একটা উঁচু বালিয়াড়ির গায়ে কাঠের সিঁড়ি আছে। সেটা বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা। এতজনের ভারে মড়মড় করে উঠল পুরানো সিঁড়ি। ভেঙে পড়ার হুমকি দিতে লাগল।
চারপাশে তাকাল রবিন। ওরা বাদে আর কেউ নেই সৈকতে। তবে আসবে। রাত বাড়লে ভিড় বাড়ে।
চাঁদের আলোয় ঢেউয়ের মাথাগুলোকে লাগছে রূপালী মুকুটের মত। দূরে দেখা যাচ্ছে পাথরের জেটি। সাগরের মধ্যে বেশ অনেকখানি ঢুকে গেছে।
কিসের শব্দ!
আচমকা এমনভাবে কথাটা বলল রবিন, মুসা আর টনি দুজনেই চমকে উঠল। ভয় পেয়ে গেল সিসি।
শব্দটা কানে গেছে সবারই। অসংখ্য ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ।
ওই দেখো! আকাশের দিকে হাত তুলল সিসি। ওরিব্বাবা! কত বাদুড় রে!
মুসাও দেখছে। আতঙ্কের ঠাণ্ডা শিহরণ বয়ে গেল তার মেরুদণ্ড বেয়ে। তাকিয়ে আছে ওগুলোর দিকে।
অবিশ্বাস্য দৃশ্য! বিড়বিড় করল রবিন। আগের বার কিন্তু এত বাদুড় ছিল না এখানে।
কি বলেছিলাম! প্রায় ফিসফিস করে বলল মুসা। বিশ্বাস তো কয়রানি!
তুমি যা বলেছ, এখনও করছি না। পৃথিবীর বহু জায়গাতেই এ রকম বাদুড়ের ঝাক দেখা যায়। বাদুড়ের সঙ্গে ভূতের কাল্পনিক সম্পর্ক আছে বটে, কিন্তু বাস্তবেও আছে, এ আমি বিশ্বাস করি না।
ভাইয়ের গা ঘেঁষে বসল সিসি। শীতে না ভয়ে বোঝা গেল না। তবে যতদূর জানে মুসা আর রবিন, ভয়ডর একটু কমই আছে মেয়েটার।
আসছে তো আসছেই। বাদুড়ের ঝাক চাঁদ ঢেকে দিয়েছে। সৈকত অন্ধকার।
ধীরে ধীরে কমে এল বাদুড়। পেছনের পাহাড়ের দিকে চলে গেল। আবার বেরিয়ে এল চাঁদের মুখ।
কোত্থেকে এল ওগুলো? মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল সিসি।
সাগরের মাঝের দ্বীপটা থেকে, মুসা বলল। বাদুড়ের অত্যাচার আর ভ্যাম্পায়ারের ভয়ে ওখানকার সব মানুষ পালিয়েছে। পোড়ো বাড়িগুলো এখন…
প্রসঙ্গটা চাপা দেয়ার জন্যে রবিন বলল, এতদিন হলো পড়ে আছে, সিনেমার লোকেরা দেখে না নাকি দ্বীপটাকে? হরর ছবির চমৎকার শূটিং করতে পারত।
তা পারত, টনি বলল। তেমন করে নজরেই পড়েনি হয়তো কারও। তাই আসেনি।
সিনেমা থেকে আবার নাটকের প্রসঙ্গ এসে পড়ল। স্যান্ডি হোলোতে একটা থিয়েটার আছে, সামার থিয়েটার। গরমের সময় প্রতি বছরই তাতে ছেলেমেয়েদের দিয়ে নাটক করানো হয়। এবারেও হবে। স্থানীয়রা তো থাকেই, যারা বেড়াতে আসে তাদের মধ্যে থেকেও অভিনয়ের জন্যে লোক নেয়া হয়।
কি নাটক করছে ওরা? জানতে চাইল রবিন। বই পড়া ছাড়াও নাটক, গান এ সবের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ আছে তার। কিছুদিন একটা গানের কোম্পানিতে পার্ট টাইম চাকরিও করেছে। আবার ওরা ডাকছে যাওয়ার জন্যে।
নাইট অভ দ্য ভ্যাম্পায়ার, নাটকের নাম বলল টনি।
কান খাড়া করে ফেলল মুসা, কাহিনীটা কি?
