কিশোর আগেই উঠে বসে আছে।
ডক হাউসের ভেতরে মৃদু ঢেউয়ে দুলছে নৌকা।
হুডওয়ালা প্লাস্টিকের রেইন কোট পরে এসেছে দুজনেই। হুড তুলে দিয়ে শক্ত হয়ে বসল মুসা।
মাত্র দুপুর হয়েছে। কিন্তু কালো মেঘে এতটাই ভারী হয়ে গেছে আকাশ, প্রায় রাতের মত অন্ধকার। দাঁড়ের আঙটায় দাঁড় ঢুকিয়ে দিয়ে বাইতে শুরু করল সে।
গলুইয়ের কাছে বসেছে কিশোর। এদিকে মুখ করে। শক্ত হয়ে আছে। চোয়াল। চোখে কঠিন দৃষ্টি। বোঝা যাচ্ছে বন্ধুদের খুনের প্রতিশোধ নিতে মুসার মতই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে।
রবিন এলে ভাল হত। সাহায্য করতে পারত। কিন্তু এতটাই অসুস্থ সে, বিছানা থেকে উঠতে কষ্ট হয়। তা ছাড়া সারারাত জেগে থাকার উত্তেজনা আর পরিশ্রমে আরও বেশি কাহিল হয়ে পড়েছে।
নৌকার পাটাতনে পড়ে আছে দুটো নাইলনের ব্যাগ। দুটোতে একই জিনিস আছে। কাঠের চোখা গজাল। বড় হাতুড়ি। ভ্যাম্পায়ার ধ্বংস করার সরঞ্জাম। কিশোরের বুদ্ধিতে নেয়া হয়েছে এসব। এগুলো দিয়ে কি করবে কিশোর, জানে না মুসা। বেকায়দায় পড়লে খুন করবে নাকি মানবভ্যাম্পায়ারের বুকে গজাল ঢুকিয়ে!
রোদ থাকলে ভাল হত, কিশোর বলল। বিচ্ছিরি আবহাওয়া।
ভ্যাম্পায়ারের জন্যে চমৎকার।
কি জানি। চাঁদনী রাতে বেরিয়েও ভ্যাম্পায়াররা আনন্দ পায়।
পাবেই। আধামানুষ তো! মানুষেরা যাতে যাতে আনন্দ পায়, ওরাও পায়।
মানুষেরা মানুষের রক্ত খায় না।
কে বলল? নরখাদকদের কাহিনী ভুলে গেছ? এই শতকের গোড়ার দিকেও আফ্রিকার জঙ্গল আর প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক দ্বীপে মানুষখেকো মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে।
তা ঠিক, আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল মুসা। মনে হচ্ছে আগামী পুরো হপ্তাটায়ই বৃষ্টি থাকবে। থাকুকগে। ভ্যাম্পায়ারগুলোকে খতম করতে পারলে আর থাকব না এখানে। বাড়ি ফিরে যাব।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর, কিন্তু যে হারে অন্ধকার হচ্ছে…
বৃষ্টির বেগ খানিকটা বাড়ল। রেইন কোর্টের ওপর ফোঁটা পড়ার একটানা আওয়াজ হতে থাকল পুট পুট করে। সাগর শান্ত। ঢেউ এতই কম, হ্রদের পানির মত লাগছে। তাতে সুবিধে হয়েছে। নৌকার গতি বেশি। দ্রুত এগিয়ে চলেছে দ্বীপের দিকে।
ভয় লাগছে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
হ্যাঁ। তবে কাজ সারতেই হবে। স্যান্ডি হোলোতে এই ভ্যাম্পায়ারের ব্যবসা খতম করে ছাড়ব আজ। তোমার ভয় লাগছে না?
না, হাসল মুসা। ভয় তো ভূতকে। মানুষকে আবার কিসের ভয়?
