শোনো, রবিন, আমার কথা হয়তো বিশ্বাস করতে চাইবে না, তবু। বলি। ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে রয়েছ তুমি।
ওপাশ থেকে মৃদু হাসি শোনা গেল। দুর্বল হাসি।
দেখো, রবিন, আমি সিরিয়াস, গভীর কণ্ঠে বলল মুসা। হেসো না। আমার কথা শোনো।
আমার ভাল লাগছে না, মুসা, কাশতে কাশতে বলল রবিন। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। বেরোতে হবে।
রবিন, একবারও কি তোমার মনে হয়নি হঠাৎ করে এত দুর্বল লাগছে। কেন তোমার? কিসের অসুখ? কারণটা আর কিছুই না, রবিন। সব কিছুর মূলে ওই কণিকা।
দীর্ঘ নীরবতার পর রবিন বলল, তাই?
কণিকা একটা ভ্যাম্পায়ার, রবিন, গরম হয়ে উঠছে মুসা। আমি জানি, কথাটা বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু ও ভ্যাম্পায়ার। তোমার রক্ত খাচ্ছে। অল্প অল্প করে খাচ্ছে, যাতে মরে না যাও। রিকি, অ্যানি আর ইমির মত একবারে খেয়ে ফেলছে না। এখনও যদি সাবধান না হও…
মুসা, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাধা দিল রবিন। এখন এসব ভূতের গল্প ভাল লাগছে না…।
রবিন, গল্প নয়! বিশ্বাস করানোর জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল মুসা। রিকির বেলায় কি ঘটেছে, বলেছি তোমাকে। জিনার অবস্থা তো নিজের চোখেই দেখলে। জিনার মতই তোমাকেও…
জিনার মাথায় গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, তাই ওরকম করেছে। আমার তো আর তা হয়নি…
ভ্যাম্পায়ারেই ওর মাথাটা বিগড়েছে, রবিন। আমার কথা না শুনলে তোমারও এই অবস্থা হবে। যদি ভাগ্য ভাল হয়, বেঁচে থাকো, রিকির মত মরে না যাও। কণিকা তোমাকে…
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে আমার, মুসা। অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠছি। সেটা। ভূতের কারণে নয়। নিশ্চয় কোন ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছে, ফুয়ু হবে। মুসা, তুমি বরং আমার কথা শোনো। রকি বীচেও বলেছি, এখনও বলছি–ডাক্তার দেখাও। জিনার আর তোমার একই অসুখ। কি হয়েছিল তোমাদের, কে জানে। অতিরিক্ত ভয় পেলে হয় ওরকম। সেরাতে নৌকা। নিয়ে একা একা দ্বীপে যাওয়া তোমাদের মোটেও উচিত হয়নি।…আঙ্কেল আর আন্টি ফিরেছেন?
আঁ? … হ্যাঁ।
কথা বলেছ তাঁদের সঙ্গে?
না।
তাহলে বলে ফেলল। আর দেরি কোরো না। সত্যি কথাটাই জানাও। বলবে, ভ্যাম্পায়ারের আতঙ্ক তোমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। তোমার যদি বলতে সঙ্কোচ হয়, আমিই নাহয় বলে দেব। মোট কথা, তোমার চিকিৎসা হওয়া দরকার। দেরি করলে শেষে জিনার মত হাসপাতালে যেতে হবে।
নিজের জীবন বিপন্ন, আমাকে ভাবছে পাগল! কি যে করি!–চুপ করে রইল মুসা।
অ্যাই, মুসা, শুনছ?
