কথা শেষ করে সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল মুসা।
কোন ভাবান্তর নেই ডলির।
রবিনকে আগের দিনের চেয়ে ক্লান্ত লাগছে। কণিকার পাশে বসে আছে চুপচাপ। চোখ লাল। মাথা সোজা রাখতেও কষ্ট হচ্ছে।
বার বার ওর গলার দিকে তাকাচ্ছে মুসা। পোলো শার্টের কলারের জন্যে আজও দেখা যাচ্ছে না দাঁতের দাগ।
কণিকার দিকে তাকাল সে। একটা পেপার ন্যাপকিন ছিঁড়ে কুটি কুটি করে এক জায়গায় জমাচ্ছে কণিকা। হাত কাঁপছে ওর। ভয়ে নাকি?
ভয় না কচু! মনে মনে রেগে গেল মুসা। অভিনয় করছে। দেখাচ্ছে আমাদের যে ওর কোন দোষ নেই।
মৃত্যুর আগে অ্যানির হয়েছিল তোমার সঙ্গে শেষ দেখা, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল কণিকা, আর ইমির হলো আমার সঙ্গে। বিশ্বাসই করতে পারছি না।
এক টুকরো পিজ্জা বাড়িয়ে দিল রবিন। নাও।
আমি এখন কিচ্ছু মুখে দিতে পারব না, জোরে জোরে মাথা নাড়ল কণিকা। মনটা ভীষণ খারাপ।
ওর দিকে তাকিয়ে রইল মুসা। জানে, ভ্যাম্পায়াররা রক্ত ছাড়া কিছু খেতে পারে না। কণিকার চামড়া মোমের মত সাদা। যেন রক্তশূন্যতায়। ভুগছে। দিনের বেলা না বেরোতে পারলে, চামড়ায় রোদ না লাগলে এ রকম মড়ার মত সাদা হয়ে যায় মানুষের চামড়া।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল টনি। এখানে এসেছিলাম ছুটি কাটাতে। ভেবেছিলাম চমৎকার কাটবে দিনগুলো। কিন্তু কারোর মনেই আর আনন্দ নেই। সৈকতে টহল দিচ্ছে পুলিশ। লোকে আতঙ্কিত। সবার মুখে কেবল খুনের আলোচনা। ভ্যাম্পায়ারকে দোষ দিচ্ছে অনেকে।
ওফ, চোখ মুখ কুঁচকে ফেলল কিমি, এক কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল! ভ্যাম্পায়ার বলে কোন কিছু থাকলে তো খুন করবে।
হায়রে কপাল, এখনকার দিনেও এই কুসংস্কার, আড়চোখে মুসার দিকে তাকাল ডলি। ভূত বলে কিছু নেই, সবাই জানে। তা-ও ভূতকে দোষ দেয়। বেকুব ছাড়া আর কি বলব ওদের।
বেকুব বলো আর যাই বলো, আমি ভূত বিশ্বাস করি, জোর গলায় বলল মুসা। সেটাকে আমি কুসংস্কারও বলব না। ভূত আছে এটা যেমন প্রমাণ। করতে পারেনি কেউ, নেই এটাও পারেনি। তবে, আছে, এটা আমি প্রমাণ করেই ছাড়ব এবার।
কণিকা তাকাল ওর দিকে। ভাবলেশহীন শূন্য দৃষ্টি। যেন মুসার কথায়। কোন আগ্রহ নেই ওর। বিরাট অভিনেত্রী। ভাবল মুসা। ডলিকে না দিয়ে নাটকের প্রধান চরিত্রটা ওকে করতে দেয়া উচিত ছিল।
সত্যি ভূত বিশ্বাস করো তুমি? কিমি জিজ্ঞেস করল।
করে, মুসার হয়ে জবাবটা দিল রবিন। ভূতের কথা শুনলেই চোখ উল্টে দেয়। অথচ ক্ষ্যাপা মোষের সামনে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দাও, ভয় পাবে না। এ এক আজব চরিত্র, আমাদের মুসা আমান।
