আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, মাথা নাড়ল রবিন। কিশোর, সব কথা যদি খুলে না বলল, তুমিও পাগল হয়ে গেছ ভাবতে বাধ্য হব। ভাবব, স্যান্ডি হোলোতে এসে মুসা আর জিনাকে যে রোগে ধরেছে, তোমাকেও সেই রোগে ধরেছে। সত্যি কি তুমি ভূত বিশ্বাস করছ?
মাথা নাড়ল কিনোর, না। তবে ভ্যাম্পায়ার বিশ্বাস করছি। কারণ, আছে ওরা। নিজের চোখে দেখেছি। তবে এ ভ্যাম্পায়ার ভূত নয়, ভূতেরও বাড়া, মানুষরূপী পিশাচ। সেই প্রাচীনকাল থেকেই ব্ল্যাক ম্যাজিক, জাদুটোনায় বিশ্বাস করে আসছে মানুষ। ভেবেছে, শয়তানের উপাসনা করে তাকে ভজাতে পারলে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যায়। ভ্যাম্পায়ার হওয়ার চিন্তাও সেই বিশ্বাসেরই কুফল।
ব্রাম স্টোকার ড্রাকুলা লেখার বহু আগে থেকেই ভ্যাম্পায়ারের কথা জানত মানুষ। বিশেষ করে জার্মানী আর তার আশপাশের কয়েকটা দেশের লোকে। তারা নানা রকম পূজা-অর্চনার মাধ্যমে ভ্যাম্পায়ার হতে চাইত। ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্যে। তাদের আরও একটা বিশ্বাস ছিল, এই ক্ষমতা লাভ করতে পারলে অনন্তকাল বেঁচে থাকা যাবে। তবে এর জন্যে কিছুদিন বেশ কষ্ট করতে হবে। কিছু ক্রিয়াকর্ম পালন করতে হবে, বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। আসল ভ্যাম্পায়ার যা করে থাকে বলে ওদের বিশ্বাস, সেসব ওদের মত করেই পালন করতে হবে। কোন রকম উল্টোপাল্টা করলে চলবে না। এই যেমন দিনের বেলা কফিনে শুয়ে থাকা, সন্ধ্যার পর বেরিয়ে রক্ত খাওয়া–সাধনা চলাকালে অন্য কোন রকম খাবার খাওয়া চলবে না, তাহলে সব মাটি। মোট কথা ভ্যাম্পায়ার যা যা করে, ঠিক তাই তাই করতে হবে। আসল ভ্যাম্পায়ার যেহেতু ভূত, তার অনেক ক্ষমতা, কিন্তু বাস্তব মানুষের তো আর সে-ক্ষমতা নেই। মানুষের রক্ত খাওয়ার জন্যে তাই নানা কৌশল আর ওষুধের আশ্রয় নিতে হয়। শিকারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে তাকে সম্মোহন করে ভোলাতে হয়, সুযোগমত ওষুধ শুকিয়ে তাকে বেহুশ করতে হয়, তারপর দাতে লাগানো কৃত্রিম ধাতব দাঁত দিয়ে গলার শিরা ফুটো করে রক্তপান করতে হয়। অকাল্টের বই পড়ে জেনেছি এ সব।
যাই হোক, পুরানো আমলেও গুরু থাকত এদের, এখনও আছে। এখানে যে দলটা আছে, তাদের গুরুর নামটা নিশ্চয় শুনেছ তোমরা, বেশ গালভরা–কাউন্ট ড্রাকুলা…
কোথায় আছে ব্যাটা! দাঁতে দাঁত চাপল মুসা। নাম বলো। ধরে এয়সা ধোলাই দেব…।
বলছি, হাত তুলল কিশোর, তাকে কোনমতেই ছাড়া হবে না। তবে আগে জানতে হবে কোথায় আছে সে, কোন ঠিকানায়। চ্যালাগুলোকে পুলিশে ধরে ধোলাই দিলেই সুড়সুড় করে নাম বলে দেবে।
তাহলে চলো, এখনই ধরব। কিমি আর ডলি তো? দুই মিনিটও লাগবে। কাবু করে ফেলতে। থাকে কোনখানে?
