তার চোখের সামনে অস্পষ্ট, ধোয়াটে হতে আরম্ভ করল কণিকা।
রাতের হালকা বাতাস বয়ে গেল। কুয়াশার শেষ পুজগুলোকেও উড়িয়ে নিয়ে গেল। কণিকাকে অবাস্তব লাগছে এখনও ওর কাছে। ফিসফিস করে ডাকল আবার, কণিকা! জোরে ডাকতে যেন ভয় লাগছে।
কি? সাড়া দিল কণিকা।
বুঝতে চাইছি সত্যি তুমি আছ নাকি?
আবার রবিনের কাঁধে হাত রাখল কণিকা, আছি। তোমার খুব খারাপ লাগছে?
দুর্বল। পা-টা ভাঙার পর আর সুস্থ হতে পারলাম না। একটার পর একটা রোগ ধরতেই আছে।
সেই সঙ্গে ওষুধের প্রতিক্রিয়া, কণিকা বলল। এত অ্যান্টিবায়োটিকে শরীর দুর্বল হতে বাধ্য। তার ওপর নিশ্চয় কোন ধরনের জটিল ভাইরাস ঢুকেছে রক্তে। তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত। দরকার হয় হাসপাতালে কাটাওগে কয়েক দিন।
কণিকা?
বলো?
দ্বিধা করল রবিন। একটা কথা। কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না। মুসা যে বলে ভ্যাম্পায়ারে রক্ত খেলে এমন হয়, কথাটা কি বিশ্বাস করা উচিত?
না। আমি ভ্যাম্পায়ার বিশ্বাস করি না। তবে কিছু একটা এসে যে রক্ত খেয়ে যাচ্ছে, খুন করে মানুষগুলোকে ফেলে যাচ্ছে সৈকতে, এটা ঠিক।
তোমার কি মনে হয়? কারা করে? জানো কিছু?
ঢেউয়ের দিকে তাকাল কণিকা। চিন্তা করল একমুহূর্ত। তারপর জবাব দিল, বোধহয় জানি!
.
১৩.
মেইন স্ট্রীটে ঘোরাফেরা করছে মুসা। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত দোকানগুলোর দিকে নজর। বেরিয়ে আসা প্রতিটি মুখ দেখছে। রবিনকে খুঁজছে।
বোর্ডিং হাউসে ক্রমাগত ফোন করেছে। রবিনকে পায়নি। অ্যাটেনডেন্ট জানিয়েছে, কোথায় গেছে বলে যায়নি। ধরেই নিয়েছে মুসা, কণিকার সঙ্গে বেরিয়ে গেছে রবিন। কণিকার মায়াজালে জড়িয়েছে।
ভ্যাম্পায়ারের জাল। বড় ভয়ঙ্কর জাল। একবার জড়ালে ছিন্ন করা কঠিন।
সম্মোহন করে করে নিশ্চয় রবিনের মনটাকে ধোয়াটে করে দিয়েছে কণিকা। সেজন্যেই অন্য কারও কথা আর শুনতে চাইছে না সে। কোন কিছু ভাবতে চাইছে না। জিনারও এ অবস্থা করেছিল জন।
জিনাকে মুক্ত করেছে। রবিনকেও করতে হবে। ভ্যাম্পায়ারের হাতে ওকে কোনমতেই মরতে দিতে পারে না।
অ্যানটিক হাউসটা থেকে হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে এল একটা পেশীবহুল ছেলে আর একটা সোনালি-চুল মেয়ে। মুখ দেখা যাচ্ছে না।
টনি! কিমি! ডাকতে ডাকতে ওদের দিকে এগিয়ে গেল মুসা।
ফিরে তাকাল ছেলেমেয়ে দুটো। অবাক চোখে তাকাল। টনি আর কিমি নয়। মুসার অপরিচিত।
সরি, তাড়াতাড়ি বলল মুসা। আমার বন্ধু মনে করেছিলাম। তোমরা দেখতে ওদেরই মত।
হেসে হাত নেড়ে আবার হাঁটতে শুরু করল ছেলেমেয়ে দুটো।
গেল কোথায় সব? ভাবছে মুসা। চেনা কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না কেন?