দুনিয়াটা, সত্যি, আজব মানুষে বোঝাই।
চুপ করে রইল মুসা। মনস্থির করে নিয়েছে কারও ব্যঙ্গ, কারও হাসাহাসিতে কান দেবে না। তর্কও করবে না। যে যা বলে বলুক। তার কাজ সে করে যাবে।
উঠে দাঁড়াল কিমি। টনির হাত ধরে ওকে টেনে তুলল চেয়ার থেকে। চলো। আমাকে কার্নিভলে নিয়ে যাবে বলেছিলে।
সেটা কাল বলেছি। মনমেজাজ আজ ঠিক নেই।
চলো। গেলেই মেজাজ ঠিক হয়ে যাবে। এখানে বসে এসব ফালতু আলোচনা করতে থাকলে বরং বিগড়াবে আরও।
তোমরা কেউ যাবে? সবার মুখের দিকে তাকাতে লাগল টনি।
কেউ যেতে চাইল না। টনিকে নিয়ে কিমি বেরিয়ে গেলে কণিকার দিকে ফিরল মুসা।
রবিনের সঙ্গে কথা বলছে কণিকা। কালো চুল। কালো চোখ। ফর্সা গাল। সুন্দর চেহারা। ওকে ভ্যাম্পায়ার ভাবতে কষ্ট হলো।
কিন্তু লীলাও সুন্দর ছিল।
তাই বলে কি ভ্যাম্পায়ার ছিল না?
আবার এক টুকরো পিজ্জা নিয়ে কণিকার দিকে বাড়িয়ে দিল মুসা, নাও।
বিরক্ত ভঙ্গিতে টুকরোটার দিকে তাকাল কণিকা।
মুসা জানত, এ রকমই করবে সে।
না, আমি খাব না, মাথা নাড়ল কণিকা। বললামই তো, খেতে পারব না।
খাও না, কণিকার মুখের কাছে টুকরোটা নিয়ে গেল মুসা। জোর করে। গুঁজে দেবে যেন। খুব ভাল বানানো হয়েছে। দারুণ টেস্ট।
না! বলে ঝটকা দিয়ে পেছনে মাথা সরিয়ে নিল কণিকা।
এক কামড় খেয়ে দেখো, চাপাচাপি শুরু করল মুসা।
খেতে যখন চাইছে না, থাক না, রবিন বলল, শুধু শুধু জোর করছ কেন ওকে?
আস্তে করে টুকরোটা প্লেটে নামিয়ে রাখল মুসা। চোখ কণিকার দিকে। ও বুঝে ফেলেছে, আমি ওকে চিনে ফেলেছি, ভাবছে মুসা। এখন নিশ্চয়। আমার মুখ বন্ধ করে দেয়ার কথা ভাববে। চিন্তায় পড়ে গেল সে। ভ্যাম্পায়ারকে সরাসরি যুদ্ধে আহ্বান! কাজটা কি ঠিক হলো? অ্যানি আর ইমির সৈকতে পড়ে থাকার দৃশ্যটা কল্পনা করে শিরশির করে উঠল মেরুদণ্ডের ভেতর।
১১.
পরদিন বিকেল।
রবিনকে ফোন করল মুসা।
রবিন, আমি, কান আর কাঁধ দিয়ে ফোনের রিসিভারটা চেপে রেখে উবু হয়ে জুতোর ফিতে বাধতে লাগল সে।
কেমন আছ? জিজ্ঞেস করল রবিন। খসখসে কণ্ঠস্বর। কথাতেই বোঝা গেল ক্লান্তি এখনও কাটেনি ওর। নিশ্চয় আবার কোন ফাঁকে ওর রক্ত খেয়েছে ভ্যাম্পায়ার।
ঘাবড়ে গেল মুসা। দেরি করে ফেলল না তো! জরুরী কণ্ঠে বলল, রবিন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।
এখন তো বলতে পারব না, রবিনের কণ্ঠস্বর এত দুর্বল, বোঝাই যায় না। প্রায়। কণিকার সঙ্গে দেখা করতে হবে। ওকে আমি কথা দিয়েছি…
ওর ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই, বাধা দিয়ে বলল মুসা। ফিতে বাধা শেষ। সোজা হয়ে বসল। রিসিভারটা হাতে নিল আবার।
কণিকা? অবাক মনে হলো রবিনকে।