কেন, আন্দাজ করতে পারছ না? জন আর লীলা কোনখানে ছিল?
ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপ!
হ্যাঁ, এতে অবাক হওয়ার কি আছে? ঘাটি হিসেবে এত চমৎকার জায়গা আশেপাশে আর কোথায় আছে?
তা বটে। আমি মনে করেছি, জন আর লীলাকে যেহেতু ওখানেই খতম করা হয়েছে, জায়গা পাল্টাবে ওরা, ধরা পড়ার ভয়ে ওখানে থাকতে আর সাহস করবে না…কিন্তু বাড়িটা তো পুড়ে গেছে?
একটা পুড়েছে। আরও অনেক বাড়ি আছে ওখানে।
চলো তাহলে। এখনই যাব।
অত তাড়াহুড়া নেই। সারারাত জেগে ওরা দিনের বেলা বেহুশের মত ঘুমাবে কফিনের মধ্যে। তৈরি হয়ে যেতে হবে আমাদের। সারারাত জেগেছি, আমাদেরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়া দরকার। তারপর বেরোব। বলা যায় না, কিমি আর ডলি বাদেও ওখানে আরও লোক থাকতে পারে। কাউন্ট ড্রাকুলা নামে বদমাশটাও হয়তো ওই দ্বীপেই থাকে, ভিন্ন কোন বাড়িতে। লড়াই করে ওদের কাবু করতে হলে শক্তি দরকার।
গলায় হাত বোলাতে বোলাতে রবিন বলল, আমার গলার দাগ দুটো তাহলে কিসের? নিশ্চয় পোকার কামড়ই হবে। আমি তো রাতে একা ওই দুই ভ্যাম্পায়ারের কারও ত্রিসীমানায়ও যাইনি।
তুমি না গেলে কি হবে? ভুরু নাচাল কিশোর। ওরা এসেছিল তোমার কাছে। ডলির কাজই হবে। ওটার খিদেই বেশি। তুমি এমনিতে অসুস্থ মানুষ। রাতের বেলা মরার মত ঘুমিয়েছ। চুরি করে বোর্ডিঙে তোমার ঘরে ঢুকে তখন রক্ত খেয়ে এসেছে। ঘুমের মধ্যেই ওষুধ শুকিয়ে নিশ্চয় বেহুশ করে নিয়েছিল তোমাকে। সেটা করা এমন কোন কঠিন কাজ নয়।
শয়তানের দল! শিউরে উঠল রবিন।
তোমাকেও খতম করে দিত ওরা। বেঁচে গেছ মুসার জন্যে। ও তোমার ওপর এমনভাবে চোখ রাখা আরম্ভ করেছিল, বেশি সাহস করতে পারেনি ডলি। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে।
কৃতজ্ঞ চোখে মুসার দিকে তাকাল রবিন। আবার ফিরল কিশোরের দিকে। টনির কিছু করল না কেন তাহলে কিমি?
ওই একই কারণ, ধরা পড়ার ভয়। পিছে পিছে থেকে সিসি বাঁচিয়ে দিয়েছে ভাইকে। তবে টনিকেও ছাড়ত না ওরা। সুযোগমত ঠিকই সাবাড় করত। ওকে খাঁচায় পোরা মুরগী ভেবেছিল আরকি। যখন ইচ্ছে খাওয়া যাবে।
ঘড়ি দেখল কিশোর। চলো। অনেক বকবক করা হয়েছে। ঘুমানো দরকার।
ঘুমের কথায় হঠাৎ আবার দুর্বল বোধ করতে লাগল রবিন। এতক্ষণ উত্তেজনায় খেয়াল ছিল না। মুসার দিকে তাকাল, একা যেতে সাহস পাচ্ছি না।
হাসল মুসা, ভ্যাম্পায়ারের ভয়?
না, ভীষণ দুর্বল লাগছে। মাথা ঘুরে যদি পড়ে যাই।
চলো। আমি যাচ্ছি সঙ্গে।
.
১৯.
টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। দড়ি খুলল মুসা। লাফ দিয়ে উঠে পড়ল নৌকায়।