সাদা কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেছে স্যান্ডি হোলো। চেপে আসছে যেন চারদিক থেকে।
মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে ওর। কেউ বিশ্বাস করছে না ওকে। সবাই ভাবছে পাগল হয়ে গেছে। সাহায্য করার কেউ নেই। একেবারে একা সে। নিঃসঙ্গ।
পায়ের নিচে নরম লাগল। নিচে তাকিয়ে দেখল ভেজা বালি। সৈকতে পৌঁছে গেছে।
জুতো খুলে হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে লাগল। আরাম লাগছে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে বালি ঢুকে যাওয়ার সময় চমৎকার একটা অনুভূতি হয়। ওর বাঁ দিকে পানি। ঢেউ আছড়ে পড়ছে। কিছুদূরে সামনে বোট হাউসটা। কোন চিন্তাভাবনা না করে সেদিকেই এগিয়ে চলল সে।
মাথার ওপরে ডানা ঝাপটানোর শব্দ হতেই চমকে মুখ তুলে তাকাল। তিনটে বাদুড়। কুয়াশার মধ্যে অস্পষ্ট। নিচ দিয়ে না উড়লে চোখে পড়ত না। তাকিয়ে রইল ওগুলোর দিকে। বাদুড়ের রূপ ধরে আসে ভ্যাম্পায়ার। কুয়াশার মধ্যে এসেছে। কুয়াশার মধ্যে বাদুড় ওড়ে কিনা, খাবারের খোঁজে বেরোয় কিনা, জানা নেই ওর। ভূত হওয়ার সম্ভবনাটা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সাবধান রইল। কিন্তু থেকেই বা কি করবে বুঝতে পারছে না। ভ্যাম্পায়ার হলে কি দিয়ে ঠেকাবে? কোন অস্ত্র তো নেই সঙ্গে।
বোকামি হয়ে গেছে। মস্ত বোকামি। যে সৈকতে দুদুটো খুন হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে, সেখানে এভাবে নিরস্ত্র চলে আসাটা উচিত হয়নি।
কিন্তু আক্রমণ করল না বাদুড়গুলো। তিনটে কালো ছায়ার মত মিলিয়ে গেল কুয়াশার মধ্যে।
ফিরে যাবে কিনা ভাবতে ভাবতে এগিয়েই চলল সে। আপন চিন্তায় বিভোর।
আরেকটা শব্দ কানে এল।
পেছনে।
কেউ অনুসরণ করছে ওকে!
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরে তাকাল সে।
কেউ নেই।
কল্পনা! ভাবল সে। মাথার মধ্যে ভূতের চিন্তা পাক খাচ্ছে বলেই উল্টোপাল্টা এত কিছু দেখছে।
কিন্তু না, ভুল দেখেনি। কুয়াশার মধ্যে থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে এল একটা মেয়ে। যেন একটা কাঁপা কাঁপা ছায়া বেরিয়ে এসে মানুষের রূপ নিল। কুয়াশা আর আলোর কারসাজি নাকি!
কে? জিজ্ঞেস করল সে।
আমি, ধীরপায়ে সামনে এসে দাঁড়াল ডলি।
এত রাতে এখানে?
বাড়িতে একা একা ভাল লাগছিল না। তোমার সঙ্গে হাঁটি কিছুক্ষণ? অসুবিধে আছে?
না, অসুবিধে আর কি, সঙ্গী পেয়ে খুশিই হলো মুসা।
পাশাপাশি হাঁটতে লাগল ওরা। চারপাশ ঘিরে ওদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে যেন কুয়াশার সাদা দেয়াল।
খপ করে মুসার হাত চেপে ধরল ডলি, শুনছ?
ফগহর্ন।
হ্যাঁ। ওই শব্দ আমার ভাল লাগে।
কেমন যেন রহস্যময়।
সামনে এসে দাঁড়াল ডলি। মুখোমুখি হলো ওর। হাত রাখল দুই কাঁধে। মিষ্টি গন্ধ পেল মুসা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মোহনীয় কণ্ঠে বলতে লাগল ডলি, ফগহর্ন আমার ভাল লাগে। কুয়াশা ভাল লাগে। সব কিছু ঢেকে দেয়। কিছু দেখা যায় না। কেউ দেখতে পাবে না আমাদের।
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিচিত্র অনুভূতি হলো মুসার। মাথার মধ্যে বো করে উঠল। মগজে সব কিছু গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে নাচতে শুরু করেছে কুয়াশা।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে ডলির মুখ।
*
হঠাৎ যেন সংবিৎ ফিরে পেল মুসা। সরিয়ে নিল গলা। হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বলল, কামড় দিল কিসে?
