ওটার দিকে নৌকা বাইতে লাগল মুসা। ঢেউয়ের জন্যে বাইতে খুব অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু হাল ছাড়ল না সে।
খালের প্রবেশ মুখে ঢুকতেই ঢেউয়ের অত্যাচার কমে গেল। মাথার ওপর খাড়া হয়ে আছে বড় বড় গাছ। ছাতার মত ছড়িয়ে আছে ডালপালা। কিছু ডাল পানির ওপর ঝুঁকে পড়ে পানি ছুঁই ছুঁই করছে।
কুচকুচে কালো লাগছে পানির রঙ। তার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে ভেসে এগিয়ে চলল নৌকা। আগের বারের কথা মনে পড়ল মুসার। রাত ছিল। মাথার ওপরে উড়ছিল অগণিত বাদুড়। বনের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল নেকড়ের ডাকের মত ডাক। বাদুড়রা দিনে ওড়ে না, কিন্তু নেকড়ে যে কোন সময় হামলা চালাতে পারে। যদিও এখন ডাক শোনা যাচ্ছে না, তবু। সাবধান থাকতে হবে। কোন্দিক দিয়ে এসে ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কোন ঠিক নেই। তা ছাড়া মেঘলা বনের চেহারা রাতের চেয়ে কম ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে না।
ওদিকে নিয়ে যাও, হাত তুলে দেখাল কিশোর। বন ওখানে ঢালু হয়ে নেমে এসেছে পানিতে। নৌকা রেখে যাওয়ার উপযুক্ত জায়গা।
নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিল মুসা। নরম মাটিতে ঠেকল নৌকার তলা। লাফ দিয়ে মাটিতে নেমে দড়িটা একটা গাছের ডালে বেঁধে ফেলল সে।
ব্যাকপ্যাক দুটো ওর দিকে ছুঁড়ে দিল কিশোর। তীরে নামল।
ভারী দম নিল মুসা। বাতাসে একধরনের ভেজা ভেজা ভাপসা গন্ধ। যাব?
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। উত্তেজনায় চকচক করছে চোখ।
দ্বীপটা যে এত ছোট, আগে বোঝেনি মুসা। আগের বার পুড়িয়ে রেখে যাওয়া বীচ হাউসটার কাছে পৌঁছতে কয়েক মিনিটও লাগল না। ওটার দিকে। এগোতে গিয়ে আরও কতগুলো প্রায় একই ধরনের বাড়ি চোখে পড়ল। বাড়ি মানে বাড়িঘরের কঙ্কাল, ধ্বংসাবশেষ।
কফিনগুলো খুঁজে বের করব কি করে? ঘড়ির দিকে তাকাল মুসা। বিকেল তো হয়ে এল। দুজন দুদিকে গিয়ে খুঁজব নাকি? তাতে সময় বাঁচবে।
সত্যি কি লাভ হবে তাতে? ব্যাগটা হাত বদল করল কিশোর।
একা হতে ভয় পাচ্ছ নাকি?
দ্বিধা করল কিশোর। মাথা ঝাঁকিয়ে স্বীকার করল, পাচ্ছি না বলা যাবে না। খুনীদের সঙ্গে লাগতে এসেছি আমরা। সাধারণ খুনী নয়, একেবারে পিশাচ, জীবন্ত মানুষের গা থেকে রক্ত চুষে চুষে খেয়ে খুন করে। ওদের পক্ষে সব সম্ভব। এটা ওদের রাজত্ব। ধরে, বেধে রক্ত খেয়ে যদি লাশগুলো সাগরে ভাসিয়ে দেয় কিচ্ছু করার থাকবে না আমাদের।
ধরো কফিনে শোয়া অবস্থায় পাওয়া গেল ওদের। কি করব? গজাল ঢুকিয়ে দেব হৃৎপিণ্ডে?
না। খুন হয়ে যাবে সেটা। শুধু ভয় দেখাবে।
যদি ভয় না পায়?
পিটিয়ে বেহুশ করার চেষ্টা করবে।
তারপর?
