বেসমেন্ট থেকে বেরোনোর দুটো দরজা। একটা দিয়ে ঢুকেছে ওরা। অন্যটা দিয়ে বেসমেন্ট থেকে সরাসরি বাইরে যাওয়া যায়।
কোন জানালা নেই।
এক্কেবারে নিখুঁত। এ রকম ঘরই দরকার ছিল।
বহু বছর ধরে নাটক হচ্ছে এই থিয়েটারে। নানা রকম জিনিসে বোঝাই # করে রাখা হয়েছে ঘরটা। প্লাস্টিকে মোড়ানো পোশাক ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে একদিকের দেয়ালে। তার ওপরের তাকগুলোতে নানা ধরনের হ্যাট। পুরুষের। মহিলাদের।
একটা কাঠের বাক্সের ওপর বসে পড়ল মুসা। দুটো টুল খুঁজে নিয়ে তাতে বলল রবিন আর কণিকা।
সকালের অপেক্ষায় থাকতে হবে এখন। আর কিছু করার নেই। রবিন আর মুসা দুজনে একই কথা ভাবছে। কণিকাকে আটকে রাখতে হবে সূর্যোদয়। পর্যন্ত।
ভিজেছে তিনজনেই। ভেজা চুল নিয়ে অনুযোগ করতে থাকল কণিকা। মুসা লক্ষ করল, ওর হাতে ঘড়ি নেই। তাতে আরও ভাল হয়েছে। সকাল হলো কিনা, বুঝতে পারবে না কণিকা। এ
রবিনের চোখে শীতল দৃষ্টি। একে শরীর খারাপ। তার ওপর মুসার এসব পাগলামি তার পছন্দ হচ্ছে না।
সবই বুঝছে মুসা। বলল না কিছু। সকাল হোক। রোদের আলো এসে পড়ুক কণিকার গায়ে। ওই দৃষ্টি আর থাকবে না রবিনের।
কথা বলতে লাগল সে। কিন্তু রবিন তাতে যোগ দিতে পারল না বিশেষ। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে শরীর। শুয়ে পড়তে চাইছে। কিন্তু শোয়ার জায়গা নেই বলে বসেই থাকতে হলো।
কটা বাজে? অবশেষে জিজ্ঞেস করল কণিকা।
সোয়া তিনটে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিথ্যে কথা বলল মুসা। বাজে আসলে অনেক বেশি। ভোরের আলো ফোঁটার সময় হয়ে গেছে প্রায়। আর পনেরো মিনিট পরেই কণিকা আর ভ্যাম্পায়ার থাকবে না। জীবন্মাতের অভিশাপ মুক্ত হয়ে চিরকালের জন্যে চলে যাবে পরপারে। দুঃখ হচ্ছে না মুসার। বাঁচিয়েই দিচ্ছে বরং কণিকাকে। জীবন্ত থাকার যন্ত্রণা বড় সাংঘাতিক।
আমি আর বসে থাকতে পারছি না, রবিন বলল। এখুনি গিয়ে বিছানায় পড়তে না পারলে মারা পড়ব।
কিন্তু এই ঝড়ের মধ্যে যাবে কি করে? মুসা বলল।
এখানে থেকে তো বৃষ্টির শব্দও শুনতে পারছি না, কণিকা বলল। কমল কিনা বুঝব কিভাবে? জানালা নেই কিছু নেই। চলো, ওপরে চলে যাই।
যে নামা নেমেছে, এত তাড়াতাড়ি থামবে না বৃষ্টি।
আমি ওপরে গিয়ে দেখে আসি।
তুমি বসো। রবিন যাক। নড়াচড়া না করলে বরং কিছুটা স্বাভাবিক হবে। ও। এভাবে বসে থাকলে ঘুমিয়ে লুটিয়ে পড়বে এখানেই।
হাসল কণিকা। তা অবশ্য ঠিক। রবিন, যাও। কোক মেশিন তত আছে, ওপরে। একটা কোকটোক আনতে পারো নাকি দেখো।
দ্বিধা করতে লাগল রবিন। ওর দিকে তাকিয়ে আছে মূসা। মনে মনে তাগাদা দিচ্ছে–যাও না! দেরি করছ কেন? তীরে এসে তরী ডুবিয়ো না!
