- বইয়ের নামঃ স্যাড সাইপ্রেস
- লেখকের নামঃ আগাথা ক্রিস্টি
- বিভাগসমূহঃ অনুবাদ বই, রোমাঞ্চকর,গোয়েন্দা কাহিনী
স্যাড সাইপ্রেস
১. বেনামী চিঠি
স্যাড সাইপ্রেস (এরকুল পোয়ারো)
১.১.১
এলিনর কার্লিসল চোখ নামিয়ে বেনামী চিঠিটার দিকে তাকিয়ে খুব অস্বস্তি বোধ করল। লেখাটা বিশ্রী, বানান ভুলে ভরা, সস্তা গোলাপী কাগজে লেখা।
চিঠিতে লেখা–আপনাকে সাবধান করার জন্য কারু নাম বলতে চাই না। কেউ আপনার পিসিকে চুষে খেতে চাইছে, আপনি যদি সাবধান না হন, তা হলে সবকিছু হারাবেন। মেয়েরা বড় ধূর্ত, বিশেষ করে যখন কম বয়েসী মেয়েরা বুড়িদের তোমোদ করে, আমার মতে আপনি নিজে এসে স্বচক্ষে সব কিছু দেখে যান। যা ঘটেছে, তা আপনার পক্ষে ভালো নয়, ঐ কমবয়েসী ভদ্রলোকেরও সব ডুবতে পারে,মেয়েটা ভীষণ ধূর্ত, বুড়ি যেকোন দিন পটল তুলতে করে।
-শুভাকাঙ্ক্ষী।
এলিনর ঐ অদ্ভুত চিঠিটার দিকে তাকিয়েছিল এমন সময় ঝি এসে জানাল, মিঃ ওয়েলম্যান এসেছেন।
এমন সময় ঘরে ঢুকলো রডি–যাকে প্রত্যেকবার দেখলেই এলিনরের বুকের রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে, একটা আনন্দের তরঙ্গ বয়ে যায় সারা শরীরে যদিও তার বহিঃপ্রকাশ সে কখনোই পেতে দিত না। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। কারণ রডি এলিনরকে ভালোবাসলেও তেমন কোন বহিঃপ্রকাশ খুঁজে পাওয়া যেত না।
রডি সাধারণ এক যুবক হলেও তাকে দেখলেই এলিনরের সমস্ত জগৎ হিল্লোলিত হয়ে ওঠে, ওর কণ্ঠস্বর এমনকি সামান্যতম শব্দ শুনতেই এলিনরের কাঁদতে ইচ্ছা করে। প্রেম এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি–কিন্তু এমন কিছু নয় যা মানুষকে আহত করে…। প্রে
মে পড়লে পুরুষ নিছক শ্রদ্ধা বা প্রশংসায় তৃপ্ত নয়, রডিও নয়।
এলিনর বললো, হ্যালো, রডি।
রডি উত্তরে বলল, বলো সোনামণি, মুখটা এতো শুকনো কেন? পাওনার তাগাদার চিঠি এল নাকি।
এলিনর মাথা নাড়ল।
রডি বলল, আমারও তাই মনে হয়েছিল, ভরা বসন্তকাল–জানোই তো পরীদের নাচন যখন শুরু হয়, তখনই হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে পাওনাদাররা বিল পাঠাতে শুরু করে নাচের -তালে-তালে।
এটা তার চেয়েও ভয়াবহ জিনিস। একটা বেনামী চিঠি। রডি একটু খুঁতখুঁত স্বভাবের। জ্ব কপালে তুলে অবিশ্বাস ও আশ্চর্যের মাঝামাঝি একটা অভিব্যক্তিতে বলল, তা কি করে হয়?
এলিনর আবার বলল, খুব বিশ্রী ধরনের চিঠি। এটা ছিঁড়ে ফেলাই ভালো।
প্রায় ছিঁড়েই ফেলছিল, কারণ রডি আর বেনামী চিঠি দুজনকে একসঙ্গে রাখা চলে না। কিন্তু কি জানি হঠাৎ ওর হাতে চিঠিটা দিয়ে বলল, পড়ো, প্রথমে পড়ে নাও, তারপর এটা পুড়িয়ে ফেলব। লরা পিসির সম্বন্ধে লেখা এটা…
চিঠিটা পড়ে রডি বেশ বিরক্তির ভাব দেখিয়ে বলল, হ্যাঁ, এটা পুড়িয়ে ফেলাই ভালো, মানুষ কি অদ্ভুতই না হয়।
এলিনর কে হতে পারে জিজ্ঞেস করতে রডি বলল, কে হতে পারে, মানে যার কথা বলা হয়েছে সে কে?
চিন্তান্বিত স্বরে এলিনর বলল, মেরী জেরার্ড-এর নাম। মেরী জেরার্ড মেয়েটাকে?
এলিনর মনে করিয়ে দিল মেরী ওখানকার লজে যারা থাকে তাদেরই একজনের মেয়ে। মেয়েটি যখন খুব বাচ্চা ছিল তখন লরা পিসি ওর লেখাপড়া, পিয়ানো শেখানো, ফ্রেঞ্চ শেখানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন।
রডির মনে পড়ল, রোগা রোগা চেহারার সেই বাচ্চা মেয়েটার কথা, মাথায় একরাশ এলোমেলো চুল।
এলিনরের মা, বাবা যখন বিদেশে ছিলেন তখন এলিনররা ওখানে যেত আর তখনই মেয়েটিকে শেষ দেখেছিল রডি। এলিনর জানাল যে কিছুকাল আগে পড়াশুনো করার জন্য মেয়েটি জার্মানিতে গিয়েছিল।
এলিনর আরো জানাল মেরী এখন একজন পুরোদস্তুর সুন্দরী মহিলা, ফলে আউট হাউসে থাকা অন্যান্য চাকর-বাকরদের সঙ্গে ওর বনে না। মেয়ের লেখাপড়া আর ভদ্র আচরণের জন্য ওর বাবা ওকে ব্যঙ্গ করে।
এলিনর বলল, ওখানকার বাড়িতে ওর পজিশন বেশ উঁচুতে। লরা পিসিকে সে কাগজ পড়ে শোনায়। রডির প্রশ্নের উত্তর এলিনরের জানা, নার্সের ও’ব্রায়ানের উচ্চারণ খারাপ হওয়ার দরুণ পিসী মেরীকেই বেশী পছন্দ করেন।
পায়চারি করতে করতে রডি বলে এলিনর আমার তো মনে হয়, আমাদের এখনই ওখানে যাওয়া উচিত। চিঠিটার মতলব ভালো নয়, এর পিছনে হয়তো কোন সত্য লুকিয়ে থাকতে পারে। তাছাড়া বুড়িও তো বেশ অসুস্থ…?
মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটিয়ে রডি বলল, টাকাকড়িও তো তোমার আর আমার কাছে অনেক মূল্য আছে, তাই না এলিনর?
এলিনর সম্মতি জানাতে রডি জানাল, লরা পিসির কথা থেকে এটাই সুস্পষ্ট যে তুমি না হয় আমি, নয়তো দুজনেই ওর সম্পত্তি পাব। তুমি ওঁর আপন ভাই-এর মেয়ে আর আমি ওঁর স্বামীর ভাইপো।
রডি জানাল, হেনরী কাকা লরা পিসিকে বিয়ে করার সময় তার অবস্থা অত্যন্ত সচ্ছল ছিল। লরা পিসি আর এলিনরের বাবাও প্রচুর সম্পত্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু ফাটকা খেলায় এলিনরের বাবা সব খোয়ালেন।
এলিনর জানাল, তার বাবা ব্যবসাপত্র তেমন ভালো বুঝতেন না।
রডি বলল, তোমার বাবার চেয়ে তোমার পিসি অনেক বেশী বুদ্ধি রাখতেন। হেনরী কাকাকে বিয়ে করে তিনি হান্টারবেরীর সম্পত্তি কেনেন এবং সেই পয়সা যাতেই খাঁটিয়েছেন তাতে তার লোকসান কখনোই হয়নি।
হেনরী কাকা মারা যাবার সময় তার সব কিছুই পিসিকে দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মারা গেলে পিসিও আর বিয়ে করেননি। রডি একবার বিপদে পড়লে তিনি তাকে আপন ভাইপোর মতই সাহায্য করেছিলেন। রডি বলল, লরা পিসি দারুণ ভালোমানুষ। কিন্তু আমরা দুজনেই আমাদের আর্থিক সামর্থ্যের তুলনায় বেশী মাত্রায় বাজে খরচ করি।
এলিনর বিরস গলায় জানাল, সব জিনিসের দাম এখন আকাশছোঁয়া।
রডি বলল, ডারলিং তুমি যেন জলের পদ্মফুল, কোনরকম পরিশ্রম বা ছোটাছুটি তুমি করতে পারো না।
এলিনর ঝাঁঝিয়ে বলল, আমার কি ঐসব করা উচিত বলে তুমি মনে করো রডি?
রডি বলল, তুমি তুমিই, ফুলের মতো কোমল, আবার প্রয়োজনে হুল ফোঁটাতেও পারো। লরা পিসি না থাকলে হয়তো তোমাকে বাধ্য হয়ে আজেবাজে চাকরি করতে হতো। অবশ্য আমার ক্ষেত্রেও তাই। লিউস অ্যাণ্ড হিউমের চাকরীটা করার ফলে আমার আত্মসম্মান অক্ষুণ্ণ আছে। আর লরা পিসির কাছ থেকে আমিও কিছু আশা রাখি আর তাই ভবিষ্যৎ নিয়ে ততো মাথা ঘামাই না।
রডির কথা শুনে এলিনর নিজেদের মানুষরূপী জোঁকের সঙ্গে তুলনা করলে রডি বলল, একদিন না একদিন আমরা কিছু সম্পত্তি পেতে পারি। এই কথাগুলোর প্রভাব আমাদের আচরণের উপর পড়েছে।
এলিনর বলল, লরা পিসি কখনো সঠিকভাবে বলেননি। কিভাবে উনি ওর সম্পত্তি ভাগ বাঁটোয়ারা করে যাবেন।
রডি বলল, তাতে কিছু এসে যায় না। উনি যদি সম্পত্তি তোমাকে দিয়ে যান, তাতে কিছু ভাববার নেই, কারণ তার ভাগ আমিও পাবো কারণ আমি তো তোমায় বিয়ে করব। আবার বুড়ি ওয়েলম্যান বংশের পুরুষ উত্তরাধিকার হিসাবে বেশীরভাগ সম্পত্তি যদি আমাকেই দেন, তাতেও কিছু হবে না, কারণ তুমি তো আমায় বিয়ে করছে।
রডি বলল, ভাগ্য ভালো যে আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। তুমিও তো আমাকে ভালোবাস, বাসো না এলিনর?
এলিনর শান্ত নিরীহ গলায় উত্তর দিল, হ্যাঁ।
রডি বলল, আশ্চর্য মেয়ে তুমি এলিনর। এই যে তোমার মেজাজ, সব সময় একটা স্বতন্ত্র ভাব, ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তোমার এই গুণগুলোর জন্যই তোমায় এত ভালোবাসি।
রডি বলল, কোন কোন মহিলার অধিকারবোধ বড় বেশী, সব কিছু গ্রাস করে ফেলতে চায়, অথচ ভীষণভাবে অনুরক্ত, বিশ্বাসী, সব কিছুকেই তারা যেন ঘিরে থাকে। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা স্বতন্ত্র, যে কোন মুহূর্তে তোমার মেজাজ পাল্টে যেতে পারে, ঐ রকম শীতল নিস্পৃহভাবে তুমি খুব দূরের হয়ে যেতে পারো। খুব শান্ত গলাতেই বলতে পাশে, দ্যাখো আমি আমার মত পাল্টেছি, অদ্ভুত মোহময়ী চরিত্র তোমার এলিনর। জানো আমার মতে আমাদের বিয়েটা খুব ভালো হবে। আমরা দুজনেই দুজনকে যথেষ্ট ভালোবাসি, দুজনেই দুজনের বন্ধু, আমাদের রুচিরও মিল আছে। আমাদের মধ্যে সম্পর্কও আছে, অথচ সে সম্পর্ক বিয়ের ব্যাপারে বাধা নয়। আমাকে হয়তো তোমার বেশীদিন ভালো লাগবে না। কিন্তু তোমার ব্যাপারে আমার আগ্রহ কমবে না।
এলিনর জানাল, তা কখনোই হবে না।
রডি বলল, আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা জানাবার জন্যই যেন আমরা হান্টারবেরীতে যাচ্ছি, এই অজুহাতে ওখানে যাওয়া যায়।
রডি বলল, দুমাস হতে চলল আমরা ওখানে যাইনি। এখন যাবার সঙ্গে সম্পত্তির কোন সম্পর্ক নেই। স্রেফ মানসিক কারণে যেতে চাইছি।
এলিনর সম্মতি জানাতে রডি চিঠিটা পুড়িয়ে দিল আস্তে আস্তে, এবং চিন্তা করতে লাগল কে এমন চিঠি লিখতে পারে।
এলিনর ঠিক করল সমস্ত ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখে আসাই ভালো।
.
