এটাকে এখানে ঢুকতে দিয়েছে কে? আরে মিয়া, আমি কি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি নাকি এখন? এগারো দিন আটকে থেকে আসার পর মেয়েমানুষের কথা কে ভাবে?
কজন কিডন্যাপার ছিল?
বললাম না, আমি ওদের দেখিইনি।
গলা শুনেই লোক গুনে ফেলা যায়, আনমনে বিড়বিড় করল কিশোর, এটা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। ব্যাটা মিথ্যে বলছে। অভিনয় করে ধোকা দিচ্ছে।
লোকগুলোও তো ধোকায় পড়ছে, তিক্তকণ্ঠে বলল রবিন।
ওরা আপনাকে মারধর করেছে? জিজ্ঞেস করল আরেকজন রিপোর্টার।
না, করবে না। পিকনিকে নিয়ে গিয়েছিল তো! মুখ বাঁকিয়ে হাসল ডিলন। যত্তসব! সব কথা শোনা চাই। আমাকে বেঁধে রেখেছে, পিটিয়েছে, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছি ব্যথায়। তা-ও ছাড়েনি। এখন তো মনে হচ্ছে, আপনাদেরকে ধরে পিটাল না কেন, তাহলে কিছুটা শিক্ষা হত। আপনারা যেমন খবরের জন্যে খেপে গেছেন, ওরাও তেমনি টাকার জন্যে খেপে গিয়েছিল।
আরও কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যেন বিরক্ত হয়েই মাইক্রোফোনের কাছ থেকে উঠে চলে গেল ডিলন। পুলিশ বিশ্বাস করেছে তার কথা, রিপোর্টাররাও করেছে। তাদের ভাবভঙ্গিতেই বোঝা গেল সেটা। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে তিন গোয়েন্দা, মিথ্যে বলেছে লোকটা, ঠকিয়েছে, ফাঁকি দিয়েছে। কিন্তু সেটা প্রমাণ। করার কোন উপায় নেই।
ফেরার পথে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল মুসা। আচমকা ফেটে পড়ল, ব্যাটা বদমাশ! রাগে টেবিলে চাপড় মারার মত চাপড় মারল স্টিয়ারিঙে, চাপ লেগে হর্ন বেজে উঠল। পুলিশ বিশ্বাস করেছে যখন, পারই পেয়ে গেল ওরা! এত্তবড় একটা শয়তানী করে। ভুলটা হল কোথায় আমাদের?
কিশোর জবাব দিল, ভুল আমাদের হয়নি। ওরা আসলে আমাদের ফাঁদে পা দেয়নি। কোন ভাবে সতর্ক হয়ে গেছে।
তার মানে আমরা কিছু করতে পারলাম না ওদের? পরাজয়টা রবিনও মেনে নিতে পারছে না। কিশোর আর রবিনকে যার যার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরল কিছুক্ষণ মুসা। শেষে রওনা হলো ফারিহাদের বাড়িতে। কিছুতেই কেসের ভাবনাটা মন থেকে সরাতে পারছে না। মনে হচ্ছে। পরাজয়ের আসল কারণ সে। শোনার সঙ্গে সঙ্গে যদি কিশোরকে জানাত, তাহলে এরকমটা ঘটত না। কিন্তু আসলেই কি তাই? এখন আর জানার কোনই উপায় নেই।
ভাবতে ভাবতেই ফারিহাদের বাড়িতে পৌঁছে গেল। হেডলাইট জ্বেলে রেখেই গাড়ি থেকে নেমে এল সে। বাড়িতে ঢুকে সোজা চলে এল ফারিহার ঘরের সামনে। দরজায় টোকা দিল। বারান্দার আলোটা জ্বলল। খুলে গেল দরজা। ফারিহা দাঁড়িয়ে আছে।
হাই, মুসা বলল।
হাল্লো, কাকে চাই? তোমাকে চিনি বলে তো মনে হয় না? পথ হারালে নাকি? এটা আমাদের বাড়ি। তিন গোয়েন্দার হেডকোয়ার্টারও নয়, গাড়ির গ্যারেজও নয়।
বাইরে চল। কথা আছে।
বলো না এখানেই। আমি শুনছি। রেগে আছে ফারিহা। তবে বেরোল মুসার
দেখো ফারিহা, ঝগড়াঝাটি করার মত মানসিক অবস্থা নেই আমার এখন। ফারিহার হাত ধরল মুসা, মাঝে মাঝে কি যে হয়ে যায় আমার, কি পাগলামি যে করে বসি…
সরাসরি ওর দিকে তাকাল ফারিহা। মুসা, কি হয়েছে তোমার? এরকম ভেঙে পড়তে তো তোমাকে দেখিনি কখনও?