আস্তে করে উঠে দাঁড়াল রবিন। বুড়ো মানুষের মত পা টানতে টানতে এগিয়ে চলল সিঁড়ির দিকে। আধমরা লাগছে ওকে।
পাঁচ মিনিট পর তিন ক্যান কোক নিয়ে ফিরে এল সে। বৃষ্টির কথা বলল, আরও বেড়েছে। কমার কোন লক্ষণই নেই। একটা ক্যান কণিকাকে দিয়ে আরেকটা মুসাকে দিল। দেয়ার সময় চোখে চোখে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল।
ইঙ্গিতটা বুঝল মুসা। এর মানে বৃষ্টি আসলে থেমেছে। সূর্য ওঠার সময় হয়েছে।
কণিকার এখন অগ্নিপরীক্ষার সময়। মুসা জানে, এই পরীক্ষায় পাস করতে পারবে না কণিকা।
তাকে আরও পাঁচ মিনিট সময় দিল মুসা। তারপর খপ করে হাত চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। কোক খাওয়া শেষ হয়নি কণিকার। ক্যান থেকে শার্টে পড়ল অনেকখানি।
আরে! কি করছ? তীক্ষ্ণস্বরে চিৎকার করে উঠল কণিকা। ছাড়ো, ছাড়ো! হাত থেকে ছেড়ে দিল ক্যানটা। মুসার জুতোতে ছলকে পড়ল কোক।
স্থির দাঁড়িয়ে আছে রবিন। তাকিয়ে আছে কণিকার দিকে।
রবিন! চিৎকার করে উঠল মুসা। তাকিয়ে আছ কেন হাঁ করে? দরজা খোলো!
মুসা! কণিকাও চিৎকার করে উঠল, ছাড়া আমাকে!
বাইরে বেরোনোর দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল রবিন। নবে হাত রেখে ফিরে তাকাল কণিকার দিকে। বড়
রবিন! ককিয়ে উঠল কণিকা। আমাকে বাঁচাও!
টানতে টানতে ওকে দরজার দিকে নিয়ে চলল মুসা। রবিনকে বলল, খোলো! খোলো!
ছাড়া পাওয়ার জন্যে রীতিমত যুদ্ধ শুরু করে দিল কণিকা। লাথি মেরে, আঁচড়ে, খামচে অস্থির করে তুলল মুসাকে। হাত ঝাড়া দিল। শরীর মোচড়াতে লাগল। কি করছ তুমি? ছাড়ো আমাকে!
আর দ্বিধা করল না রবিন। একটানে খুলে ফেলল দরজার পাল্লা। ওপরে উঠে গেছে কংক্রীটের সিঁড়ি। রোদ উঠেছে। সিঁড়ির মাথায় এসে পড়েছে উজ্জ্বল রোদ।
কেঁদে উঠল কণিকা, তুমি না বললে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। কই? মিথ্যে কথা বললে কেন? কি করতে চাও তোমরা?
মুসার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল সে। কিন্তু পারল না। কব্জিতে আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল মুসার আঙুল।
ধাক্কা দিয়ে ওকে দরজার বাইরে বের করে দিল মুসা। ওপরে এনে ঠেলে দিল রোদের মধ্যে।
চিৎকার করে উঠল কণিকা।
.
১৮.
চোখ মুদে ফেলল মুসা। হঠাৎ করে রোদ পড়াতে মেলে রাখতে পারল না। মাথা সামান্য সরিয়ে নিয়ে আবার মেলল চোখ।
খাইছে! নিজের অজান্তেই মুসার মুখ থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা। ভাবতেই পারেনি এমন কিছু ঘটবে।
দিব্যি রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কণিকা। হাসিমুখে তাকিয়ে আছে মুসার দিকে। কিছুই হয়নি ওর।
খাইছে! আবার বলল মুসা। ঝুলে পড়ল নিচের চোয়াল। কণিকার গায়ে আগুন ধরছে না। বোমার মত ফেটে যাচ্ছে না।