১.১.২
নার্স ও’ব্রায়ান মিসেস ওয়েলম্যানের ঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুমে ঢোকার মুখে বললেন, কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ার আগে এক পেয়ালা গরম চা নার্স হপকিন্সের নিশ্চয় ভালো লাগবে।
নার্স ও’ব্রায়ান বেশ লম্বা, লাল চুল, ত্রিশের কোঠায় বয়েস, ঝকঝকে সাদা দাঁত, মুখে ঘামাচির দাগ, এবং ঠোঁটে সর্বদা হাসি।
সরকারী নার্স হপকিন্স মাঝবয়সী মহিলা, শান্ত চেহারা, গাম্ভীর্য নিয়ে থাকেন, আদবকায়দা বেশ চোস্ত। তিনি প্রতিদিন সকালে মিসেস ওয়েলম্যানের পোশাক বদলানো, বিছানা ঠিক করা, বাথরুমের কাজ, সরানোর কাজে ও’ব্রায়ানকে সাহায্য করেন।
ও’ব্রায়ান জানাল এই বাড়িতে সবকিছুই বেশ নিয়মমাফিক আর ভালোভাবে চলে, যদিও সবই একটু সেকেলে ধরনের। এখানকার ঝি-চাকরগুলোও বেশ নম্র, ভদ্র। মিসেস বিশপ নিজের তদারকি করেন তাদের।
ক্ষুব্ধ সুরে হপকিন্স বললেন, আজকাল মেয়েগুলো একটা দিনও ভালোভাবে সব কাজ করতে পারে না, ও’ব্রায়ান মেরী জেরার্ডের প্রশংসা করলেন এবং হপকিন্স মেরীর জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেন।
নার্স ও’ব্রায়ানের ঘরে বসে দুজনে চা খেতে খেতে ও’ব্রায়ান বললেন, আজ টেলিগ্রাম এসেছে মিস কার্লিসল আর মিঃ ওয়েলম্যান এখানে আসছেন। ও’ব্রায়ান জানালেন যে মিঃ ওয়েলম্যান খুব সুন্দর মানুষ, তবে দেখলে একটু অহংকারী মনে হয়।
হপকিন্স জানালেন যে, ঐ মেয়েটার আঁকা ছবি তিনি ট্যাটলার হলে দেখেছেন।
ও’ব্রায়ান নার্স হপকিন্সকে জিজ্ঞেস করলেন যে, এলিনর সুন্দরী কিনা?
হপকিন্স জানালেন যে, মেরী জেরার্ডের ধারে কাছে যেতে পারবে না এলিনর কার্লিসল।
ও’ব্রায়ান চাপা সুরে হপকিন্সকে জানালেন, কাল রাতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে। রাত প্রায় দুটোর সময় রোগীকে পাশ ফিরিয়ে দিতে গিয়ে দেখেন উনি জেগে আছেন। অথচ যেন স্বপ্ন দেখছেন, কারণ খাটের কাছে যেতেই উনি বললেন, ফটোটা। ফটোটা আমার চাই।
ও’ব্রায়ান কার ফটো জানতে চাইলে তিনি বলেন, লিউইসের এবং বিছানার পাশে রাখা বক্স থেকে একটা চাবি বের করে ড্রেসিং টেবিলের দ্বিতীয় ড্রয়ারটা খুলতে বলেন। ওর মধ্যে রূপোর ফ্রেমে বাঁধানো দারুণ সুন্দর দেখতে এক ভদ্রলোকের ফটো ছিল। যার তলার দিকে এক কোণে আড়াআড়িভাবে লেখা লিউইস। ফটোটা ওঁর হাতে দিতেই অনেকক্ষণ সেটা দেখে অস্পষ্ট সুরে লিউইসের নাম নিলেন এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফটোটা আবার যথাস্থানে রেখে দিতে বললেন। এবং ও’ব্রায়ান চাবি বন্ধ করে ফিরে এসে দেখেন মিষ্টিমুখে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
হপকিন্স এক অদ্ভুত আনন্দে চিন্তান্বিত স্বরে বললেন, ধারে-কাছে ঐ নামের কোন লোককে তিনি চেনে না।
ও’ব্রায়ান মনে করিয়ে দিলেন যে, ব্যাপারটা অনেকদিন আগেকার। সম্মতি জানিয়ে হপকিন্স বললেন, তিনি মাত্র কয়েক বছর হল এখানে এসেছেন, তবে
ও’ব্রায়ান বললেন, লিউইস দারুণ রূপবান পুরুষ। দেখলে মনে হয় ঘোড়সওয়ার বাহিনীর একজন বড় অফিসার।
হপকিন্স চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো।
চটুল গলায় ও’ব্রায়ান বললেন, হয়তো ওঁরা পরস্পরকে ভালোবাসতেন, বাবা-মা হয়তো ওদের পথের কাঁটা হয়েছিলেন।
হপকিন্স বিষাদের সুরে বললেন, হয়তো যুদ্ধে মারাও গিয়ে থাকতে পারেন।
.
১.১.৩
ডিউটি সেরে হপকিন্স যখন বাড়ি ফিরছেন, তখন মেরী ছুটে এসে বলল, আমি কি আপনার সঙ্গে গ্রাম পর্যন্ত যেতে পারি?
সিস্টার সম্মতি জানাতে মেরী জানাল তার সঙ্গে কথা বলা তার একান্তই দরকার। সব বিষয়ে তার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
একুশ বছরের মেরী জেরার্ড। শাঁখের মতো সুন্দর গলা, হালকা সোনালী চুল, একরাশ ঢেউ খেলানো চুল তার রূপকে আরও মিষ্টি করে তুলেছে। চোখের তারা নীল।
মেরী জানাল যে, সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। এভাবে নিজেকে নষ্ট হতে দেওয়া তার একেবারেই উচিত নয়। সে মিসেস ওয়েলম্যানকে অনেকবার সেকথা বোঝাবার চেষ্টা করে পরাজিত। তিনি খালি বলেন, এতো ব্যস্ততার কি আছে।
হপকিন্স মেরীকে মনে করিয়ে দিলেন যে, মিসেস ওয়েলম্যান অসুস্থ।
লজ্জিত হয়ে মেরী বলল, সে চুপচাপ বসে না থেকে কিছু একটা করতে চায়, কিন্তু কোন কিছুর ট্রেনিং নিতে গেলে অনেক খরচপত্র করতে হবে। অসুস্থ মানুষকে সেবা করতে তার ভালো লাগে। তাই তার ইচ্ছা হাসপাতালে সে নার্সের চাকরী করবে।
হপকিন্স বললেন, তার জন্য শরীর স্বাস্থ্যকে একেবারে পাথরের মতো করা দরকার।
মেরী জানাল সে নার্সিং ভালোবাসে। ওর মাসি নার্স ছিলেন। অতএব ওর পক্ষে কোন অসুবিধা হবে না।
হপকিন্স মেরীকে নরল্যাণ্ডে গিয়ে ম্যাসেজ করা শিখতে পরামর্শ দিলে মেরী বলল, সেও ওকথা চিন্তা করেছিল, কিন্তু তাতে অনেক খরচ। মিসেস ওয়েলম্যান তার জন্য যথেষ্ট খরচ করেছেন।
হপকিন্স মেরীকে মাস্টারি করার পরামর্শ দিলে মেরী বলল, না, অতো মাথা আমার নেই। হপকিন্স বললেন যে, তার দৃঢ় বিশ্বাস মেরীর যাতে চলে যায় তার জন্য মিসেস ওয়েলম্যান কিছু না কিছু করবেনই। ওয়েলম্যান মেরীকে এত স্নেহ করেন যে, তাকে কাছ ছাড়া করতে চান না। পক্ষাঘাতে একটা অঙ্গ তার পড়ে গেছে। তুমিই যা একটু গল্পগুজব করে ওঁকে সঙ্গ দাও। নিজের চারপাশে তোমার মতো এমন একটা তরতাজা মেয়েকে সবসময় দেখতে পেলে মন বেশ আনন্দে ভরে থাকে। তাছাড়া রোগীর সামনে তার আচরণেরও প্রশংসা করলেন হপকিন্স।
কথাগুলো শুনে মেরী খুব খুশি হয়ে বলল, মিসেস ওয়েলম্যানকে তার ভীষণ ভালো লাগে। ওঁর জন্য সে সব কিছু করতে পারে।
হপকিন্স শুকনো গলায় বললেন, তাহলে তোমার উচিত যেখানে আছ সেখানেই থাকা, বেশী দিন লাগবে না…
একথা শুনে মেরী ভয়ে ভয়ে বলল আপনি কি বলতে চান…
হপকিন্স মাথা নেড়ে বললেন, এসব কেসে কি কি হয় তা তার অজানা নয়। বেশ ভালোই লড়ে গেছেন উনি, কিন্তু আর বেশীদিন নয়। এরপরে দ্বিতীয় তারপর তৃতীয় স্ট্রোক হবে। যদি শেষ কটা দিন মেরী বুড়িকে সুখে রাখতে পারে, তবে বাকীগুলোও ঠিকমত হয়ে যাবে।
এই কথা শুনে মেরী কিছু উত্তর দেবার আগেই হপকিন্স বললেন, ঐ তোমার বাবা আসছেন।
নার্স হপকিন্স বেশ হাসি ঝরিয়ে মিঃ জেরার্ডকে সুপ্রভাত জানালেন। প্রত্যুত্তরে ক্রাইম জেরার্ড মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করলেন।
নার্স হপকিন্স বললেন, আজ আবহাওয়াটা বেশ ভালোই, কি বলেন? উত্তরে মিঃ জেরার্ড বললেন আপনার পক্ষে ভালো হতে পারে, আমার জন্য নয়। আমার রাতের ব্যথাটা খুবই কষ্ট দিচ্ছে।
নার্স হপকিন্স প্রত্যুত্তরে কিছু বলতেই তিনি চটে গেলেন এবং নার্সদের আচরণ সম্পর্কে মন্তব্য করতে লাগলেন। আর মেরীকে লক্ষ্য করে বললেন, নার্স হবার চিন্তা ছেড়ে অন্য কিছু করা যায় কি না চিন্তা করতে।
মেরী কষ্ট করে বলে উঠলো, হাসপাতালের নার্স হতে পারলে তার পক্ষে ভালোই হবে।
একথার জবাবে মিঃ জেরার্ড মেরীকে অহংকারী অলস বললে মেরী বলল, একথা বলার কোন অধিকার তার নেই।
পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য হপকিন্স বেশ ভারী গলায় হালকা সুরে বললেন, মেরী বাবা হিসাবে তাকে যথেষ্ট ভালোবাসে।
এক বিজাতীয় ঘৃণার দৃষ্টি নিয়ে আপাদমস্তক মেরীকে দেখে নিয়ে জেরার্ড বলল, মেরীর ফরাসী বুকনী, ইতিহাস পড়া আর চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলা তার ভালো লাগে না। বলেই আধা-হাউসের ভিতরে ঢুকে গেল।
গল্পে গল্পে অনেকটা সময় কেটে গেছে। মেরীর কাছে বিদায় নিয়ে নার্স হপকিন্স ফিরে চললেন। এক নিঃসঙ্গতাবোধ আচ্ছন্ন করল মেরীকে। মেরী ভাবতে লাগল তাহলে কি করবে।
.