কি আর হবে, যে প্রসঙ্গটা চাপা দিয়ে রাখতে চাইছিল রবিন, সেটা। আবার উঠে পড়ছে দেখে তাড়াতাড়ি বলল, ভ্যাম্পায়ারের রক্ত খাওয়ার কাহিনী। ওরা তো ওই একটা কাজই পারে। এত কিছু থাকতে ভূতের গল্প। আর কোন কাহিনী খুঁজে পেলেন না মিসেস রথরক!
এটা সেরকম না, টনি বলল। নামটা ভয়ঙ্কর হলেও আসলে হাসির নাটক।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর উঠে দাঁড়াল মুসা, চলো, ওঠা যাক।
কোথায় যাব? জিজ্ঞেস করল টনি।
আর্কেডে। আমার খিদে পেয়েছে।
আমারও, বলেই বোনের দিকে তাকাল টনি। কিন্তু যত্ত মুশকিল এই, মেয়েটাকে নিয়ে। ঝামেলা! ওর জ্বালায় না পারব রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভালমন্দ কিছু খেতে, না পারব আর্কেডে খেলতে।
ও, আমি ঝামেলা। বিরক্তির কারণ! ঝাঁঝিয়ে উঠল সিসি, বেশ, আমি থাকবই না। গেলাম বাড়ি চলে।
আঁতকে উঠল টনি, না না, যাসনে! একা গেলে মা আর আমাকে আস্ত রাখবে না!
তাহলে আর উপায় কি? আমাকে নিয়েই যেতে হবে তোদর।
যাব। তবে ঝামেলা করতে পারবি না।
করব, আইসক্রীম কিনে না দিলে। বাড়ি ফিরে গিয়ে মাকে বলব, তুই আমাকে সারা পথ ধমকাতে ধমকাতে নিয়ে গেছিস…
কতবড় মিথ্যুক রে! ধমকালাম আবার কখন? তুইই তো চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে পিত্তি জ্বালাচ্ছিস।
আবার গালাগাল! চ্যাটাং চ্যাটাং, না? বেশ, যাচ্ছি বাড়ি ফিরে।
খপ করে বোনের হাত ধরে ফেলল টনি। দেখ, সিসি, কাজটা তুই ভাল করছিস না। ব্ল্যাকমেইল হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।
কোন্ মেইল হচ্ছে তা বুঝিটুঝি না। তবে আমি সঙ্গে যাব, আমার যা। ইচ্ছে বলব, সাফ কথা। টীচার বলেছেন, স্বাধীনভাবে কথা বলা মানুষের। গণতান্ত্রিক অধিকার…
নাও, হয়েছে! হতাশ ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল টনি। এবার ওনার কাছে রাজনীতিও শুনতে হবে..অপরাধ হয়ে গেছে, সিসি। মাপ করে দে। তোর মরিচ গোলানো কথার তীর বন্ধ করে এবার রেহাই দে। চল, দেব। তোকে আইসক্রীম কিনে।
হাসি ফুটল সিসির মুখে, যা, দিলাম মাপ করে। তবে একটা আইসক্রীমে। আর চলবে না এখন। যতগুলো বলব, দিতে হবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল টনি, চল, দেব। ঠাণ্ডা লেগে তোর টনসিল পচে মরলে আমার কি!
হাসতে হাসতে বলল সিসি, তখনও মা তোকেই বকবে। বলবে, আমাকে ভোগানোর জন্যে ইচ্ছে করে বেশি বেশি আইসক্রীম কিনে দিয়ে আমার টনসিল তুইই পচিয়েছিস।
.
০২.
সাত দিন পর।
ছায়ায় লুকিয়ে আছে মেয়েটা। ছোট্ট নাক। কালো চুলের লম্বা বেণি। গায়ের রঙ আমেরিকানদের মত ফর্সা নয়, বরং কিছুটা বাদামী দেখছে সে। অপেক্ষা করছে।
দুটো মেয়ে এগিয়ে আসছে। একজনের লম্বা লাল চুল। চাঁদের আলোয় চকচক করছে।