শহরে রবিনকে না পেয়ে সৈকতে চলে এল। আজ কুয়াশা নেই। চাঁদের আলো আছে। কিন্তু লোকজন বড় কম। পর পর দুটো খুন হওয়ার পর থেকে রাতের বেলা সৈকতে আসা কমিয়ে দিয়েছে লোকে। কয়েক জোড়া দম্পতি, আর হাতে গোণা কয়েকটা ছেলেমেয়েকে দেখা গেল। দুএকজন তার। মুখচেনা আছে, বাকি সবাই অপরিচিত।
রবিনকে খুঁজছে আর কণিকাকে ধ্বংস করা যায় কিভাবে ভাবছে। সবচেয়ে সহজ হত যদি রোদে বের করে আনা যেত। কিন্তু আনাটাই হলো। কঠিন। ও গিয়ে বললেই বেরিয়ে চলে আসবে না কণিকা। ধ্বংস করার দ্বিতীয় উপায়টা হলো বুকে কাঠের গজাল ঢোকানো। তার জন্যে ভ্যাম্পায়ারের আস্তানা খুঁজে বের করতে হবে।
কণিকার আস্তানা কোথায়? দ্বীপটাতে? জন আর লীলাকে ধ্বংস করার পরেও কি ওখানে থাকতে সাহস করবে ভ্যাম্পায়াররা?
দ্বীপটাতে গিয়ে খুঁজে দেখার কথা ভাবল। গেলে দিনের বেলা যেতে হবে। তখন কফিনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে ভ্যাম্পায়ার।
রবিনের সাহায্য পেলে সবচেয়ে ভাল হত। রোদে বের করে আনতে পারত কণিকাকে। গজাল ঠুকে মারা অনেক বেশি কঠিন কাজ। নিজের আস্তানায় ক্ষমতা অনেক বেড়ে যায় ভ্যাম্পায়ারের। দিনের বেলায়ও জেগে, উঠে আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে। যদি আস্তানায় কোন ফাঁকফোকর না। থাকে, আলো আসার পথ না থাকে, অন্ধকার হয়।
সৈকতেও রবিনকে না পেয়ে সোজা ওর বোর্ডিং হাউসে রওনা হলো সে। খুঁজে আজকে বের করবেই। যেখান থেকেই হোক।
বারান্দার পরে হলঘর। ডেস্কে বসে পত্রিকা পড়ছে অ্যাটেনডেন্ট। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, ঘরেই আছে রবিন। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মুসা। যাক, পাওয়া গেল। দুশ্চিন্তাও হলো। নিশ্চয় খুব অসুস্থ। ওঠার শক্তি নেই। নইলে ঘরে থাকত না।
ওর ধারণাই ঠিক। বেশ কয়েকবার থাবা দেয়ার পর দরজা খুলে দিল রবিন। চোখের পাতা আধবোজা। সাংঘাতিক দুর্বল। মুখ আরও ফ্যাকাসে হয়েছে। টলছে। দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে।
এই অবস্থা হয়েছে তোমার! প্রায় চিৎকার করে উঠল মুসা। আমাকে খবর দাওনি কেন?
ভাবলাম রেস্ট নিলে সেরে যাবে…
ভেতরে ঢুকল মুসা।
একটা কাউচে পাশাপাশি বসল দুজনে।
কাল রাতে কোথায় ছিলে? কোন পার্টিতে গিয়েছিলে নাকি? জানতে চাইল মুসা।
কাল রাতে? কপাল কুঁচকে ভাবতে লাগল রবিন। মনে করার চেষ্টা করল। না, পার্টিতে যাইনি। কণিকার সঙ্গে বেরিয়েছিলাম। সৈকতে গিয়ে বসে থেকেছি অনেকক্ষণ। খুব কুয়াশা ছিল কাল, তাই না?
জবাব দিল না মুসা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবিনের মুখের দিকে। রক্তশুন্য মুখ। বিধ্বস্ত।
গলার দিকে তাকাল। দাঁতের দাগ দেখল না। তবে আছে, আজও ভাবল একই কথা। আরও নিচে। শার্টের কলারের নিচে লুকানো।