১.২.১
আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে ছিলেন মিসেস ওয়েলম্যান। ওঁর চোখ জোড়া, গাঢ় নীল, নাকটা বেশ খাড়া, বেশ মোটা ভারী মহিলা, অহংকার ও দৃঢ়তার মূর্ত প্রতীক। সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দৃষ্টি নেমে এল আর জানালার ধারে বসা মেরীর উপর পড়ল। সামান্য থেমে মেরীকে ডাকলেন। মেয়েটি চমকে উঠে একটু লজ্জিত হয়ে পড়ল। মিসেস ওয়েলম্যান বললেন, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমার সেবাযত্ন তুমি খুব করো…
মেরী কৃতজ্ঞতার সুরে বলল, তার সব কিছুর মূলেই মিসেস ওয়েলম্যান।
খাটের মধ্যে বেশ চঞ্চল হয়ে উঠলেন মহিলা এবং বললেন, ঠিক তা নয়…ঠিক তা নয়.. ঠিক বুঝতে পারি না…মানুষ যথাসাধ্য করতে চায়, কিন্তু কার পক্ষে কোনটা কত ভালো সেটা বিচার করা বড় মুশকিল হয়ে ওঠে। নিজের ওপর আমার সব সময়ই যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল…
মেরী বলে উঠল, না না। আমার তো মনে হয় আপনি কখনো ভুল করেন না।
লরা ওয়েলম্যান কথাটা যেন ঠিক মেনে নিতে পারলেন না-না, আমার খুবই দুশ্চিন্তা হয়। জানো মেরী আমি দারুণ অহংকারী। আর অহংকার সবচেয়ে বড় পাপ। এলিনরেরও একই দশা।
প্রসঙ্গ পাল্টাতে মেরী মিস এলিনর আর মিঃ রডরিকের প্রসঙ্গ তুলল।
স্নেহমাখা সুরে মিসেস ওয়েলম্যান বললেন, ওরা দুজনেই আমাকে ভালোবাসে। ওদের বললেই চলে আসবে। কিন্তু ঘনঘন আসতে বলতে পারি না। অসুস্থ মানুষ মৃত্যুর পরিবেশে ওদের টেনে এনে আরও পাপের ভাগী হতে চাই না আমি।
আমার তো মনে হয় না ওঁরা ওরকম চিন্তা করতে পারেন।
খানিকটা আত্মগত ভাবে বললেন তার বিশ্বাস ওরা বিয়ে করবে। কিন্তু নিজে উপযাজক হয়ে কথাটা বলা তিনি ঠিক মনে করেননি। ওরা যখন খুব ছোট তখন তার মনে হত এলিনর রডিকে ভালোবাসে। কিন্তু রডি যে ওকে ভালোবাসে সেটা ঠিক বুঝতে পারতেন না। হেনরীও রডির মতোই ছিল অত্যন্ত চাপা, খুঁতখুঁতে…মিসেস ওয়েলম্যানকে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিড়বিড় করে বললেন কততদিন…কতোদিন আগেকার কথা…বিয়ের পাঁচবছর পরেই ও চলে গেলোলা, ডবল নিমোনিয়ায়…বিয়েতে আমরা খুব সুখী হয়েছিলাম কিন্তু সে সুখ স্থায়ী হল না। তখন আমি অদ্ভুত শান্ত মেয়ে ছিলাম…বুদ্ধিসুদ্ধি তখনও পাকেনি, মাথায় তখন নানা চিন্তা, স্বপ্ন কল্পনার জগতে ঘুরে বেড়াই…বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না…
তার মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে হেনরী চলে যাবার পর মিসেস ওয়েলম্যান খুব নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এখন তার বয়স ষাট। দীর্ঘদিন…তাই না? কণ্ঠস্বর ঈষৎ খাদে নামিয়ে বললেন…আর আজ এই অবস্থায় এসে পৌঁছেছি..
ওয়েলম্যান ও’ব্রায়ানের প্রশংসা করে বললেন, মেরীকে সবসময় পান বলে তিনি খুব সুখে আছেন। সে কাছে থাকলে তার বেশ ভালো লাগে।
হঠাৎ মিসেস ওয়েলম্যান মেরীকে বললেন, মেরীর ভবিষ্যতের ব্যাপারটা তার ওপরই থাক। তিনি এমন ব্যবস্থা করবেন যে, মেরীকে কারুর গলগ্রহ হয়ে থাকতে হবে না। যে কোন পেশা সে ইচ্ছা করলেই নিতে পারবে। তারপর বললেন তার কাছে মেরীর থাকাটার দাম অনেক বেশী।
মেরীকে তিনি বললেন যে তুমি আমার মেয়ের মতো মেরী। এই হান্টারবেরীতে তোমাকে ছোট্ট অবস্থা থেকে বড় হতে দেখেছি, তোমার জন্য আমার গর্ব হয়। আমার একমাত্র আশা, তোমার যাতে মঙ্গল হয় তা যেন করতে পারি।
মেরী জানাল সে মিসেস ওয়েলম্যানের কাছে কৃতজ্ঞ। সে কখন উপার্জন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার কারণ কেউ যেন মনে না ভাবে যে সে মিসেস ওয়েলম্যানকে শুষছে।
লরা ওয়েলম্যানের মেরীকে আশ্বস্ত করে বললেন যে, এ প্রশ্ন কখনই ওঠেনি আর ভবিষ্যতে উঠবেও না। তিনি আর বেশীদিন নেই।
মেরী তাকে আশ্বস্ত করে বলল, ডাঃ লর্ড বলেছেন তিনি আরো বেশ কয়েক বছর বাঁচবেন। মিসেস ওয়েলম্যান বললেন, তিনি ডাক্তারকে বলেছিলেন কোন ওষুধ দিয়ে তাকে শেষ করে দিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আর ঐ অভদ্র ছোকরা ডাক্তার তাকে বলে, মিসেস ওয়েলম্যানের জন্য উনি ফাঁসিতে ঝোলবার ঝুঁকি নিতে পারেন যদি তিনি তার সব সম্পত্তি তার নামে লিখে দেন।
মিসেস ওয়েলম্যান বললেন, ডাক্তার দুর্বিনীত হলেও ওকে তাঁর ভালো লাগে। ওষুধের চেয়ে ডাক্তারের উপস্থিতিই তার বেশী উপকার করে।
মেরী সম্মতি জানাল।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ গাড়ির শব্দ শোনা গেল জানালার বাইরে। মেরী জানালা দিয়ে দেখল মিস এলিনর আর মিঃ রডরিক এসেছেন।
.
১.২.২
মিসেস ওয়েলম্যান, বোনঝি এলিনর আর রডির ব্যাপারটায় খুব খুশী। তারা একসাথে এসেছে দেখে তিনি খুব খুশী হলেন।
বৃদ্ধা ওয়েলম্যান এলিনরকে বললেন, তিনি মনে করেন এলিনর রডিকে একটু বেশী মাত্রায় পছন্দ করে কিন্তু এলিনরের জবাব শুনে খুশী হয়ে বললেন, রডি চায় না ভালোবাসার নামে কেউ ওকে পুরোপুরি কজা করে নিক। আর এলিনরের তুলনায় রডি তাকে বেশী পছন্দ করলেই তারা সুখী হবে বলে মনে করেন মিসেস ওয়েলম্যান।
এলিনর মনে করে ছেলে বন্ধুকে সব সময়ে ধাঁধার মধ্যে রাখা ভালো। এলিনর লরা মাসিকে প্রশ্ন করে ভালোবাসা জিনিসটা কি সত্যিই সুখের?
লরা মাসি এলিনরকে জানান অন্য কোন মানুষকে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে চাইলে আনন্দের চেয়ে দুঃখই বেশী হয়। তবে এই অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি বাদ দিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে না। যে কোন দিন প্রেমে পড়েনি, সে কোনদিন সত্যিকারের জীবন উপভোগ করেনি।
এলিনর মাথা নেড়ে সায় দিয়ে লরা মাসিকে কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল এমন সময় নার্স ও’ব্রায়ান এসে জানাল ডাক্তারবাবু এসেছেন।
.
১.২.৩
ডাক্তার লর্ডের বয়স বছর বত্রিশ। চুলের রং বালি-বালি, মুখে ব্রনোর চিহ্ন, চেহারা খুব ভালো না হলে দেখতে মন্দ নয়। চওড়া চোয়াল। চোখের দৃষ্টি-তীক্ষ্ণ, চোখের তারা হাল্কা নীল রঙের, সব কিছু যেন ভেদ করে দেখতে চায়।
ডাক্তার মিসেস ওয়েলম্যানকে সুপ্রভাত জানালেন। প্রত্যুত্তরে মিসেস লরা ওয়েলম্যান ডাক্তারকে সুপ্রভাত জানিয়ে তার বোনঝির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন এবং হাত বাড়িয়ে ডাক্তার এলিনরের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় সারলেন।
এলিনর ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করলে ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষা করার জন্য বিছানার দিকে এলেন। কতকগুলো রুটিনমাফিক পরীক্ষা আর প্রশ্নোত্তরের পর ডঃ পিটার লর্ড জানালেন মিসেস ওয়েলম্যান এখন অনেক সুস্থ।
মিসেস ওয়েলম্যান জানতে চাইলেন যে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি হেঁটে চলে বেড়াতে পারবেন কিনা।
ডঃ লর্ড বললেন, বেঁচে থাকাটা মানুষের এক স্বাভাবিক অনুভূতি। আমরা যখন মনে করি ঐ লোকটার মরে যাওয়াই ভালো তখন কিন্তু সে লোকটা আদৌ মরতে চায় না। আবার বেঁচে থাকার সব উপকরণ যার হাতের মুঠোয়, দেখা যায় হঠাৎ সেই লোকটা দুম করে মরে গেল।
ডাঃ বললেন, মিসেস ওয়েলম্যান ঐ শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পড়েন যারা মরতে ভয় পায়।
কথার মোড় ফিরিয়ে মিসেস ওয়েলম্যান জিজ্ঞেস করলেন, জায়গাটা তার কেমন লাগছে। সে ডাক্তারীতে আরও পড়াশুনা করে স্পেশালাইসড হতে চায় কিনা?
ডঃ লর্ড জানালেন, তার কোন উচ্চাভিলাষ নেই। সাধারণ মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক অসুখবিসুখ সারাতে তার ভালো লাগে। চলতি চিকিৎসাতে কোন পরিবর্তন আনা যায় কিনা তার জন্য হাতে-কলমে গবেষণাও তার ভালো লাগে। সে এখানে থেকেই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে চায়।
ডঃ চলে যাবার উদ্যোগ নিলে মিসেস ওয়েলম্যান তাকে জিজ্ঞেস করলেন তার বোনঝিকে ডাক্তারের কেমন লাগল। একথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে।
মিসেস ওয়েলম্যান বললেন, এবার তোমার বিয়ে করা উচিত ডাক্তার।
.
১.২.৪
বাগানে ঘুরতে ঘুরতে রডির মনে হল এলিনরের সঙ্গে ওর সম্পর্কটা বোঝা তার পক্ষে বেশ কষ্টকর। এলিনর তার মনের কথা ঠিকমতো প্রকাশ করে না। আবার এলিনরের চরিত্রের এই দিকটাই রডির ভালো লাগে। রডি চিন্তা করে দেখল এলিনরের আচরণ বা ব্যবহারের ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায় না, বা মনে আঘাত লাগে না। এলিনর দেখতে সুন্দর, বুদ্ধিমতী। ওকে পেয়ে সে সত্যিই সুখী, সৌভাগ্যবান। এলিনরের মতো মেয়ে কি করে ওকে বিয়ে করতে রাজী হল রডি তাই ভাবে।
মানুষ নিজের অবস্থা সঠিকভাবে মানতে পারলে সুখীই হয়। রডি ভাবল এলিনর যদি বিয়েটা পিছিয়ে না দেয় তবে ওদের শীগগির বিয়েটা হবে। প্রথম দিকে টানাটানি চললেও পরে প্রচুর টাকা হাতে আসবে তার। রডির ইচ্ছা হল ওয়েলম্যান কত টাকা রেখে গেছেন। আর কিভাবেই বা কাকে কি দিয়ে গেছেন।
বাগানের লাগোয়া জঙ্গলে অজস্র-ডাফোডিল ফুটে আছে। মুহূর্তের জন্য তাকে এক চঞ্চলতা গ্রাস করল। ওর মনে হতে লাগল কোথায় কিসের যেন অভাব তার রয়ে গেছে, কি যেন চেয়েছিল, আজও পায়নি সে। আর ঐটাই সে যেন চায়, ভীষণ ভাবে চায়।
সোনালী সবুজ আলো আর মিষ্টি বাতাসের নরম স্পর্শে তার নাড়ীর স্পন্দন বেড়ে গেল। তার সমস্ত-সত্ত্বা চঞ্চল হয়ে উঠল। হঠাৎই তার সামনে একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে এসে দাঁড়াল। আর স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে পড়ল রডি, চোখের সামনে সমগ্র জগৎ যেন ঘূর্ণির মতো পাক খেতে লাগল, কিছুক্ষণ বাদে মেয়েটি নিজের পরিচয় দিয়ে জানাল সে মেরী জেরার্ড।
রডি এতই সম্মোহিত হয়ে পড়েছিল যে এলিনরের পায়ের শব্দ তার কানেই গেল না। এলিনর জানাল, ও’ব্রায়ান মেরীকে খুঁজছে মিসেস ওয়েলম্যানকে তুলতে সাহায্য করার জন্য। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে মেরী ছুটে গেল হরিণীর মতো।
রডি বলল, ঠিক যেন অ্যাটল্যান্টা…
এলিনর জবাব না দিয়ে বলল, লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে, তাদের ফেরা দরকার। তারা ফেরার জন্য পা বাড়াল।
.