ডলিও সরে গেছে। মশাটশা হবে। কুয়াশা পড়লে যেন পাগল হয়ে যায় রক্ত খাওয়ার জন্যে।
তোমাকে ঘাবড়ে দিলাম নাকি?
মুসার কথা যেন কানেই যায়নি। একঘেয়ে কণ্ঠে বলল ডলি, মশাকে আমি ঘৃণা করি। এমন শয়তানের শয়তান। রক্তচোষা জীব!
ঘাড় ডলছে এখনও মুসা। বলল, বাড়ি যাব। আর ভাল লাগছে না এখানে।
তুমি সব সময়ই খালি পালাতে চাও।
না, তা চাই না। তবে তোমার সঙ্গে যতবার দেখা হয় আমার, জরুরী কোন না কোন কাজ থাকে। ইচ্ছে করে কাজ বের করি ভেবো না। রবিনকে খুঁজতে এসেছিলাম এখানে। ওর জন্যে ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।
কাল রাতে দেখা হচ্ছে তো? গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে মুসার চলে যাওয়ার কথায় হতাশ হয়েছে ডলি।
হ্যাঁ। কাল না হলেও পরশু। তুমি কোনদিকে যাবে? চলো, এগিয়ে দিয়ে আসি।
না, লাগবে না, থ্যাংক ইউ। এত তাড়াতাড়ি আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। এসেছি যখন, খানিকক্ষণ হাঁটব। নইলে ঘুম আসবে না।
বাড়ি রওনা হলো মুসা। প্রায় দৌড়ে চলল। কিছুদূর গিয়ে ফিরে তাকাল। দেখা গেল না ডলিকে। হারিয়ে গেছে কুয়াশায়।
মাথার ওপর ডানা ঝাপটানোর শব্দ হলো। ওপরে তাকিয়ে বাদুড়টাকে দেখতে পেল না মুসা। বেশ কিছুটা ওপরে কুয়াশার মধ্যে রয়েছে।
নিজের অজান্তেই গায়ে কাঁটা দিল ওর। গতি বাড়িয়ে দিল। তবে বাদুড়টা ভ্যাম্পায়ার হয়ে গিয়ে আক্রমণ করল না ওকে। নিরাপদেই বাড়ি ফিরে এল সে।
বাড়িতে ঢুকেই আগে টেলিফোনে রবিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করল।. পারল না। ফেরেনি সে।
*
সৈকতে বসে আছে রবিন। কান পেতে শুনছে ঢেউয়ের গর্জন। গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে পানি জেটি থেকে, সৈকতের বালি থেকে। শব্দটা কেমন দূরাগত মনে হচ্ছে। যেন স্বপ্নের মধ্যে ঘটছে এসব।
পাশে বসে আছে মেয়েটা।
এটাও কি বাস্তব?
নাকি কল্পনা?
ফিসফিস করে ডাকল, কণিকা, তুমি সত্যি আছ?
জবাব দিল কণিকা, আছি।
ওপরে উঠতে আরম্ভ করেছে কুয়াশা। হালকা হয়ে আসছে নিচের দিকের কুণ্ডলীগুলো। ঢেউয়ের বুকে এখন চাঁদের আলোর প্রতিফলন। সব কিছু ঝিলমিল করছে। সব কিছু কেমন কাঁপছে।
কণিকার দিকে ফিরে তাকাল রবিন। চাঁদের আলোয় আরও ফ্যাকাসে লাগছে মেয়েটার মুখ। চামড়ার রঙ এমন মোমের মত কেন? কালো চুল কুয়াশায় ভিজে গিয়ে ধূসর লাগছে। পাশে বসে থাকলেও এ মুহূর্তে মেয়েটাকে অবাস্তবই লাগছে ওর কাছে।