থিয়েটারে নাটকের রিহারস্যাল দিতে এসেছে ওরা।
রবিন…
কিন্তু শুনল না রবিন। সরে গেল মঞ্চের দিকে।
তাকিয়ে রইল মুসা। ছাড়বে না সে। যতই রাগুক রবিন, তাকে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়বে। রবিন বিপদটা বুঝতে পারছে না, কিন্তু সে তো পারছে।
সময়মত শুরু করা গেল না রিহারস্যাল। কয়েকজন ছেলেমেয়ে তখনও এসে পৌঁছায়নি। তাদের মধ্যে কিমি, ডলি আর কণিকাও রয়েছে। মঞ্চের সামনের দিকে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন মিসেস রথরক। ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন।
রবিনের দিকে দৃষ্টি ফেরাল মুসা। আগের দিনের চেয়ে খারাপ অবস্থা ওর। চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে, পানিতে ভরা। মুখের চামড়া মোমের মত ফ্যাকাসে। যেন জীবনে কোনদিন রোদের মুখ দেখেনি।
ভ্যাম্পায়ারের মত।
জীবন্মৃতদের দলে যোগ দিতে আর কত সময় লাগবে রবিনের? কিংবা মারা যেতে?
*
রিহারস্যালের পর টনি আর কিমিকে আরও কিছুক্ষণ থাকতে বললেন মিসেস রথরক, ওদের দৃশ্যগুলো ভালমত বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে। দুজনেই কাঁচা।
থিয়েটারের দরজা দিয়ে কণিকার সঙ্গে রবিনকে বেরিয়ে যেতে দেখল মুসা। ওদের দিকে এগোতে যাচ্ছিল সে, সামনে এসে দাঁড়াল ডলি।
বাইরে খুব সুন্দর রাত। হাঁটতে যাবে?
চলো, রাজি হয়ে গেল মুসা। রবিনকে নিয়ে কোথায় গেল কণিকা দেখা দরকার।
বাইরে বেরিয়ে এল দুজনে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রবিন আর কণিকাকে খুঁজতে লাগল মুসা। বাড়িটার মোড় ঘুরে অন্যপাশে চলে যেতে দেখল একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে। সরু রাস্তা ধরে শহরের দিকে চলেছে আরও অনেক ছেলেমেয়ে। কেউ কেউ যাচ্ছে সৈকতে।
রবিনের দেখা নেই।
কোথায় গেল ও? ভুলিয়েভালিয়ে ওকে থিয়েটারের পেছনের বনে নিয়ে গেল না তো কণিকা? এখন হয়তো রবিনের রক্ত খাচ্ছে।
এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কি হবে? তাড়া দিল ডলি, চলো, শহরে চলে যাই।
ওর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আশপাশের গলিগুলোর দিকে নজর রাখল মুসা। রবিন আর কণিকাকে খুঁজছে ওর চোখ। হাত ধরাধরি করে হাঁটছে ছেলেমেয়েরা। হট ডগ খাচ্ছে। বীচ এমপোরিয়ামের উইন্ডোতে সাজানো জিনিসপত্র দেখছে।
আমাদের ডায়লগগুলো আরেকবার প্র্যাকটিস করলে কেমন হয়? ডলি বলল।
কি আর প্র্যাকটিস করব? হাতে গোণা কয়েকটা বাক্য আমার, মুখস্থ হয়ে গেছে। ভুলব না।
কিন্তু আমার ডায়লগ অনেক। কিছুতেই মনে থাকে না। প্র্যাকটিস করতে পারলে ভাল হত। স্ক্রিপ্টটা আছে তোমার কাছে?
না। ওটা আমার লাগে না।
আমারটা ভুলে ফেলে এসেছি থিয়েটারে। এনে দিতে পারবে?