১.২.৫
গ্রেটা গার্বোর ছবি দেখবার নিমন্ত্রণ জানাল টেড, কিন্তু মেরী জানাল কিছুতেই সে এখন সিনেমায় যেতে পারবে না।
টেড রাগ দেখিয়ে বলল, মেরী জার্মানী থেকে পড়ে আসার পর অনেক বদলে গেছে।
মেরী জানাল, সে কিছুমাত্র বদলায়নি।
টেড ও মেরীর কথোপকথনের মাঝখানে হঠাৎ এক মহিলা আবির্ভূত হয়ে তীব্র দৃষ্টিতে দুজনকে দেখলেন। টেড দুপা পিছিয়ে মিসেস বিশপকে গুড আফটারনুন জানাল। মিসেস বিশপও প্রত্যুত্তরে টেড ও মেরীকে গুড আফটারনুন জানালেন।
মিসেস বিশপ চলে যেতে মেরী ও টেড আবার কথা শুরু করল। মেরীর মতে ভদ্রমহিলা তাকে অপছন্দ করেন। তাকে দেখলেই বেশ কড়া কথা শুনিয়েছেন।
টেড তাকে আশ্বস্ত করতে বলল যে, বহুদিন মিসেস বিশপ ঘর-সংসারের দেখাশোনা করছেন। সবাইকে হুকুমে রেখেছেন। বুড়ি ওয়েলম্যান এখন মেরীকে সুনজরে দেখছেন বলে মিসেস বিশপ তাক ঈর্ষা করেন।
ঈর্ষা জিনিসটা বড্ড-বাজে, মেরী বলল।
একথার জের টেনে টেড কিছু বলতে শুরু করলে মেরী তাড়াতাড়ি নার্স হপকিন্সের বাড়িতে চা-এর নিমন্ত্রণের কথা জানিয়ে বিদায় নিল। টেড রাগত দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
১.২.৬
নার্স হপকিন্স গ্রামের একপ্রান্তে একটি কটেজে থাকেন। মেরী সেখানে পৌঁছে দেখল নার্স হপকিন্স সবেমাত্র কটেজে ফিরেছেন। এটা-ওটা কথার পর হপকিন্স টেড বিগল্যাণ্ডের কথা তুললেন এবং মেরীকে বললেন, ছেলেটা খুবই ভালো, গ্যারেজের কাজকর্মও ভালোই শিখেছে। আর অন্যান্য চাষীদের তুলনায় ওর বাবার চাষবাসও ভালোই হয়। তবে তোমাকে টেড বিগল্যাণ্ডের বৌ হিসাবে মানাবে না। তোমার জায়গায় আমি হলে সুযোগ পেলে ম্যাসাজের কাজ শিখে নিতাম।
মেরী জানাল, মিসেস ওয়েলম্যানের সঙ্গে তার কথা হয়েছে, তিনি ওকে ছাড়তে রাজী নন এখনই। মেরীর ভবিষ্যত সম্পর্কে কোন চিন্তা করতে বারণ করেছেন।
নার্স হপকিন্স বললেন, যা করবেন তা যেন লেখাপড়া করে রাখেন, কখন কি হয় বলা যায় না। মেরীকে মিসেস বিশপ যে পছন্দ করেন না এবং তার কারণ যে মিসেস ওয়েলম্যানের মেরীর প্রতি সহানুভূতি তা নার্স হপকিন্স মেরীকে জানান।
.
১.৩.১
ডাক্তার লর্ডের টেলিগ্রাম পেয়ে এলিনর আর রডি হান্টারবেরী এসে পৌঁছাল।
হান্টারবেরীতে প্রথম যাবার পর রডির সঙ্গে এলিনরের তেমন দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। রডি সম্বন্ধে এলিনর যেন আগের তুলনায় নিরাসক্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু মাসির দ্বিতীয় স্ট্রোকের টেলিগ্রাম পেয়ে ওদের মধ্যে সম্পর্কটা আবার স্বাভাবিক হয়ে এল।
ট্রেনে যেতে যেতে তারা লরা মাসির সম্পর্কে নানা আলোচনা করতে লাগল। স্বভাবতই ডাঃ লর্ডের কথা উঠল। এবং ডাঃ লর্ড সম্পর্কে রডির অবিশ্বাস বেশ ভালো বোঝা গেল।
.
১.৩.২
কপালে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে ডাক্তার লর্ড রোগিণীর জড়ানো কথাগুলোর মানে বোঝবার চেষ্টা করছিলেন এবং মিসেস ওয়েলম্যান যা যা চাইছেন, যেভাবে চাইছেন সব কাজ সেভাবেই হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিতে মিসেস ওয়েলম্যান পরম স্বস্তিতে চোখ বুঝলেন। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দুজন নার্সকে যা যা করার নির্দেশ দিলেন। তারপর নীচে নেমে এলিনর আর রডির জন্য অপেক্ষা করতেই দেখা হল মেরী জেরার্ডের সঙ্গে। উদ্বিগ্ন মুখে মিসেস ওয়েলম্যানের অবস্থার খবর নিলেন। কথার মাঝেই একটা গাড়ির শব্দ হল। ড্রইংরুমে পা দিতেই এলিনর চেঁচিয়ে উঠল, ওঁর অবস্থা কি খুবই খারাপ? রডির মুখ শুকনো, আশংকায় ভরা।
দুঃখিত হয়ে গম্ভীর সুরে ডঃ লর্ড বললেন, ওঁর পক্ষাঘাত হয়েছে। কথা প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না। তবে উনি একটি ব্যাপারে দারুণ উদ্বিগ্ন। কাজটা কি ঠিক জানি না, তবে উকিলকে ডাকার কথা বলছেন।
এলিনর ডনাল উকিল মিঃ সেলডনকে সে চেনে। এরপর এলিনর আর ডাক্তার মিসেস ওয়েলম্যানের ঘরে গেলেন। ঝুঁকে পড়ে এলিনর দেখল লরা মাসির মুখটা সামানা বেঁকে গেছে। হঠাৎ চোখ খুলে এলিনরকে চিনতে পারলেন মিসেস ওয়েলম্যান।
অসুস্থ মহিলার গলা থেকে কতকগুলো জড়ানো শব্দ বেরিয়ে এল এবং শেষ পর্যন্ত এলিনর বুঝতে পারল যে মাসি তাঁর উইলে মেরীর জন্য কোন ব্যবস্থা করতে চান। তিনি যেমন চান তেমনই কাজ হবে প্রতিশ্রুতি দিল এলিনর।
রোগিণী স্বস্তি পেলেন। চোখের দৃষ্টিতে যে করুণ আবেদন ফুটে উঠেছিল তা ধীরে ধীরে প্রশান্তির প্রলেপে সুন্দর হয়ে উঠল।
ডঃ লর্ড আর এলিনর বাইরে এসে দেখলেন সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে মেরী জেরার্ড নার্স হপকিন্সের সঙ্গে কথা বলছে। মেরী ডাক্তারের পরামর্শ শুনে মিসেস ওয়েলম্যানের ঘরে ঢুকলো। এলিনর মাথা ঘুরিয়ে ঘরের মধ্যে মেরীকে দেখছিল। দেখল চোখে মুগ্ধতা নিয়ে ডাক্তার পূর্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে আছে। লজ্জা পেয়ে এলিনর ডাক্তারের মুগ্ধতা কাটাল।
নার্স হপকিন্স নাক টানলেন। এলিনর বলল, দুঃখ হয় মাসির জন্য, ওর অবস্থা দেখে যা কষ্ট পেয়েছিলাম বলার নয়।
তা ঠিক, তবে আপনি ভাবভঙ্গিতে তা প্রকাশ করেননি। দারুণ সংযমের পরিচয় দিয়েছেন।
ঠোঁটে দৃঢ়তা ফুটিয়ে এলিনর বলল, মনের ভাব প্রকাশ না করার শিক্ষা আমার আছে।
ডাক্তার ধীরে ধীরে বললেন, তবে একদিন না একদিন মুখোস খুলে পড়বেই।
মুখোস?
তাঁ, মানুষের মুখ মোটামুটিভাবে একটা মুখোস ছাড়া আর কি হতে পারে?
তার আড়ালে?
তার আড়ালে আছে আদিম নারী-পুরুষ। কোন কথা না বলে দ্রুত পায়ে এলিনর নীচে নেমে এল।
রডি উদ্বেগের সঙ্গে খবর জানতে চাইল।
এলিনরের পরেই নীচে নেমে এসেছিল ডঃ লর্ড।
এলিনরকে জানাল তার আর করবার কিছু নেই। সকালের দিকে তিনি একবার আসবেন।
ডঃ লর্ডের করমর্দনের স্পর্শে এক অদ্ভুত আশ্বাসের ধ্বনি সঞ্চারিত হল এলিনরের দেহে-মনে। এলিনরের মনে হল ডাক্তার ওর জন্য দুঃখ বোধ করছে।
ডাক্তার চলে যেতে রডি জিজ্ঞেস করল, উনি কি বিশেষ কিছু করতে চাইছেন?
এলিনর জানাল, লরা মাসি কোন কাজের ব্যাপার হয়তো চিন্তায় আছেন। আপাততঃ ওঁকে বুঝিয়ে শান্ত করে এসেছি যে মিঃ সেলডন কাল সকালেই আসছেন।
রডি প্রশ্ন করল, উনি কি কোন নতুন উইল করতে চান?
উনি কি বললেন…প্রশ্নটা করতে করতে মেরীর দিকে রডির দৃষ্টি নিবদ্ধ হল এবং কথা মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গেল।
কড়া গলায় এলিনর বলল, কি যেন প্রশ্ন করছিলে তুমি? রডি দরজার দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
রডির হাবভাব দেখে এলিনর এমনভাবে হাতের মুঠো বন্ধ করল যে তালুতে নখ বসে গেল তার। মনে মনে বলল, এ আমার সহ্যের অতীত, এতোটা আমি সহ্য করতে পারি না…এটা কি বাজে ভাবনা নয়, সত্যিই…রডি…রডি…আমি কিছুতেই তোমাকে হারাতে পারবো না।…
এদিকে আবার এলিনরের মনে অন্য এক চিন্তার জাল ছড়িয়ে পড়ল। ঐ লোকটা…ঐ ডাক্তার…দোতলায় কি দেখছিল ও আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে…।
হায় ভগবান কি অসহ্য এই জীবন কি এক বিশ্রী ভাবনা আমাকে পেয়ে বসেছে। কিছু একটা বলো বোকা হাঁদা। নিজেকে সামলাও…?
এলিনর স্বাভাবিক ভাবে বলল, তার খিদে পায়নি। মনে মনে চিন্তা করল ওর সঙ্গে একা বসে সে আর খেতে পারবে না, জোর করে আগের মতো স্বাভাবিক ব্যবহার করতে বা কথা বলতে পারবে না। তারপরেই চঞ্চল হয়ে উঠে বলল, কাজগুলো আমায় নিজের মতো করে করতে দাও।
.
১.৪.১
পরদিন সকালে মিসেস বিশপ এলিনরকে জানালেন সেই শোকবার্তা। মিসেস ওয়েলম্যান তার অত্যন্ত প্রিয় মনিব ঘুমের মধ্যেই মারা গেছেন। একেবারে হঠাৎই ঘটে গেল।
একটু কড়া গলায় এলিনর বলল, একেবারে হঠাৎ নয়। উনি তো বেশ কিছুদিন ধরেই ভুগছিলেন। আমি একটা ব্যাপারে কৃতজ্ঞ যে ওকে বেশীদিন কষ্ট ভোগ করতে হয়নি।
এলিনর লরা মাসির মৃত্যুর খবর রডিকে জানাল।
গতকাল যে অবস্থায় দেখেছিলাম ওঁকে, ঐরকম বেশীদিন চললে আমার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠতো?