কফিনের ডালা আটকে রেখে চলে যাব, যাতে বেরোতে না পারে। পুলিশ নিয়ে ফিরে আসব।
একে অন্যকে গুডলাক বলে দুজন দুদিকে রওনা হয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকিয়ে মুসা দেখল, কালো একটা বাড়ির কঙ্কালের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে কিশোর। ঘুরে দাঁড়াল মুসা। ডানের আরেকটা কঙ্কালের দিকে এগিয়ে চলল সে। দরজার কাছে এসে দ্বিধা করল। তারপর যা থাকে কপালে ভেবে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখে সইয়ে নেয়ার জন্যে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ড পরেই বুঝতে পারল, ঘরে আরও কেউ রয়েছে।
.
২০.
দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল মুসা।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের অন্ধকারের দিকে। ব্যাগটা হাতে ঝোলানো। চেন খুলে গজাল বের করতে সময় লাগবে। ততক্ষণে আক্রমণ করে বসবে ঘরে যে আছে। ডলি কিংবা কিমিকে ভয় করে না সে। দুটো মেয়ে কিছুই করতে পারবে না ওর। তার ভয়, কাউন্ট ড্রাকুলাকে। পালের গোদা। পুরুষ মানুষ। সঙ্গে পিস্তল থাকা অস্বাভাবিক নয়।
খুট করে একটা শব্দ হলো।
তাকাল সেদিকে।
খুব আবছাভাবে নড়াচড়া চোখে পড়ল। মৃদু গরগর কানে এল। রেগে গেলে কুকুর যা করে।
হঠাৎ বুঝে ফেলল প্রাণীটা কি। নেকড়ে!
মহাসঙ্কটে পড়ে গেল মুসা। কি করবে? এগোনোর প্রশ্নই ওঠে না। পিছানোও বিপদ। মুহূর্তে এসে আক্রমণ করে বসবে নেকড়েটা।
জিম করবেটের মানুষখেকো বাঘ শিকারের কাহিনী মনে পড়ল। চৌগড়ের ভয়াবহ বাঘিনীর মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিলেন একবার তিনি। হাতে ছিল রাইফেল। বাঘিনীটা এতটাই কাছে ছিল তাঁর, কোন রকম নড়াচড়া করতে গেলেই ঝাঁপিয়ে এসে পড়ত। খুব ধীরে ধীরে হাতের রাইফেলটা ঘুরিয়ে টার্গেট করে তারপর গুলি করেছিলেন।
সেই বুদ্ধিটাই কাজে লাগাল এখন সে। খুব ধীরে যেন অনন্তকাল ধরে। চেষ্টা করে নেকড়েটাকে চমকে না দিয়ে হাতের ব্যাকপ্যাকটা প্রায় পেটের ওপর নিয়ে এল। অন্য হাতটা আনল চেনের ওপর। করবেটের মত অতটা সাবধান থাকতে পারেনি, নড়াচড়া বোধহয় একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে গেল নেকড়ের গরুগরানি। হাতটা যেভাবে আছে সেভাবেই রেখে দিল সে। একেবারে স্থির। গরগর কমলে চেন খুলতে শুরু করল। ব্যাগের ভেতর হাত ঢোকাল। আঙুলে ঠেকল হাতুড়ির বাট। ঠিক এই সময় আক্রমণ করে বসল নেকড়ে।
একসঙ্গে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেল। হাত থেকে ব্যাগটা ছেড়ে দিল মুসা। টান দিয়ে বের করে আনল হাতুড়ি। নেকড়েটা এসে ওর গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই হাতুড়ি ঘুরিয়ে আন্দাজে বাড়ি মারল।
থ্যাপ করে একটা আওয়াজ হলো। বাড়িটা লাগল নেকডের পেটে। ভয়ঙ্কর গর্জন করে মুসার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওটা।
পড়ে গেল মুসা। হাতুড়ি ছাড়ল না। চিত হয়ে পড়েছে। ওই অবস্থাতেই আবার বাড়ি মাবল লাগল নেকড়ের গলায়। প্রচণ্ড ব্যথায় আবার গর্জে উঠে থমকে গেল প্রাণীটা। পরক্ষণে দাঁত বের করে মুসার টুটি কামড়ে ধরতে এলো।