নাকে মুখে বাড়ি মারতে লাগল মুসা। তেলে দিল কটা। দরজা দিয়ে আসা আলোয় দেখতে পেল রক্ত বেরোচ্ছে নেকড়ের নাক থেকে। গুঙিয়ে উঠল ওটা। ভীষণ রাগে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মুসার বুকে।
কানের পাশে বাড়ি মারল মুসা। মোক্ষম আঘাত। কাত হয়ে পড়ে গেল নেকড়েটা। ঠেলা মেরে বুকের ওপর থেকে নেতিয়ে পড়া প্রাণীটাকে সরিয়ে দিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল সে। মরেনি এখনও। চোখ মিটমিট করে তাকাচ্ছে। ব্যথাটা সহ্য হয়ে গেলেই আবার উঠে দাঁড়াবে। আবার কামড়ে ছিঁড়তে আসবে ওকে। সুযোগ দেয়া যাবে না। তাড়াতাড়ি ব্যাকপ্যাক থেকে একটা কাঠের গজাল বের করে চোখা মাথাটা ঠেসে ধরল নেকড়ের হৃৎপিণ্ড বরাবর। বাড়ি মেরে মেরে ঢুকিয়ে দিল যতখানি যায়।
থরথর করে কেঁপে উঠল নেকড়ের শরীরটা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এল গজালের চারপাশ থেকে। ঠিক মুমূর্ষ কুকুরের মত আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে লাগল মুখ দিয়ে।
গজাল বেঁধা নেকড়ে! ভয়ানক দৃশ্য তাকাতে পারল না আর মৃণা! নেকড়ের মতই থরথর করে কাঁপতে লাগল সে-ও। মায়াই লাগছে প্রাণীটার। জন্যে। না মেরে উপায় ছিল না। না মারলে তাকে মরতে হত।
ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে হাতুড়ি হাতে ছুটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। ভেতরে আর কেউ আছে কিনা দেখারও প্রয়োজন বোধ করল না। ভয়ঙ্কর নেকড়ের সঙ্গে একঘরে বাস করার কথা নয় কারও।
কথাটা মনে হলো এই সময়–পোষা নেকড়ে নয় তো ওটা? তাই হবে। নইলে এত বিপজ্জনক একটা প্রাণীর সঙ্গে বাস করার সাহস হত না কিমি আর ডলির। তা ছাড়া এই দ্বীপে নেকড়ে আসবেই বা কোথা থেকে। দ্বীপ পাহারা দেয়ার জন্যেই রাখা হয়েছে প্রাণীটাকে। ঠিক। কাউন্ট ড্রাকুলার প্রহরী। ট্রানসিলভানিয়ার সেই দুর্গের মত। এর আগের বার যখন এসেছিল সে, তখনও ছিল ওটা। আগুনের ভয়ে নিশ্চয় কাছে আসেনি সেবার। একটাই আছে? না আরও? সাবধান থাকতে হবে। কোনদিক থেকে এসে ঘাড়ে পড়বে কে জানে। সাবধান থেকেও কতটা লাভ হবে বলা যায় না। দল বেঁধে এসে একযোগে আক্রমণ চালালে কিছুই করার থাকবে না ওর মুহূর্তে টেনে, ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।
বাড়িটার কাছ থেকে সরে এসে দ্রুত অন্য বাড়ির খোঁজে হাঁটতে লাগল।
বুনো পথে চলতে গিয়ে দিরে বেলাতেও গা ছমছম করতে লাগল। ভূতুড়ে বন। সত্যি সত্যি ভূত থাকলেও এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ভয় তার শক্তি কেড়ে নিয়েছে যেন। পা দুটো অসম্ভব ভারী লাগছে। বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে।
পাওয়া গেল আরেকটা বাড়ি। একটা পাশ ধসে পড়েছে। ঢুকে কিছু পেল না।
একের পর এক বাড়িতে ঢুকে দেখতে লাগল সে। কোনটাতেই কফিন দেখল না। কিমি আর ডলিকে পেল না। যে ঘরেই তাক, আলমারি, সিন্দুক রয়েছে, কোনখানে খোঁজা বাকি রাখল না।
কিন্তু কিমিও নেই। ডলিও না। কোন চিহ্নই নেই ওদের। গেল কোথায়? কোন্খানে আছে?