রডি যে লরা মাসিকে কাল দেখতে গেছিল একথা প্রকাশ হয়ে পড়ায় লজ্জা লজ্জা মুখে রডি জানাল, এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেও কাল সন্ধেবেলা একবার সে গিয়েছিল মিসেস ওয়েলম্যানের ঘরে। নার্স গরম জলের বোতল নিয়ে নীচে গেলেন সে ফাঁক পেয়ে ঢুকে পড়েছিল। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে মিসেস গাম্পকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখে চট করে বেরিয়ে পড়েছিল।
মিসেস ওয়েলম্যান চলে গিয়ে যে একপ্রকার উনি মুক্তিই পেয়েছেন এলিনর আর রডি এই নিয়ে আলোচনা করছিল।
.
১.৪.২
নার্স হপকিন্স উত্তেজিত মুখে গত সন্ধ্যায় হলঘরে ফেলে যাওয়া অ্যাটার্চি কেসটাকে পাগলের মতো হাতড়াচ্ছিলেন। এমন একটা কাজ তিনি যে কিভাবে করতে পারেন তা ভেবে নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছিলেন। নার্স ও’ব্রায়ানের প্রশ্নের জবাবে নার্স হপকিন্স জানাল পেটে টিউমারের দরুণ এলিজা রাইকিনকে সকালে বিকেল মরফিন ইনজেকশন দিতে হয়। কাল একটা নতুন বাক্স কিনে ব্যাগে রেখেছিলেন। কিন্তু আজ সকাল সেটা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না।
নার্স হপকিন্স বললেন, এই হলঘর ছাড়া অন্য কোথাও তিনি কেসটা রেখে যাননি। আর এখানে তুলে নেওয়ার মতো কেউই নেই। তাকে অনেকটা পথ গিয়ে আবার মরফিন কিনতে হবে।
এরপর নার্স ও’ব্রায়ান এবং নার্স হপকিন্সের মধ্যে মিসেস ওয়েলম্যান সম্পর্কে কথা শুরু হল। নার্স ও’ব্রায়ান বলল, ডাঃ ওঁর রোগীদের সম্বন্ধে সবসময়েই একটু বেশী আশাবাদী।
নার্স হপকিন্স জানাল, ডঃ লর্ডের অভিজ্ঞতা অনেক কম এবং বয়েসটাও কম তাই তিনি একটু বেশীই আশাবাদী।
.
১.৪.৩
নার্স ও’ব্রায়ান ডঃ লর্ডকে খবরটা দিলেন। ডাঃ লর্ড চমকে উঠলেন খবরটা শুনে এবং কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে হঠাৎই একটু গরম জল আনতে বললেন। নার্স ও’ব্রায়ান চমকে উঠলো। কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেল ডাক্তারের হুকুম তামিল করতে।
.
১.৪.৪
রডারিক ওয়েলম্যান মিঃ সেলডনকে বললেন, আপনি কি বলতে চান মিসেস ওয়েলম্যান উইল করে যাননি, না কি আদৌ কোন উইল করেননি উনি।
মিঃ সেলডন জানালেন সত্যিই তিনি কোন উইল করেননি। রডি জানতে চাইল আপনি কখনও ওঁকে উইল করার কথা বলেনি, বোঝননি যে এটা করে রাখা ভালো। মিঃ সেলডন বললেন, লোকেরা মনে করে তারা অনেকদিন বাঁচবে, আর উইল করলেই মৃত্যু এগিয়ে আসে। মিসেস ওয়েলম্যানকে তিনি বহুবার উইল করার কথা বলেছেন কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। হয়তো মনস্থির করে উঠতে পারেননি, সম্পত্তি কাকে কিভাবে দিয়ে যাবেন।
এলিনর বলল, কিন্তু প্রথম স্ট্রোক হয়ে যাবার পর নিশ্চয়ই…
মিঃ সেলডন বললেন, মিসেস ওয়েলম্যান হয়ত মরার কথা চিন্তা করতেন, সেই সঙ্গে এটাও ভাবতেন যে উনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন। আর হয়তো এই আশাতেই তিনি উইল করাটাকে অশুভ বলে মনে করেছিলেন। তবে তিনি উইল করবেন না একথা কখনোই বলেননি।
ডঃ বললেন, মানুষ যখন কোন অপছন্দের বিষয়কে এড়িয়ে যেতে চায় তখন কিভাবে এড়ায় জানেন?
মিসেস ওয়েলম্যান সবসময় উইল করার জন্য পরের কোন একটা দিনকেই প্রশস্ত দিন বলে মনে করতেন।
ধীরে ধীরে এলিনর বলল, তার জন্যই কি তিনি কাল রাতে আপনাকে আসবার জন্য বলেছিলেন?
নিঃসন্দেহে–তাই।
উকিলবাবু জানালেন, যেহেতু উইল না করেই মিসেস ওয়েলম্যান মারা গেছেন তাই তার সব সম্পত্তির অধিকারী হবে মিস এলিনর কার্লিসন। সরকার একটা অংশ কেটে নেবে। যেহেতু সম্পত্তির ব্যাপারে কোন সেটেলমেন্ট বা ট্রাস্ট করা হয়নি অতএব সবকিছু সোজা মিস এলিনরের হাতে এসে পড়ছে। ডেড ডিউটি প্রভৃতি ট্যাক্সগুলো দিয়েও যা টাকা থাকবে সেটার পরিমাণ খুব কম নয়। মিঃ সেলডন জানালেন রডারিক ওয়েলম্যান সম্পত্তির কিছু পাবেন না কারণ তিনি মিসেস ওয়েলম্যানের স্বামীর ভাইপো। তার সঙ্গে কোন রক্তের সম্পর্ক রডারিকের নেই।
রডি মিঃ সেলডনের কথায় সম্মতি জানাল।
.
১.৪.৫
মিঃ সেলডন চলে যাবার পর মুখোমুখি হল এলিনর আর রডারিক। প্রায় মিনতির সুরে এলিনর বলল, তাতে কিছু আসবে যাবে না, তাই তো রডি? লণ্ডনে তো আমরা দুজনে মিলে ঠিকই করেছিলাম আমাদের যে কেউই সম্পত্তি পাক না কেন, চিন্তার কোন কারণ নেই, কারণ আমরা তো বিয়ে করতে যাচ্ছি।
রডিকে নিরুত্তাপ দেখে এলিনর বলল, কিন্তু আমরা কি বিয়ে করতে যাচ্ছি রডি?
আমার তো মনে হয় সেই রকমই কিছু একটা ঠিক ছিল। রডির কথার মধ্যে বেশ উপেক্ষা ও রুক্ষতার ভাব। তবে এখন যদি তুমি অন্যকিছু ভেবে থাকো?
এলিনর প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, তোমার কাছ থেকে কি একটুও আন্তরিকতা আশা করতে পারি না?
রডি বলল, স্ত্রীর পয়সায় খেতে আমার খুব ভালো লাগবে বলে তো মনে হয় না।
এলিনর সাদা মুখে রুক্ষভাবে বলল-আসল ব্যাপারটা তাই নয়, ব্যাপারটা মেরী? তাই না?
মেরীর ব্যাপারটা রডি পরিষ্কার ভাবে জানাল এলিনরকে। বলল, আমি ওর প্রেমে পড়তে চাইনি।
…তোমাকে নিয়ে আমি বেশ সুখীই ছিলাম। তুমি অসাধারণ এলিনর। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি আমি। এই ব্যাপারটা একটা মোহের ব্যাপার। সব কিছু গণ্ডগোল হয়ে যাচ্ছে…
এলিনর শান্ত গলায় বলল, প্রেম খুব একটা যুক্তি মেনে চলে না…
রডি জানাল, মেরীকে সে কিছু বলতেই মেরী তাকে সঙ্গে সঙ্গে থামিয়ে দেয়।
হাতের হীরের আংটিটা রডিকে ফিরিয়ে দিতে চাইল এলিনর।
মেরীর মনোভাব জানার চেষ্টা করতে বলল এলিনর। এবং একই সঙ্গে তার মনে হল মেরী যদি না থাকতো।…
.
১.৫.১
নার্স হপকিন্স ও নার্স ও’ব্রায়ান মিসেস ওয়েলম্যানের শেষকৃত্য সম্পর্কে আলোচনা করছিলেন ব্লু টিট কাফেতে। নার্স হপকিন্স মিস কার্লিসলের উদারতায় মুগ্ধ। মিসেস ওয়েলম্যানের উইল করে যাওয়া উচিত ছিল বলে বললেন নার্স হপকিন্স।
উইল করে গেলে মিসেস ওয়েলম্যান কাকে সম্পত্তি দিতেন এ প্রশ্ন করতেই বেশ দৃঢ় সুরে নার্স হপকিন্স বললেন, উনি অন্ততঃ কিছু টাকা মেরীকে দিতেনই।
তার কথায় সায় দিয়ে নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, যেদিন রাতে মিসেস ওয়েলম্যান খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন সেদিন বৃদ্ধা দুবার মেরীর নাম উচ্চারণ করেছিলেন। এবং খোলাখুলি বলেছিলেন মেরীকে কিছু দিতে হবে।
নার্স ও’ব্রায়ান জোর গলায় বললেন, উইল করে গেলে হয়তো উনি শেষ কানাকড়িটাও মেরী জেরার্ডকে দিয়ে যেতেন।
দ্বিধাগ্রস্ত নার্স হপকিন্সের মতে নিজের রক্তের লোককে না দিয়ে অন্য কাউকে সম্পত্তি দেওয়া উচিত নয়।
নিজের রক্তের লোক কথাটা শুনে বেশ রহস্য করে গাম্ভীর্য বজায় রেখে নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, আমি গুজব ছড়াতে চাই না। আর মৃত লোককে ব্ল্যাকমেলও করতে চাই না।
নার্স হপকিন্স নার্স ও’ব্রায়ানের সঙ্গে সম্মত হলেন– চায়ে চুমুক দিয়ে ও’ব্রায়ান এবার মরপিনের শিশিটার কথা তুললেন।
নার্স হপকিন্স জানালেন মরপিনের শিশিটার অদৃশ্য হওয়াটা একটা রহস্যের মতো।
.
১.৫.২
মিসেস ওয়েলম্যানের লেখার টেবিলের সামনে বসে এলিনর সবার ইন্টারভিউ নিচ্ছিল। মিসেস বিশপের পর মেরী জেরার্ডের পালা। মেরী এসে তার আসন গ্রহণ করতে পেশাদারী নিস্পৃহতায়–এলিনর বলল, যেহেতু মাসি উইল না করেই মারা গেছেন, তাই তাঁর ইচ্ছাকে ফলবতী করার দায়িত্ব তার। মিঃ সেলডনের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং তারই উপদেশ অনুসারে চাকরদের কাজের ভিত্তিতে কিছু জেরার সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে যদিও মেরী সেই শ্রেণীর মধ্যে পড়ে না এবং শেষদিন সন্ধ্যাবেলায় মিসেস ওয়েলম্যান মেরীর ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু ব্যবস্থা করার কথা বলছিলেন তাই মেরীকে সে ২০০০ পাউণ্ডের ব্যবস্থা করে দেবে। ও টাকাটা মেরী যেভাবে খুশি খরচ করতে পারবে।
মেরী এলিনরকে কৃতজ্ঞতা জানাল। এলিনর মিঃ সেলডনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে আপাততঃ কিছু টাকা যদি পাইয়ে দেওয়া সম্ভব হয় মেরীকে তার প্রতিশ্রুতি দিল। মেরী বিদায় নিল।
.
১.৫.৩
এলিনর রডিকে জানাল মিসেস বিশপকে পাঁচশো, রাঁধুনিকে একশো, মিলি আর ওলিবকে পঞ্চাশ করে আর অন্যদের পাঁচ পাউণ্ড করে, মালী স্টিভেনকে ২৫ পাউণ্ড দেওয়া সে ঠিক করেছে। তবে মেরীর বাবার জন্য কিছুই আপাততঃ ঠিক করেনি। তবে এলিনর মনে করে জেরার্ডের জন্য পেনসনের ব্যবস্থা করতে হবে। মেরীকে দুহাজার পাউণ্ড দেবার সিদ্ধান্তের কথাও রডিকে জানাল এবং আইনগতভাবে রডিওর কিছু প্রাপ্য জানাল।
রডির লম্বাটে মুখ রাগে সাদা হয়ে গেল, বলল, এলিনর, তুমি ভাবলে কি করে যে তোমার কাছে আমি হাত পাতবো?