পকেট থেকে স্ফটিকটা বের করল মুসা, পটার বোনহেড যেটা দিয়েছিল। তাকে। ফারিহার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, এটা রাখ।
কি এটা?
এমন একটা জিনিস, যা আর রাখতে চাই না আমি।
কেন?
কারণ এটা থাকলেই বার বার মনে হবে, একটা রহস্য আমি একা একা সমাধান করতে চেয়েছিলাম। শেষে পুরোটা ভজঘট করে দিয়েছি।
.
১৫.
চব্বিশ ঘণ্টা পরেও পরাজয়ের কথাটা ভুলতে পারল না মুসা। পারল না কিশোরও। চিকেন লারসেনের স্পেশাল মুরগীর কাবাব দিয়ে সেটা ভোলার চেষ্টা করছে।
চুপচাপ তাকিয়ে ওর খাওয়া দেখছে মুসা। ঘন ঘন ওঠানামা করছে কিশোরের হাতের চামচ। দেয়াল কাঁপিয়ে বাজছে হাই ফাঁই স্টেরিও, পঞ্চাশের দশকের রক মিউজিক।
কিশোর, তিন নম্বরটা খাচ্ছ, মুসা বলল।
কিশোরের চোখ ক্ষণিকের জন্যে উঠল। কিন্তু চামচের ওঠানামা বন্ধ হল না। চিবান বন্ধ হলো না। মাথা নাড়ল না।
হঠাৎ সামনের দরজার বেল বাজল। ঘরে ঢুকল রবিন। একটা চেয়ার টেনে। বসল সে। শোনো, খবর আছে একটা। ভোর বেলায় মিস্টার বার্টলেটের কাছে। ফোন এসেছে। জরুরী তলব। জানো কে?
শ্রাগ করল কিশোর। আজকাল মাথা আর খেলে না আমার। রহস্যের সমাধান করতে পারি না।
শোনই আগে কে ফোন করেছিল। দেখো, এটার সমাধান করতে পার কিনা। জ্যাক রিডার ফোন করেছিলেন। ডিলানের সম্মানে কাল রাতে তার বাড়িতে একটা পার্টি দিচ্ছেন। মরগানস ব্যাণ্ড দরকার।
তাহলে মরগানের খুশি, আমাদের কি? মুখ গোমড়া করেই রেখেছে মুসা।
রবিন বলল, কিছুই বুঝতে পারছ না তোমরা। ডিলনের মুখ থেকে সত্যি কথা আদায়ের এটা একটা মস্ত সুযোগ।
কেন? আরেকটু মাংস মুখে পুরল কিশোর, আমাদেরও দাওয়াত করেছে। নাকি?
করলেই কি না করলেই কি, হাসল রবিন। শোনো, আমার বুদ্ধি শোনো। সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট, কালো বো টাই আর সানগ্লাস পরে চলে যাব আমরা। যে ক্যাটারিং সার্ভিসকে ভাড়া করেছেন রিডার, ওরা এই পোশাক পরেই যাবে। পার্টি চলাকালে ঢুকে পড়ব, কেউ আমাদের আলাদা করে চিনতে পারবে না।
এতক্ষণে হাসি ফুটল মুসার মুখে। কিশোরও চিবান বন্ধ করল।
পরদিন রাত নটায়, পুরোদমে পার্টি চলছে, এই সময় রিডারের বেল এয়ারের বাড়িতে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল রান্নাঘরে। তিনজনে তিনটে খাবারের ট্রে তুলে নিয়ে চলে এল মেহমানরা যেখানে ভিড় করে আছে সেখানে। ক্যাটারিং সার্ভিসের ওয়েইটারেরা খুব ব্যস্ত, ছোটাছুটি করছে এদিক ওদিক, বাড়তি তিনজন যে ঢুকে পড়েছে ওদের মধ্যে খেয়ালই করল না।