ঠিক আছে, যাচ্ছি।
যাও। সৈকতে চলে এসো। কাঠের সিঁড়ির কাছে থাকব আমি।
দৌড় দিল মুসা। ও ভেবেছিল, তখনও টনি আর কিমিকে রিহারস্যাল দিচ্ছেন মিসেস রথরক। কিন্তু এসে দেখল অন্ধকার।
নিশ্চয় তালা দিয়ে চলে গেছেন মিসেস রথরক, ভেবে দরজার নব ধরে মোচড় দিল সে।
সহজেই খুলে গেল দরজা। লবিতে ঢুকল মুসা। পেছনে বাতাস লেগে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল পাল্লাটা। চমকে উঠল সে।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেয়াল হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে চলল।
বাতির সুইচটা কোনখানে অনুমানের চেষ্টা করল সে। লবিতে কোথায় কি আছে জানে। টিকেট বুদ। একটা কোকের মেশিন। সীটের কাছে যাওয়ার দরজা। সবই দেখতে পাচ্ছে কল্পনায়। কিন্তু সুইচটা কোথায়?
খসখস শব্দ হলো। বাঁয়ে। তারপর খুট করে আবার শব্দ।
কে? ডেকে জিজ্ঞেস করল সে।
জবাব নেই।
বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটাতে শুরু করল যেন হৃৎপিণ্ডটা।
থিয়েটারের দরজা খোলা, অথচ সব আলো নেভানো। খটকা লাগল তার। ঘটনাটা কি?
বড়, ভারী একটা কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা লাগল। ঠং-ঠং, ঝনঝন, নানা রকম শব্দ হলো।
কোকের মেশিনটা।
চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ধীরে ধীরে ছাড়ল মুসা। লাইট সুইচটা খুঁজতে শুরু করল।
শব্দ হলো আবার। পা টিপে টিপে হাঁটার মৃদু শব্দ। বিড়ালের পায়ের মত। চারপাশের দেয়ালে মোলায়েম প্রতিধ্বনি তুলল যেন।
কে? আবার জিজ্ঞেস করল সে। গলা কাঁপছে।
এত ভয় পাচ্ছ কেন? নিজেকে ধমক দিল সে। ওটা ইঁদুর। অন্য কিছু না।
দেয়াল ধরে ধরে এগিয়ে চলল সে। সুইচটা কোথায়? পাচ্ছে না কেন?
পেল অবশেষে। সুইচ বোর্ডের কিনারে হাত পড়ল। সুইচটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টিপে দিল।
আলো জ্বলল মাথার ওপর।
চোখ মিটমিট করে সইয়ে নিতে লাগল এই হঠাৎ উজ্জলতা। চারপাশে আকাল। লবিতে দাঁড়িয়ে আছে। একা। ইঁদুর থেকে থাকলে আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছে।
কিন্তু মনের খুঁতখুতি গেল না। সত্যি কি ইঁদুর? নাকি রেস্ট রূমে কেউ লুকিয়ে রয়েছে?
দরজা খুলে একটা ঘরে ঢুকল সে। এটা পুরুষদের রেস্ট রূম খালি। মেয়েদেরটাতেও উঁকি দিল। এটাও খালি। কেউ নেই।
ধূর! অহেতুক দেখাদেখি করছে এভাবে। কোন প্রয়োজন ছিল না। তারচেয়ে যা নিতে এসেছে, সেটা নিয়ে কেটে পড়া উচিত। দেরি দেখলে ডলি আবার চিন্তা শুরু করবে।
ডাবল ডোরটা পার হয়ে অডিটরিয়ামে চলে এল সে। সামনে সারি সারি সীট তার দিকে মুখ করে রয়েছে। সব যেন তাকিয়ে রয়েছে শূন্য মঞ্চটার দিকে।
ধীরে ধীরে মঞ্চের দিকে এগোল সে। নির্জন অডিটরিয়ামে প্রতিধ্বনি তুলল তার পায়ের শব্দ। অনেক জোরাল হয়ে কানে বাজল।
ডলি বলেছে, উইঙসের ভেতরে একটা টুলের ওপর স্ক্রিপ্টটা ফেলে গেছে।
সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠতে শুরু করল সে। মঞ্চের পেছনে ফেলে রাখা হয়েছে কাপড়ের স্তূপ। ভাল করে দেখল মুসা। ধূসর রঙ চোখে পড়ল। পরিচিত রঙ।