এলিনর রডিকে শান্ত করার চেষ্টা করল। রডি জানতে চাইল মেরী কি করতে চায়? এলিনর জানাল ও ম্যাসাজ করার ট্রেনিং নেবে বলছে।
এলিনর রডিকে বলল, মেরীর সঙ্গে কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার আগে তার উচিত মাস কয়েকের জন্য কোথায় বেড়িয়ে আসা। তাহলেই সে বুঝতে পারবে প্রকৃতই মেরীকে যে ভালোবাসে না সেটা তার মোহ।
রডি এলিনরকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার পরামর্শ মেনে নিল।
.
১.৫.৪
কয়েকদিন পরে মেরী নার্স হপকিন্সকে তার সৌভাগ্যের কথা জানাতেই তিনি খুশী হয়ে বললেন এলিনর খুব ভালো মেয়ে আর মেরীর ভাগ্য সত্যিই ভালো। মেরী বলল, তার ধারণা এলিনর তাকে বিশেষ পছন্দ করে না।
নার্স হপকিন্স বললেন, সঙ্গত কারণ আছে তার। মিঃ রডরিক মনে হয় গভীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন। এবার বলো তো মেয়ে তোমার ব্যাপারটা কি? তুমিও কি ওঁকে মন-টন দিয়েছে নাকি?
মেরী একটু ইতস্ততঃ করে বলল, মানুষটি ভারী চমৎকার।
নার্স হপকিন্সকে মেরী জিজ্ঞেস করল তার বাবার ব্যাপারে সে কি করবে? তার থেকে সে কিছু তার বাবাকে দেবে কিনা।
নার্স হপকিন্স বললেন, না না, ওসব কিছু করতে যেও না। মিসেস ওয়েলম্যান নিশ্চয়ই তোমার বাবাকে ওই টাকাটা দিতে চাননি।
মিসেস ওয়েলম্যান কেন উইল করে যাননি। এই নিয়ে নার্স হপকিন্স আর মেরীর মধ্যে কথাবার্তা চলছিল। হঠাৎ নার্স হপকিন্স মেরীকে উইল করার প্রস্তাব দিলেন এবং পোস্ট অফিস থেকে ফর্ম এনে নার্সের কটেজে ওরা কথা বলছিল। মেরী তার মাসি মেরী রাইলির নামে উইল করবে বলে স্থির করল।
নার্স হপকিন্সের কথা মতো মেরী ফর্মে লিখল আমি আমার সব কিছু মেরী রাইলিকে দিয়ে যাচ্ছি, যিনি আমার মা, হান্টারবেরীর স্বর্গত এলিজা জেরার্ডের বোন। ফর্ম ভর্তি করে হঠাৎ মুখ তুললেই চমকে উঠল মেরী। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে এলিনর কার্লিসল তাকে প্রশ্ন করছে এত মন দিয়ে কি করছে মেরী?
নার্স হপকিন্স জানাল, মেরী তার উইল করছে। হপকিন্সের কথা শুনে এলিনর এক বিচিত্র হাসি হেসে উঠল এবং নার্স হপকিন্স অবাক হয়ে এলিনরকে দেখতে লাগলেন।
.
১.৫.৫
পাঁচ-ছ পা এগিয়েছে, হাসির ধমক তখনও থামেনি, কে যেন এলিনরের কাঁধে হাত রাখল। চমকে ফিরে তাকাতেই দেখল ডঃ লর্ড কপালে কুঞ্চন রেখা ফুটিয়ে বিরক্তভাবে ওর মুখের দিকে চেয়ে আছেন।
ডঃ লর্ড জিজ্ঞেস করলেন, কি দেখে হাসছিলেন এত? এলিনর জানাল মেরী জেরার্ডকে উইল করতে দেখে তার হাসি পেয়েছে কিন্তু কেন তা তার মাথায় আসছে না।
কড়া গলায় ডঃ লর্ড বললেন, পারছেন না, না? বিশ্বাস করুন, আমার দিক থেকে এটা খুবই খারাপ, মনে হয় খুব নার্ভাস লাগছে।
ডঃ লর্ড এলিনরকে জানাল, এলিনর কোন কথা গোপন করছে।
আমি কোন কিছুই গোপন করছি না, আর এর মধ্যেও আমি নেই।
ডঃ লর্ড শান্ত সুরে বললেন, আপনি আছেন এবং বড্ড বেশীভাবে ভাবছেন। এরপর লর্ড জিজ্ঞেস করলেন আপনি কি এখানে আরো কিছুদিন থাকছেন?
এলিনর জানাল, কালই সে চলে যাচ্ছে এবং ভালো দাম পেলে সে বাড়িটা বিক্রি করে দেবে।
তাচ্ছিল্যের সুরে লর্ড বললেন, তাই নাকি? হ্যাঁণ্ডশেক করার জন্য এলিনর হাত বাড়াতেই ডঃ লর্ড আবার একই প্রশ্ন করলেন। উত্তরে এলিনর একই জবাব দিল। মেরী জেরার্ডকে উইল করতে দেখে সে হাসি চাপতে পারেনি।
ড. লর্ড বললেন আপনি? আপনি উইল করেছেন কি? উত্তরে এলিনর বলল, না, তবে এবার গিয়েই মিঃ সেলডনকে বলব।
পিটার লর্ড বললেন, বলবেন।
.
১.৫.৬
লাইব্রেরী বসে মিঃ সেলডনকে চিঠি লিখল এলিনর :
প্রিয় মিঃ সেলডন,
আমার জন্য একটা উইলের খড়সা তৈরী করে রাখবেন, আমি গিয়ে সই করবো। খুব সাধারণ উইল। আমার যাবতীয় সম্পত্তি আমি রডারিক ওয়লেম্যানকে দিয়ে যেতে চাই।
আপনার একান্ত
এলিনর কার্লিসল
ওপরের ঘর থেকে ডাকটিকিট আনতে গিয়ে দেখল রডি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে। রডিকে প্রশ্ন করল এলিনর, এটা যদি বিক্রি হয়ে যায় তোমার কি কষ্ট হবে?
রডি জানালা বিক্রি করে দেওয়াই ভালো। চিঠিটা শেষবারের মতো পড়ে নিয়ে খামে ভরে মুখটা আঁটলো এলিনর। তারপর টিকিট লাগাল।
.
১.৬.১
নার্স হপকিন্সকে লেখা নার্স ও’ব্রায়ানের চিঠি :
১৪ই জুলাই
লাবোরা কোর্ট
প্রিয় হপকিন্স,
কয়েকদিন ধরেই লিখবো লিখবো করছি। বাড়িটা চমৎকার কিন্তু হান্টারবেরীর মতো নয়। আমার রোগীটি খুব শান্ত, ভদ্র। ডবল নিমোনিয়া হয়েছে, এখন ক্রাইসিস কেটে গেছে একটা কথা শুনলে বেশ মজা পাবেন। এ বাড়িতে ড্রয়িংরুমের পিয়ানোর ওপর রূপোর ফ্রেমে বাঁধানো একটা ফটো আছে যেটা অবিকল লিউইস সই করা ফটোটার মতো, সেটা মিসেস ওয়েলম্যান আলমারী থেকে বের করতে বলেছিলেন। বাড়ির পুরনো চাকরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম ফটোটা লেডী র্যাটেরীর দাদা স্যার লিউইস রাইক্রফটের। যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। চাকরের কাছ থেকে কথায় কথায় জানতে পারলাম বিয়ে করেছিলেন তবে লেডী রাইক্রফটকে পাগলা-গারদে বিয়ের অল্প পরেই যেতে হয়েছিল। এবং তিনি তখনও বেঁচে ছিলেন। আমরা কতো উল্টো-পাল্টা ভাবতাম, তাই না? মিসেস ওয়েলম্যান আর লিউইস বোধহয় পরস্পরকে ভালোবাসতেন, কিন্তু বউ পাগলা-গারদে ছিল বলে বিয়ে করতে পারেন নি। ভদ্রলোক মারা গিয়েছিলেন ১৯১৭ সালে। দারুণ রোমান্টিক ব্যাপার তাই না? এত বছর ধরে স্মৃতির মণিকোঠায় সযত্নে লালন করা, মরবার আগে ঐ ভাবে ফটোর দিকে তাকিয়ে থাক?
সব খবর দিয়ে চিঠি দেবেন।
ইতি
আইলিন ও’ব্রায়ান
নার্স ও’ব্রায়ানকে লেখা নার্স হপকিন্সের চিঠি :
১৪ই জুলাই
রোজ কটেজ
প্রিয় ও’ব্রায়ান,
এখানে সব কিছু আগের মতোই চলেছে। হান্টারবেরীর বাড়িতে বিক্রির নোটিশ ঝুলছে। মিসেস বিশপ খুবই বিচলিত। ওঁর বিশ্বাস ছিল মিস কার্লিসল মিঃ রডারিককে বিয়ে করে এই বাড়িতেই থেকে যাবে। এলিনর লণ্ডনে চলে গেছে। মেরী জেরার্ডকে দুহাজার পাউণ্ড দিয়ে গেছে। মেরীও ম্যাসাজ করা শিখতে গেলে লণ্ডনে। দু-একদিন আগে মিসেস স্ট্যালরীর সঙ্গে কথা হচ্ছিল (উনি ড. রনসমের বাড়ি দেখাশোনা করতেন, ড. লর্ডের আগে এখানকার ডাক্তার ছিলেন ড. রনসম) লিউইসের নাম করতেই বললেন তিনি ফরবেস পার্কে থাকতেন এবং উনি যুদ্ধে মারা যান। মিসেস ওয়েলম্যানের সঙ্গে তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। ওঁরা বিয়ে করতে পারেনি তার কারণ রাইক্রফটের স্ত্রী ছিলেন পাগলা-গারদে। ডির্ভোস কত সহজেই পাওয়া যায় সুতরাং পাগলামীর কারণে ডিভোর্স না পাবার কোন কারণ ছিল না।
টেড বিগল্যাণ্ড বলে ছোকরা মেরীর লণ্ডনের ঠিকানা নিতে এসেছিল। সি. আর. ডবলু মেরীর দিকে একটু বেশীই ঝুঁকেছেন। শুনেছি মনে খুব দুঃখ নিয়ে এলিনর চলে গেছে। এলিনর এত সম্পত্তি পেল। তারপর তাদের মধ্যে বিয়ের সম্পর্ক ইতি ঘটল। ব্যাপারটা আমার কাছে হেঁয়ালি।
বুড়ো জেরার্ডের শরীর খুব খারাপ। যদিও তার আচরণ একবারেই বদলায়নি। একদিন বলছিল, মেরী ওর মেয়ে নয়। বুড়োর বউ বিয়ের আগে মিসেস ওয়েলম্যানের খাস ঝি ছিল।
গত সপ্তাহে দি গুড আর্থ দেখলাম।
ইতি–
একান্ত আপনার
জেসী হপকিন্স
নার্স ও’ব্রায়ানকে লেখা নার্স হপকিন্সের পোস্টকার্ড :
মনে হচ্ছে দুজনেই দুজনই এক সঙ্গে চিঠি লিখছি। আবহাওয়াটা খুবই খারাপ।
নার্স হপকিন্সকে লেখা নার্স ও’ব্রায়ানের পোস্টকার্ড :
আজ সকালে চিঠিটা পেলাম। একেবারে কাকতালীয় ব্যাপার।
এলিনর কার্লিসলকে লেখা রডারিক ওয়েলম্যানের চিঠি :
১৫ই জুলাই
প্রিয় এলিনর,
এইমাত্র তোমার চিঠি পেলাম। না, ইন্টারবেরী বিক্রি করার ব্যাপারে আমার কোন মতামত নেই। এখানে বেশ ভালো গরম পড়েছে। তুমি ছাড়া আর সব মানুষকেই আমার কেমন যেন লাগে। দু-এক সপ্তাহের মধ্যে ডালমেশিয়ান উপকূলে যাব ঠিক করেছি। ২২ তারিখ থেকে আমার ঠিকানা হবে কেয়ার অফ টমাসকুক, বোভনিক। আমার তরফ থেকে যে কোন রকম সহযোগিতার প্রয়োজন বোধ করলে লিখতে কুণ্ঠা করো না। শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি।
-রডি।
মিস এলিনর কার্লিসলকে লেখা মেসার্স সেলডন, ব্রোদারউইক এণ্ড সেলডন কোম্পানীর মিঃ সেলডনের চিঠি :
১০৪, ব্রুস বেরী স্কোয়ার,
২০শে, জুলাই
প্রিয় মিস কার্লিসল,
হান্টারবেরীর জন্য মেজর সামারভিলের বারো হাজার পাঁচশো পাউণ্ড অফার আমার মতে যথেষ্ট ভালো। আজকাল বিশাল বাড়ি বিক্রি করা বেশ কষ্টসাধ্য। অতএব ওর প্রস্তাবটা মেনে নিতে পরামর্শ দিচ্ছি।
মেজর সামারভিল তিন মাসে জন্যে এখুনি নিতে চাইছেন, তার মধ্যে আইনের কাগজপত্র –লেনদেন সব পুরো হয়ে যাবে।
ড. লর্ড বলেছেন বুড়া জেরার্ড বোধহয় আর বেশীদিন বাঁচবে না। প্রবেট যদিও পাওয়া যায়নি তবে মিস মেরী জেরার্ডকে ১০০ পাউন্ড অগ্রিম দিয়ে দিয়েছেন।
ইতি
আপনার বিশ্বস্ত
এডমণ্ড সেলডন
মিস এলিনর কার্লিসলকে লেখা ড. লর্ডের চিঠি :
২৫শে জুলাই
প্রিয় মিস কার্লিসল,
বুড়ো জেরার্ড আজ মারা গেছে। এ ব্যাপারে আপনাকে কোনভাবে সাহায্য করতে পারি কি? আপনার বিশ্বস্ত
লিটার লর্ড
মেরী জেরার্ডকে লেখা এলিনর কার্লিসলের চিঠি :
২৫শে জুলাই
প্রিয় মেরী,
তোমার বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অত্যন্ত দুঃখিত। মেজর সামারভিল বলে এক ভদ্রলোক হান্টারবেরীর বাড়িটা কিনতে চাইছেন। ওখান থেকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তোমার বাবার জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা কি তোমার পক্ষে সম্ভব হবে? আশা করি তুমি ভালো আছ।
—এলিনর কার্লির্সল নার্স
হপকিন্সকে লেখা মেরী জেরার্ডের চিঠি :
২৫শে জুলাই
প্রিয় নার্স হপকিন্স,
বাবা সম্বন্ধে যা লিখছেন তার জন্য ধন্যবাদ। শেষকৃত্যের জন্য গেলে আপনার ওখানে কয়েকদিন থাকা সম্ভব হবে কি? যদি হয়, তবে উত্তর দেবার দরকার নেই।
আপনার স্নেহের
মেরী জেরার্ড
.