হ্যাঁ, বলো।
আমি বেরোচ্ছি।…ওই যে, কণিকা এসে গেছে। পরে দেখা হবে…
প্লীজ, রবিন! চিৎকার করে উঠল মুসা। দোহাই লাগে তোমার! ওর সঙ্গে বেরিয়ো না! মারা পড়বে, রবিন…
কট করে শব্দ হলো। লাইন কেটে গেছে।
*
টপ করে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়ল মুসার ঘাড়ে। বরফের মত শীতল পানি ঘাড় বেয়ে নেমে গেল নিচের দিকে। চামড়ায় অদ্ভুত সুড়সুড়ি তুলে।
ঘন হচ্ছে কুয়াশা। শহর ঢেকে দিয়েছে। স্ট্রীট ল্যাম্পগুলোকে আলো ছড়াতে দিচ্ছে না। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে ঘোলাটে হলুদ আভা ছড়াচ্ছে কেবল ওগুলো।
মেইন স্ট্রীটে উঠল মুসা। পিজ্জা কোভে খুজল রবিন আর কণিকাকে। পেল না।
আর্কেডে এসে প্রিন্সেস-এর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। বাইরের ভেজা রাতের চিহ্নও নেই এখানে। প্রচুর আলো। জোরাল মিউজিক বাজছে। বাজনার শব্দকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচি আর হাসির শব্দ। ভিডিও গেম খেলছে।
আইসক্রীম পারলারে উঁকি দিল। পাশাপাশি টুলে বসে আছে টনি আর কিমি। টনির হাতে আইসক্রীম।
এগিয়ে গেল মুসা। ওদের কাছে এসে দাঁড়াল। টনি, রবিনকে দেখেছ?
ঝট করে মাথা ঘোরাল কিমি। মুসাকে দেখে বদলে গেল চাহনি। মাথা নেড়ে বলল, না, দেখিনি। তুমি বাপু এখন যাও তো। আবার কোন্ ঘ্যানঘ্যানানি শুরু করবে…।
তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি আমি! কঠোর স্বরে জবাব দিয়ে টনির দিকে ফিরল মুসা, কি, দেখেছ রবিনকে?
নাহ, গতকাল থেকেই দেখছি না, টনিও অধৈর্য।
কিন্তু ওকে আমার দরকার। খুঁজে বের করতেই হবে। ভীষণ বিপদে আছে ও।
আবার নাক গলাল কিমি, কিসের বিপদ?
কণিকা একটা ভ্যাম্পায়ার। রবিনকে সাবধান করেছি। কিন্তু আমার কথা বিশ্বাস করল না। কণিকা ওকে…
আহ, দয়া করে এবার থামাও না তোমার ওই ভ্যাম্পায়ারের গপ্পো! অধৈর্য হয়ে হাত নাড়ল টনি। কুটি করল।
বললাম তো গপ্পো নয়..
চোখের পাতা সরু করে ফেলল টনি। কথা শেষ করতে দিল না মুসাকে। দেখো, অতিরিক্ত জ্বালাতন শুরু করেছ তুমি। সহ্যের একটা সীমা আছে। তোমার মাথায় গোলমাল হয়ে গেল নাকি ভাবছি।
গোলমাল! কিসের গোলমাল? ফেটে পড়ল মুসা। রিকি মরল। জিনার যখন এই অবস্থা হয়েছিল, তখনও তোমাদের জানিয়েছি। বিশ্বাস করোনি। হাসাহাসি করেছ। আমাকে পাগল ভেবেছ। ওর কি অবস্থা হয়েছে, দেখেছ…
দেখেছি। সে-ও তোমার মত পাগল হয়ে গেছে। কোন কারণে। তোমাদের দুজনেরই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
হ্যাঁ, হয়েছিল। এবং সেই কারণটা ভ্যাম্পায়ার! কতবার বলব এক কথা!
নিরাশ ভঙ্গিতে কপাল চাপড়াল টনি। মুসার দিকে তাকালও না আর।
মুসা বুঝল, কোন সাহায্য পাওয়া যাবে না এদের কাছে। যা করার তার। নিজেকেই করতে হবে। একা।
সে-ও আর কারও দিকে না তাকিয়ে গটমট করে বেরিয়ে এল আর্কেড থেকে।
.
১২.
কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলল নীরবে মুসা।