ওগুলো দৃশ্যপট। নাটকের জন্যে তৈরি করা হয়েছে। মাটির নিচের ঘরে ভ্যাম্পায়ারের আস্তানার ছবি। কফিনের মধ্যে শুয়ে থাকা ভ্যাম্পায়ার।
এগিয়ে গেল মুসা। এভাবে ফেলে রাখলে নষ্ট হয়ে যাবে। ছড়িয়ে নিয়ে ঠিকমত, রোল করে কিংবা ভাঁজ করে রাখতে হবে। দেখেই যখন ফেলেছে, ঠিক করে রাখাটা তার কর্তব্য।
একটা কাপড়ের কোণা ধরে টান দিল সে।
দিয়েই থমকে গেল। চমকে উঠল ভীষণভাবে।
কাপড়টাকে ওভাবে স্তূপ করে রাখার কারণ আছে।
কাপড়ের নিচে একটা লাশ।
একজন মহিলার।
পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল মুসার। নাড়িভুড়িগুলো যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
খাইছে! একটিমাত্র শব্দ বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
মিসেস রথরক। চিত হয়ে পড়ে আছেন। দৃশ্যপটের রঙের মতই তাঁর মুখটাও ফ্যাকাসে ধূসর।
কাঁপা পায়ে হাঁটু গেড়ে বসল মুসা। ভাল করে তাকাল গলার দিকে। দুটো দাঁতের দাগ স্পষ্ট।
খোদা, আবার খুন করল ভ্যাম্পায়ার! এই লাশটাও প্রথম চোখে পড়ল। তার! কি ভাববে এখন পুলিশ?
চোখের কোণ দিয়ে একটা নড়াচড়া দেখতে পেল।
ভ্যাম্পায়ারটা কি এখনও ঘরেই আছে!
বুকের দুরুদুরু বেড়ে গেল তার। পাঁই করে পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল।
ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল একটা ছায়ামূর্তি। চিনে ফেলল।
কণিকা!
.
১৫.
গাঢ় ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। মঞ্চের পেছনে। বড় বড় হয়ে গেছে চোখ। ঠোঁট ফাঁক।
কেন? দাঁতের জন্যে? এখনও গুটিয়ে নেয়নি শ্বদন্ত?
যেন মুসার মনের কথা পড়তে পেরেই তাড়াতাড়ি মুখের কাছে হাত নিয়ে গেল কণিকা। চিৎকার ঠেকাল, না শ্বদন্ত গোপন করল, বোঝা গেল না।
আবার অভিনয় করা হচ্ছে! রাগ লাগল মুসার। বলবে নাকি এসব ভণ্ডামি বন্ধ করতে? বলবে, আমি জানি, তুমি ভ্যাম্পায়ার!
নাহ, আপাতত না বলাই ভাল।
সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভয় ঝেড়ে ফেলে গটমট করে ওর দিকে এগিয়ে গেল মুসা। মঞ্চের পেছনে ছায়ায় এসে দাঁড়াল। খপ করে চেপে ধরল কণিকার একটা হাত। হ্যাঁচকা টানে নিয়ে এল ছায়া থেকে আলোতে।
এতক্ষণে যেন লাশটাকে চোখে পড়ল কণিকার। ছোট্ট একটা চিৎকার বেরোল মুখ থেকে। চোখে ফুটল বিস্ময়। কুঁচকে গেল কপাল। নিজের অজান্তেই পিছিয়ে গেল এক পা।
এখানে কি তোমার? গর্জন করে উঠল মুসা। আমি তো জানতাম তুমি রবিনের সঙ্গে রয়েছ।
ছিলাম, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে কণিকার। কিন্তু ও অতিরিক্ত দুর্বল। হাঁটা তো দূরের কথা, দাঁড়াতেই পারছিল না। বাড়ি চলে যেতে বললাম। একটা জরুরী কথা মিসেস রথরককে জিজ্ঞেস করতে থিয়েটারে ফিরে। এসেছিলাম আমি। কিন্তু…
থেমে গেল সে।
আর ন্যাকামি করতে হবে না। মনে মনে বলল মুসা। তুমিই খুন করেছ। মহিলাকে। কোন সন্দেহ নেই আর আমার। জিজ্ঞেস করল, কতক্ষণ আগে এসেছ?