১.৭.১
২৮শে জুলাই বৃহস্পতিবার সকালে কিংস আর্ম, হোটেল থেকে বেরিয়ে মেডেনস ফোর্ডের বড় রাস্তায় এসে এলিনর দেখতে পেল মিসেস বিশপকে।
এলিনর জানাল, মেজর সামারভিলকে বাড়িটা সে বিক্রি করেছে। মিসেস বিশপ বললেন, হান্টারবেরী অন্য লোকের হাতে চলে যাচ্ছে সেটা ভাবতেও খারাপ লাগে।
এলিনর বলল, সেটা ঠিক। কিন্তু এত বড়ো বাড়িতে একলা থাকা সম্ভব নয়। এরপর মিস এলিনর হান্টারবেরীর বাড়ির কোন পছন্দসই ফার্নিচার তাঁকে নিতে বলল। খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে মিসেস বিশপ ড্রইংরুমের দেরাজ লাগানো লেখার বড় টেবিলটা এলিনরের কাছ থেকে চেয়ে নিলেন।
এরপর এলিনর তাকে টেবিলটার সঙ্গে ম্যাচিং করা কিছু চেয়ার নিতে অনুরোধ করলেন, এবং দারুণ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মিসেস বিশপ ওগুলো নিতে সম্মত হলেন।
মিসেস বিশপ এলিনরকে জানাল মেরীর বাবাকে গতকাল কবর দেওয়া হয়েছে। মেরী এখন নার্স হপকিন্সের বাড়িতে উঠেছে। হান্টারবেরীতে মালপত্র সরাতে আজ সকালেই তারা যাবে।
এলিনর মিসেস বিশপের সঙ্গে হ্যাঁণ্ডশেক করে এগিয়ে গেল দোকানের দিকে।
.
১.৭.২
হান্টারবেরীর বাড়ির পিছনের দরজা দিয়ে এলিনর কার্লিসল ঢুকলো। বাগানে এক সারি সুইট পী ফুলের পাশ দিয়ে হাঁটতেই ছোটমালী হরলিক সেলাম জানাল এবং চিঠি পেয়েছে জানাল।
এলিনর এগিয়ে যেতেই মালী তাকে ডেকে বলল, আপনি যদি দয়া করে মেজর সামারভিলকে একটু বলে দেন, ওঁরও তো মালীর দরকার হবে?
এলিনর জানাল সে আগেই একথা ভেবে রেখেছিল। এলিনর চিন্তা করতে লাগল রডি আর ও হান্টারবেরীকে ভালোবাসত। ছোটবেলায় তারা অনেকবার হান্টারবেরীতে এসেছে। মনের কোণে একটা প্রচ্ছন্ন বাসনা বাসাও বেঁধেছিল, ভবিষ্যতে কোনদিন এখানে ও থাকবে। মালির ছোট ছোট কথাবার্তা থেকেও সেরকম একটা ধারণা মনের গড়ে উঠেছিল। রডিও হয়তো দুজনে একসাথে এখানে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখত।
আজ এই মুহূর্তে রডি আর ও এই বাড়িতে থাকত। বাড়ির মালিকের অহংকার নিয়ে বাগানে, বারান্দায় গর্ব ভরে ঘুরে বেড়াতে পারত। সুখের সংসার হত কিন্তু কোত্থেকে বুনো গোলাপের সৌন্দৰ্য্য নিয়ে একটা মেয়ে ওদের সুখের আকাশে ধূমকেতুর মতো উদয় হল।
এলিনর মনে মনে ভাবতে লাগল, মেরী জেরার্ডের কতটুকু জানে রডি? কি দেখল ওর মধ্যে রডি? মেরী জেরার্ড যদি মরে যায়, তাহলে কি রডি একদিন স্বীকার করবে ভালোই হয়েছে, আমাদের মধ্যে কোন মিল ছিল না……হয়তো বিষাদের সুরে বলবে।
খুব মিষ্টি ছিল মেয়েটা..তাই হোক ওর কাছে, সুখের স্মৃতি হয়ে থাকে…সৌন্দর্য সব সয়মই সুখকর।
..মেরীর যদি কিছু হয় তবে রডি নিশ্চয়ই তার কাছে ফিরে আসবে। রডি তারই হবে। এ বিয়ের কোন সন্দেহ নেই।
বাড়িতে ঢুকে এলিনরের মনে হল কে যেন বাড়ির মধ্যে ওঁৎ পেতে বসে আছে ওর জন্যে…। ভাড়ার ঘরে রুটি, মাখন, মাছের কৌটো আর দুধের বোতল নামিয়ে রেখে এলিনর দোতলায় গেল মিসেস ওয়েলম্যানের ঘরে। বড়ো আলমারীর ড্রয়ারটা খুলে কাগজপত্র, জামা কাপড় আলাদা আলাদা করে সাজিয়ে রাখতে লাগল।
.
১.৭.৩
আউটহাউসে মেরী জের!র্ড খুব অসহায়ভাবে তাকাচ্ছিল চারপাশে। তার মনে পড়ে গেল অতীতের কিছু স্মৃতি।
এটা সেটা কথার পর নার্স হপকিন্স কাজের কথায় এলেন। ফার্ণিচারগুলো সব খুঁটিয়ে দেখে কতগুলো রাখতে আর কতকগুলো বেছে নিতে বললেন এবং একটা লিস্টও তৈরী করলেন।
মেরী জানাল, উকিলবাবু তাকে আগাম কিছু টাকা দিয়েছেন যা দিয়ে সে ট্রেনিং ফি এবং অন্যান্য খরচ চালিয়েছে। পুরো টাকাটা পেতে মাস খানেক লাগবে।
বুড়ো জেরার্ডের কাপড় জামা গোছানোর পর ওরা কাগজপত্র ভরা একটি টিনের বাক্সের মধ্যে জেরার্ডের জমিয়ে রাখা কিছু খবরের কাগজের কাটিং, পুরানো চিঠি ইত্যাদি পেল।
একটা কাগজ খুলে মেরী বলল, এই যে মা-বাবার বিয়ের সার্টিফিকেট, সেন্ট অ্যালবান গির্জা, ১৯১৯ সাল।
হঠাৎ মেরীর গলার স্বর কঠোর হল। কাঁপাকাঁপা গলায় বললো, ১৯১৯ সালে আমি এক বছরের ছিলাম। এটা তো ১৯৩৯ সাল। এখন আমার বয়েস একুশ। ১৯১৯ সালে আমি এক বছরের ছিলাম। তার মানে..যখন আমি হয়েছি তখন আমার মা বাবার বিয়ে হয়নি।
নার্স হপকিন্স বললেন, অনেক স্বামী-স্ত্রী আছে, তাদের যখন চার্চে যাবার কথা তার বেশ কিছু পরে যায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গেলে সবটাই ঠিক হয়ে যায়।
আর ঠিক এই কারণেই কি বাবা আমাকে ভালোবাসতেন না? কারণ আমার মা ওঁকে বিয়ে করতে বাধ্য করেছিলেন।
নার্স হপকিন্স একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, সত্যি কথাটা তাহলে আমাকে বলতে হয়, তুমি জেরার্ডের মেয়েই নও।
মেরীর গাল লাল হয়ে উঠল, কিন্তু আপনি সেটা জানলেন কি করে?
নার্স হপকিন্স বললেন, মারা যাবার আগে জেরার্ড অনেক কথা বলেছিলেন।
ভেবে পাচ্ছি না তাহলে আমার আসল বাবা কে?
মুখ খুলতে গিয়ে মনঃস্থির করতে না পেরে নার্স হপকিন্স মুখ বন্ধ করলেন। ঘরে একটা ছায়া দেখে দুজনেই মুখ তুলে দেখল জানালার কাছে দাঁড়িয়ে এলিনর।
প্রাথমিক সম্ভাষণের পর এলিনর জানাল যে তাদের জন্য খাবার এনেছে এবং খাবার জন্য তিনজন এলিনরের বাড়ির দিকে এগোল। খালি বাড়ির শীতল ছায়ায় পা দিয়েই কেঁপে উঠল মেরী। এলিনর জানাল, সকালবেলা তারও ঠিক একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
খাওয়া-দাওয়ার পর নার্স হপকিন্স পাশের ঘরে গেলেন চা করতে আর এলিনর মেরীর সঙ্গে জোর করে কিছু কথা বলার চেষ্টা করছিল। মেরীর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল এলিনর। অপ্রস্তুত হয়ে মেরী বলল, কিছু হলো কি? আপনি এমনভাবে তাকাচ্ছিলেন।
এলিনর জানাল কোন চিন্তা গভীরভাবে আমাকে পেয়ে বসলে এমনভাবে তাকাই মাঝে মাঝে, এলিনর স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল। ছোটবেলায় চা তৈরী করার খেলাটা মেরীও খেলত কিনা জানতে চাইল।
এলিনর বলল, ছোটোবেলায় ফিরে যেতে আমার খুব ভালো লাগে। তোমার লাগে না মেরী? মেরী বলল, মিস এলিনর, আপনার উচিত নয় একথা ভাবা।
এলিনরের গলায় ইস্পাতের ধার, কি ভাবা উচিত নয় আমার?
মেরী ভয়ে বলল, কি বলছিলাম…ভুলে গেছি আমি।
নার্স হপকিন্স চা আনতে পরিস্থিতিটা সহজ হল।
এলিনর মেরীকে কিছু বলতে গিয়েও বলল না।
চা খাওয়া শেষ হল। এলিনর ট্রে হাতে বেরিয়ে যেতে যেতে দেখল জানালার ধারে দাঁড়িয়ে মেরী জেরার্ড, তরুণী, সুন্দরী, প্রাণবন্ত…।
.