কিন্তু মানুষকেই ভয় করা উচিত। কারণ ওরা বাস্তব। ক্ষতি করার ক্ষমতা সীমাহীন।
চুপ হয়ে গেল মুসা। এই তর্কের শেষ নেই। সে ভুত বিশ্বাস করে, কিশোর করে না। অতএব যুক্তি দেখানোরও শেষ হবে না।
কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে তাকিয়ে দ্বীপটা দেখল মুসা। কাছে চলে এসেছে। মেঘলা অন্ধকারের মধ্যে সামনে খাড়া হয়ে রয়েছে কালো দেয়ালের মত। জিনাকে নিতে এসে রাতের বেলা দেখেছিল সেদিন। দিনের বেলা অনেক বেশি ভয়ঙ্কর মনে হলো আজ।
দেখেই মনে হয় শয়তানের ঘাটি, কিশোর বলল।
হ্যাঁ, সত্যি সত্যি শয়তান বাস করে ওখানে।
আরও কাছে এলে গাছগুলোকে আলাদা করে চেনা গেল। দ্বীপের কিনারে ঘন হয়ে জন্মেছে বড় বড় গাছ।
বরফ শীতল এক ফোঁটা ঘাম ঝরে পড়ল মুসার কপাল থেকে। কেঁপে উঠল সে।
পুরানো ডকটা রাতের বেলা দেখেছে। কোনখানে ছিল, মনে করতে পারল না। আন্দাজে এগিয়ে চলল। তীরের একপাশ থেকে আরেক পাশে চোখ বোলাল। কিন্তু দেখতে পেল না ওটা।
কোথায়? কোনখানে ছিল?
তীরের আরও কাছে চলে এল নৌকা।
নাহ, নেই! গায়েব!
কি গায়েব? জানতে চাইল কিশোর।
ডকটা…ওহহো, না না আছে। মানে, ছিল।
করাতে কাটা কতগুলো তার মাথা পানি থেকে উঁকি দিয়ে আছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে কোন্খানে ছিল ডকটা। এমনভাবে কেটে নষ্ট করে ফেলেছে, নৌকা বাঁধারও কিছু নেই।
ভ্যাম্পায়ারেরাই কেটে ফেলেছে, মুসা বলল। নৌকা নিয়ে কেউ এসে যাতে ওদের গোপন ঘাঁটি খুঁজে বের করে হামলা চালাতে না পারে সেজন্যেই এই সতর্কতা। নিজেদের নৌকা ভেতরে কোন খাড়িটাড়িতে লুকিয়ে রাখে।
তাহলেই বোঝো, চোখের পাতা সরু করে ফেলল কিশোর। এই একটা ব্যাপার থেকেই বোঝা যায় ওঁরা ভুত নয়; মানুষ। কিন্তু ওরা কিছু সন্দেহ করে ফেলল নাকি? আমরা আসব বুঝতে পেরেছে।
অসম্ভব নয়। সাবধানে তীরের কাছে নৌকা নিয়ে এল মুসা। টেনে তোলার জায়গা খুঁজতে লাগল। বড় বড় পাথর আর পাথরের খাড়া দেয়াল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না।
সাঁতরে উঠলে কেমন হয়? কিশোরের প্রশ্ন।
নৌকাটা কোথায় রেখে যাব? নোঙর নেই। ভেসে চলে যাবে। তখন ফিরব কি করে?
দ্বীপটার যে পাশে খোলা সাগর, সেদিকে নৌকা নিয়ে গেল মুসা। ওপাশে বড় বড় ঢেউ। লোফালুফি শুরু করে দিল যেন নৌকাটাকে নিয়ে। এখনই ঢেউয়ের মাথায় চড়ছে নৌকা, পরক্ষণেই ঝপাৎ করে একেবারে নিচে দুই ঢেউয়ের মাঝখানের উপত্যকায়, তারপর আবার ওপরে। চলতেই থাকল এ রকম। মোচার খোলার মত দুলছে। গলুইয়ে বাড়ি খেয়ে পানি ছিটকে এসে পড়ছে চোখে মুখে।
খোলা সাগরে বেরোনোর উপযুক্ত নয় এই নৌকা, শঙ্কিত হয়ে বলল কিশোর। দুই হাতে দুদিকের কিনার চেপে ধরে রেখেছে। ভেতরের দিকটাতে থাকাই উচিত ছিল।
তীরের কাছে একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল মুসার। চিৎকার করে উঠল, দেখো, ঢোকার মুখ!
কিশোরও দেখল। একটা খালমত ঢুকে গেছে দ্বীপের ভেতরে।