ছোট্ট এক টুকরো খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল সে। ঘড়ি দেখল। তিনটে পঁয়তাল্লিশ। আগের বার যখন দেখেছিল, তখনও ছিল তিনটে পঁয়তাল্লিশ। হঠাৎ খেয়াল করল, সেকেন্ডের কাটাটা চলছে না। এই ব্যাপার! বন্ধ হয়ে গেছে। ঘড়ি। নেকড়ের সঙ্গে ধস্তাধস্তির সময় বাড়ি লেগে নিশ্চয়।
সময় বোঝার উপায় নেই আর। কতক্ষণ ধরে রয়েছে বলতে পারবে না। সূর্য ডোবার কত দেরি, তাও জানা গেল না।
বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু ভারী মেঘে ঢেকে রেখেছে আকাশ। সময় অনুমান করা কঠিন। তবে সন্ধ্যা বোধহয় হয়ে গেছে। আলো নিভে যাওয়ার আগেই কিমি আর ডলিকে খুঁজে বের করতে না পারলে আজকের মত ফিরেই যেতে হবে। রাতের বেলা অন্ধকারে ওদের খুঁজতে যাওয়াটা হবে চরম বোকামি। খুঁজে পাবেও না। ওদিকে মারাত্মক বিপদের ঝুঁকি নিতে হবে। আরও নেকড়ে থেকে থাকলে রাতের বেলা ভয়ানক বিপদে পড়বে।
কিশোর কোথায়? কাউকে নিশ্চয় খুঁজে পায়নি এখনও। তাহলে যোগাযোগ করত ওর সঙ্গে। নাকি বিপদে পড়ল? চিৎকার তো শোনা যায়নি।
খোলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল মুসা। কোনদিকে যাবে বুঝতে চাইছে। বনের ভেতর থেকে ভেসে এল একটা কাঁপা কাঁপা ডাক। নেকড়ে! তারমানে আরও আছে! দূর থেকে শেয়ালের ডাকও অনেক সময় নেকড়ের মত লাগে। তবু, খারাপটা ভেবে রাখাই ভাল। প্রাণীটাকে নেকড়ে ধরে নিল সে।
রাতের আর কত বাকি? রাত পর্যন্ত কি অপেক্ষা করবে ওটা? একটাই আছে আর, না আরও বেশি?
ভুল করে আবার তাকাল ঘড়ির দিকে। তাকিয়েই মনে পড়ল নষ্ট। সেই তিনটা পঁয়তাল্লিশই বাজে। বাদুড়েরা এখনও বেরোয়নি। ওরা বেরোতে শুরু করলেই বুঝতে হবে সন্ধ্যা লেগে গেছে।
কিশোরকে ডাকার কথা ভাবল। চিৎকার করতে হবে তাহলে। নেকড়ের কানে যাবে সেই ডাক। হয়তো কিশোরের আগে ওরাই ছুটে আসবে। বনের ভেতর দিয়ে হাঁটতেও এখন ভয় লাগছে। কিন্তু উপায় নেই। নৌকার কাছে যেতে হলেও বনের ভেতর দিয়েই যাওয়া লাগবে।
নৌকা! তাই তো! এখান থেকে কতখানি দূরে, অনুমান করতে পারল না। সাগরের খোলা দিকটা দিয়ে খালে ঢুকেছিল। খুঁজে বের করতে সময় লাগবে। নেকড়ের তাড়া খেলে এখন পৌঁছতে পারবে না ওটার কাছে।
আতঙ্ক যেন চেপে ধরল ওকে। গাছপালার ফাঁকে ঘুরে বেড়াতে লাগল চঞ্চল দৃষ্টি। যেখানে দাঁড়িয়ে আছে জায়গাটা ঘাসে ছাওয়া। ভাল করে তাকাতে চোখে পড়ল একজায়গার ঘাস চ্যাপ্টা হয়ে আছে। কেউ মনে হয় হেঁটে গেছে এখান দিয়ে।