তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে ওগুলোকে। নেকড়ের দল! মনে পড়ল আবার।
সূর্য ডোবার আর কত বাকি? কতটা সময় হাতে আছে আর?
বাড়িটার দরজার কাছে এসে দাঁড়াল সে। নব চেপে ধরে মোচড় দিতে সহজেই ঘুরে গেল। ঠেলা দিতে ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে আটকে গেল পাল্লা। কোন কিছুতে লেগে গেছে।
জোরে ঠেলা দিল সে।
সামান্য একটু খুলে আবার আটকে গেল।
গায়ের জোরে ঠেলতে শুরু করল সে। যাতে আটকে ছিল, মেঝেতে ঘষার শব্দ তুলে সরে যেতে লাগল সেই জিনিসটা।
ফুটখানেক ফাঁক হতেই আর খোলার চেষ্টা করল না সে। তার মধ্যে দিয়েই চেপেচুপে কোনমতে ঢুকে পড়ল।
অন্ধকার ঘর। দরজা দিয়ে যা সামান্য আলো আসছে। আর কোনদিক দিয়ে আসার পথ নেই আর।
যার চোখে অন্ধকার সয়ে আসার অপেক্ষা করতে লাগল। চোখে পড়ল একটা ড্রেসার। এটাই দরজা আটকে রেখেছিল।
ধীরে ধীরে নজরে এল পুরো ঘরটাই। একটা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছে সে। অদ্ভুত গন্ধ। আগুনের কুণ্ড করে নিভিয়ে ফেলার পর যা হয় অনেকটা সেরকম।
সমস্ত ঘরে ঘুরে বেড়াতে লাগল তার দৃষ্টি। পুরো ঘরটাই প্রায় খালি।
আরেকটা দরজা দেখে সেটা দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল। এই ঘরটা আরও বেশি অন্ধকার। ভেজা বাতাস। ভাপসা গন্ধ। কোণে কোণে অন্ধকার ছায়া। রান্নাঘর দিয়ে আসা আলোয় সে-অন্ধকার কাটছে না। দেখা যায় মোটামুটি।
দেয়ালগুলোর দিকে তাকাল সে। জানালা আছে। তবে তক্তা লাগিয়ে। পেরেক ঠুকে আটকে দেয়া হয়েছে।
ছায়াতে কি আছে দেখার চেষ্টা করল।
এককোণে ওটা কি?
আরে একটা নয়, তিনটে। ছায়া এতই গভীর, বোঝা যায়নি প্রথমে।
তিনটে আয়তাকার বাক্স পড়ে আছে।
কফিন!
দম বন্ধ করে ফেলল সে। তিনটে কেন? দুটোতে কিমি আর ডলি। তৃতীয়টায় কে আছে?
কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল বুকের মধ্যে। যা খুঁজতে এসেছিল পেয়েছে। পাওয়া গেছে ভ্যাম্পায়ারের গোপন আস্তানা।
সাবধান রইল কোন রকম শব্দ যাতে আর না হয়। দরজা খোলার সময় যেটুকু করে ফেলেছে, ফেলেছে। ওই শব্দে যদি জেগে গিয়ে না থাকে, ভাল। জাগাতে চায় না। আস্তে করে নামিয়ে রাখল ব্যাকপ্যাকটা। একটা গজাল। বের করে রাখল একটা কফিনের পাশে। হাতুড়িটা মাথার ওপর তুলে, বাগিয়ে ধরে রেখে, টান দিল কফিনের ডালা ধরে।
তুলেই থমকে গেল। ভেতরে বিছানা আছে। কিন্তু মানুষ নেই।
হাতের তালু রেখে বিছানাটা ছুঁয়ে দেখল। গরম। তারমানে এইমাত্র বেরিয়েছে। নিশ্চয় দরজা খোলার শব্দে জেগে বেরিয়ে গেছে।
সোজা হয়ে দাঁড়াল মুসা। পেছনে শব্দ হলো।
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে।
ধড়াস করে উঠল বুক। একটা হার্টবীট মিস হয়ে গেল। পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লম্বা এক লোক। কালো আলখেল্লা, মুখ ভর্তি দাড়ি, ব্যাকব্রাশ করা চুল, ফ্যাকাসে চেহারা–সব মিলিয়ে একেবারে ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা। ট্রানসিলভানিয়ার দুর্গ থেকে বেরিয়ে এসেছে যেন।
তবে এই ড্রাকুলার হাতে পিস্তল আছে। খসখসে গলায় হুকুম দিল, কোন শয়তানি করার চেষ্টা করলেই গুলি খাবে। এখানে কি জন্যে এসেছ?