এই তো, মিনিটখানেকও হয়নি। মিসেস রথরকের লাশটা দেখে কি করব ভাবছি, এই সময় একটা শব্দ কানে এল। ভাবলাম খুনী ফিরে এল বুঝি। তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়লাম। কারণ আমাদের এই খুনীটা ডেঞ্জারাস। বাগে পেলে আমাকেও ছাড়ত না। তাই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখি তুমি।
আমি পুলিশকে ফোন করতে যাচ্ছি, মুসা বলল।
মাথা ঝাঁকাল কণিকা।
লবিতে দৌড়ে গেল মুসা। ফোন আছে ওখানে। থানায় ফোন করল। ডিউটি অফিসার বলল, কয়েক মিনিটের মধ্যে লোক পাঠাবে।
পুলিশ এবার আমাকে দেখলে খুশিতে মাথায় তুলে নাচবে! তেতো হয়ে গেল মুসার মন। আছাড় দিয়ে নামিয়ে রাখল রিসিভার। ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল, পেছনে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে কণিকা।
বুকের মধ্যে আবার ধড়াস করে উঠল মুসার। মনে পড়ল কণিকা ভ্যাম্পায়ার। একটা ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে একা এক ঘরে রয়েছে সে। তিন তিনটে খুন যে ইতিমধ্যেই করে ফেলেছে।
পিছিয়ে যেতে শুরু করল মুসা।
দেয়ালে গিয়ে পিঠ ঠেকল। কণিকার চোখে চোখ।
এক পা আগে বাড়ল কণিকা।
আরেক পা।
আর দাঁড়াল না মুসা। ঘুরে দৌড় মারল।
মুসা, শোনো, চিৎকার করে ডাকল কণিকা। দাঁড়াও। পালাচ্ছ কেন?
কিন্তু ফিরেও তাকাল না মুসা। এক ছুটে বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে। বাইরে গিয়ে পুলিশের অপেক্ষা করা বরং ভাল, নিরস্ত্র হয়ে একঘরে একটা ভয়ঙ্কর ভ্যাম্পায়ারের সঙ্গে থাকার চেয়ে।
১৬.
সৈকতে লোক চলাচল নিষিদ্ধ করে দেয়ার কথা ভাবছে পুলিশ, মুসা বলল। রবিন আর টনির সঙ্গে বসে বসে পাথর ছুঁড়ছে পানিতে।
মিসেস রথরক খুন হওয়ার পর তিন দিন পেরিয়ে গেছে। খুনীকে ধরতে পারেনি পুলিশ। কোন মোটিভ বের করতে পারেনি। তিন খুনের কোনটারই কোন কিনারা করতে পারেনি ওরা, সূত্র পায়নি।
কিন্তু মুসার ধারণা, পুলিশ আসল ব্যাপারটা জানে। ভ্যাম্পায়ারের কথা না জানলে সৈকত বন্ধ করে দেয়ার কথা মাথায় আসত না ওদের। কিন্তু পুলিশ ভূত বিশ্বাস করলে লোকে হাসবে, এই ভয়ে ঘোষণা দিতে পারছে না।
রবিনকে কথা দিয়েছে মুসা, ওর সঙ্গে ভ্যাম্পায়ারের আলোচনা আর করবে না। টনি অবশ্য খোলাখুলি কিছু বলছে না, তবে মুসা বুঝতে পারছে, সে-ও এ নিয়ে আলোচনা করতে চায় না।
একটা সান্তনার কথা–রবিনের দুর্বলতা যা ছিল, তার চেয়ে আর বাড়েনি। তবে মুখের দিকে তাকানো যায় না এখনও। কণিকা নিশ্চয় ওকে রেহাই দিয়েছে। রক্ত খাওয়া বন্ধ করেছে।
তবে, মুসা জানে, আপাতত বন্ধ করেছে। সুযোগ পেলেই আবার খাবে, কোন সন্দেহ নেই। মায়া করে ভ্যাম্পায়ার তার শিকার ছেড়ে দিয়েছে, এ কি কোনদিন হয়!