১.৭.৪
নার্স হপকিন্স ও এলিনরের কথা হচ্ছিল ভাঁড়ার ঘরে। জামার হাতদুটো গুটিয়ে বাসনপত্র ধোয়ার জন্য এগিয়ে এলেন নার্স হপকিন্স আর হঠাৎ তার কব্জির কাছে রক্ত দেখে এলিনর বলল, কিসের খোঁচা লাগল?
নার্স হপকিন্স হেসে বললেন, আউটহাউসের পিছন দিকে গোলাপের বাগানের কাঁটা ফুটে গেছে।
অতীতের স্মৃতির ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল এলিনরের হৃদয়তটে। ও আর রডি ঐ বাগানে ঝগড়া করত, লড়াই করত, আবার মিলও হত। হাসি, আনন্দে ভরা সুখের সেসব দিনগুলো তার মনে পড়ল, আর হঠাৎই একটা বেদনার শীতল হোত ওর সারা দেহ মনের ওপর দিয়ে বয়ে গেল–সেসব দিন..আর এখন? আমি পাগল হয়ে গেছি…একেবারে বদ্ধ পাগল।
নার্স হপকিন্স পরে বলেছিলেন, একেবারে অদ্ভুত ব্যাপার…মনে হচ্ছিল…নিজে নিজেই কথা বলছিলেন এলিনর। চোখগুলো কেমন যেন গোল হয়ে উঠেছিল।
লরা মাসির জিনিসপত্রগুলো গ্রামে কোথায় দিলে কাজে লাগবে জানতে চাইল এলিনর। তারপর দুজনে মিলে ঘরটা পরিষ্কার করে দোতলায় গেল।
সেখানে মিসেস ওয়েলম্যানের দামী দামী কাপড়জামা সব গুছিয়ে রাখল আর তারপরই নার্স হপকিন্সের হঠাৎ মনে পড়ল মেরীর কথা।
এলিনর বলল, ওকে চা খাবার ঘরে বসিয়ে রেখে তারা চলে এসেছে প্রায় ঘন্টাখানেক হল। খাবারের ঘরে এসে দেখল মেরী একটা বড় আরাম চেয়ারে গা এলিয়ে শুয়ে আছে, জোরে জোরে অদ্ভুতভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল।
নার্স হপকিন্স হঠাৎ-ই হাঁটু মুড়ে মেরীর পাশে বসে পড়ে মুখের কাছে মুখ নিয়ে কি শুকলেন আর চোখের পাতা টেনে দেখলেন তারপর ড. লর্ডকে ফোন করার কথা বললেন।
কি ব্যাপারটা কি? এলিনর, ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করল! নার্স হপকিন্স জানালেন মেরীকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে চোখে সন্দেহের ছায়া নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন এলিনরের দিকে।
২. পিটার লর্ড
২.১.১
পিটার লর্ড এরকুল পোয়ারোকে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। পৃথিবীতে আপনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন।
আপনার কেসটা কি? শান্ত গলায় জানতে চাইলেন পোয়ারো।
একজন কম বয়েসী মহিলা আছেন। তাকে খুন করার চার্জে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি চাই আপনি সাক্ষ্য প্রমাণ খুঁজে বের করুন, যাতে মহিলা নির্দোষ প্রমাণিত হন।
তাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কের কথা তুলতেই ড. লর্ড বললেন, আমি মহিলাকে একতরফাভাবে ভালোবেসেছি বলতে পারেন, আমি চাই না ওঁর ফাঁসি হোক।
মহিলার বিরুদ্ধে অভিযোগ কি?
মেরী জেরার্ড নামে একটি মেয়েকে মরফিন হাউড্রোক্লোরাইড বিষ দিয়ে খুন করার অপরাধ উদ্দেশ্যটা কি?
ঈর্ষা, সংক্ষেপে উত্তর দিলেন ড. লর্ড।
পোয়ারো বললেন, সত্য ঘটনা খুঁজে বের করতে গিয়ে যদি ঘটনাটি মহিলার বিপক্ষে যায়। তবুও কি আপনি চাইবেন…
ড. লর্ডের মুখ মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বললেন, ওর বিরুদ্ধে এ যাবত যে সব প্রমাণ পাওয়া গেছে সেটাই ওকে বুঝিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। তবে ওকে বাঁচাবার মতো কিছু করতে পারেন তাই দেখুন।
ড. লর্ড জানালেন মহিলার উকিল ধরে নিয়েছেন মহিলা অপরাধী। আর সেইজন্যই বোধহয় কিংস কাউন্সেল বামারকে লাগিয়েছে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হবে বলে মনে হয় না।
পোয়ারো সব ব্যাপারটা আগাগোড়া জানতে চাইলেন। ড. লর্ড সংক্ষেপে পোয়ারোকে ঘটনাটা জানালেন। এলিনর কার্লির্সল তার মাসির বাড়ি হান্টারবেরী হলের মালিক হয়েছে সম্প্রতি বাড়িটা সে বিক্রি করে দেয় সামারভিল নামের এম.পিকে। মাসির ব্যক্তিগত সম্পত্তি সরিয়ে নিতে সে এসেছে ২৭শে জুলাই সকালে। মেরী জেরার্ড এসেছে আউট হাউস থেকে তার সদ্যমৃত বাবার জিনিসপত্র সরাতে সেই একই দিনে। এলিনর কার্লিসল একটা স্থানীয় হোটেলে উঠেছিল। মুদির দোকানে মাছের পেস্ট কেনার সমর দোকানদারের সঙ্গে ফুড পয়জনিং নিয়ে তার কথা হয়। তারপর ঐ বাড়িতেই দুপুর একটার সময় এলিনর মেরী আর নার্স হপকিন্সকে স্যাণ্ডউইচ খেতে ডাকেন এবং ঘণ্টাখানেক পরে যখন আমায় ডেকে পাঠানো হয় তখন মেরী জেরার্ড অজ্ঞান। পোস্ট মর্টেমে দেখা যায় মারা যাবার বেশ কিছুক্ষণ আগে মেরী যথেষ্ট পরিমাণে মরফিন খেয়েছিল। আর পুলিশ। আর পুলিশ মরফিয়া হাইড্রোক্লোরার লেবেলের ছেঁড়া টুকরো পায় যেখানে এলিনর স্যাণ্ডউইচ তৈরি করছিল, সেখানে।
মেরী জেরার্ড আর কি খেয়েছিল?
চা। চা তৈরী করছিল ঐ নার্স। তবে মেরী নিজের হাতে চা ঢেলেছিল, সরকারী কৌসুলী অবশ্য বলতে পারেন–স্যাণ্ডউইচ তত তিনজনেই খেয়েছিল। অতএব শুধু একজনেরই পয়জনিং হলো কেন?
পোয়ারো বোঝাল, ধরুন স্যাণ্ডউইচগুলো থাক করে সাজানো হলো। তার মধ্যে একটাতেই বিষ মাখানো। প্লেট বাড়িয়ে দিলে হাতের সবচেয়ে কাছের খাবারটাই তুলে নিই আমরা, এলিনর কার্লিসল হয়তো মেরীর দিকেই প্রথম প্লেট এগিয়ে দিয়েছিল।
ড. লর্ড জানাল ঘটনাটা তাই হয়েছিল। পোয়ারো বলল, এমন কথা কি বলা যেতে পারে যে এলিনর কার্লিসল আশা করেছিল লোকে ধরে নেবে ফুড পয়জনিং-এর জন্যই মেয়েটি মারা গেছে?
ড. লর্ড বলল, মাছের দুটো পেস্ট ছিল। এমনও হতে পারে, একটা কৌটো ঠিক ছিল, মেরী যেটা খেয়েছে সেটাই বিষাক্ত ছিল।
পোয়ায়ো বললেন, মরফিনের লক্ষণগুলো ফুড পয়জনিংয়ের লক্ষণের সঙ্গে মেলে না অ্যাট্রোপিনের মেলে। ফুড পয়জনিং-এর উদ্দেশ্য থাকলে ঐ বিষ কেন ব্যবহার করবে?
পিটার লর্ড বললেন, জেলানার্সের ব্যাগ থেকে মরফিরেন একটা টিউব হারিয়ে গিয়েছিল, যে রাতে মিসেস ওয়েলম্যান মারা যান। তা প্রায় সপ্তাহখানেক আগে।
পোয়ারো বললেন, কিন্তু কিছু কথা আপনি চেপে যাচ্ছেন?
ড. লর্ড লজ্জা পেয়ে বলল, আমার মনে হয়েছিল মিসেস ওয়েলম্যান আত্মহত্যা করেছেন। কারণ উনি প্রায়ই মরার কথা বলতেন, এমনকি আমাকেও বলেছিলেন তাকে যত তাড়াতাড়ি পারি যেন মেরে ফেলি। উনি যাওয়ার পর নার্সকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে আমি ভালোভাবে ওঁকে পরীক্ষা করি। আমি নিশ্চিত ছিলাম, উনি আত্মহত্যা করেছেন।
পোয়ারো জানতে চাইলেন মিসেল ওয়েলম্যান কিভাবে মরফিন পেতে পারেন। লর্ড জানালনে, মিসেস ওয়েলম্যানের সঙ্গে নানা লোকের খাতির ছিল।
পিটার লর্ড পোয়ারোকে বললেন, মিসেস ওয়েলম্যান উইল করার জন্য বেশ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলেন এবং কথা হয়েছিল পরদিন সকালে এলিনর কার্লিসল সবার আগে ফোন করবে উকিলকে। লর্ড আরো জানলেন যে এলিনর জানতই না যে ওঁর মাসি কোন উইল করেননি।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন অ্যাটাচিকেস থেকে মরফিন সরানো কার্লিসলের পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা। উত্তরে লর্ড জানাল যে কোন লোকের পক্ষেই কাজটা সম্ভব ছিল-রডারিক ওয়েলম্যান, মার্স ও’ব্রায়ান, যে কোন চাকর।
মঁসিয়ে পোয়ারো ড. লর্ডকেও সন্দেহের বাইরে রাখলেন না।
পিটার লর্ড বললেন, পোয়ারো তার উপর বিশ্বাস রাখতে পারেন।
এরকুল পোয়ারো বললেন, সরকার যদি মিসেস ওয়েলম্যানের পেটে মরফিন পায়?
গম্ভীর গলায় ড. লর্ড বললেন, তাহলে এলিনর যদি এই অভিযোগ থেকে মুক্তি পায় তবে আবার তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। এবং মাসিকে খুন করার চার্জে তার বিচার হবে।
পোয়ারো বললেন, মিসেস ওয়েলম্যানকে খুন করা হয়েছে লাভের জন্য। মেরী জেরার্ডকে ঈর্ষার জন্য। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাহলে আত্মপক্ষ সমর্থনে কোন্ লাইন আপনারা নেবেন?
ড. লর্ড বললেন, তাঁদের বক্তব্য হবে এই খুনের পিছনে কোনো উদ্দেশ্য বা অভিসন্ধি নেই। বুড়িকে খুশী করার জন্য এলিনর ও রডারিকের সম্পর্কটা ওরা দেখাতো, রডারিক এ ব্যাপারে সাক্ষী দেবে কারণ সে একথাটা বিশ্বাস করে।
পোয়ারো বললেন, যদি এলিনর রডারিককে ততটা নাই ভালোবাসতো তাহলে মেরী জেরার্ডকে খুন করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে কে খুন করতে পারে মেরীকে?
মেরী নিজেই আত্মহত্যা করেছে পোয়ারোর এই কথাগুলো ড. লর্ডের ভালো লাগল না। পোয়ারা জিজ্ঞেস করলেন রডারিক মেরীকে ভালোবাসত কি না? বা ড. লর্ডের মেরীর প্রতি কোন দুর্বলতা ছিল কিনা। ড. লর্ড জানালেন মেরীর প্রতি তার কোন দুর্বলতা কোনকালেই ছিল না।
এলিনর আর রডারিকের মধ্যে সম্পর্কটা কি ধরনের ছিল তার উত্তরে পিটার বিরক্তির সুরে বললেন, ভালোবাসাতো তবে রাহুর ভালোবাসা।
তাহলে কিন্তু একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ড. লর্ড রেগে বললেন, ধরুন করেছে? আমি পরোয়া করি না।
পোয়ারো বললেন, প্রেম মানুষকে মরিয়া করে তোলে। হয়তো এলিনর বাধ্য হয়ে খুনটা করেছে। কিন্তু খুন করাটাকে আমি সমর্থন করি না।
এরপর এরকুল পোয়ারো ড. লর্ডের কথা মতোই কাজ করতে রাজী হলেন।
.
২.২.১
বেশ নার্ভাস হয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে ড. লর্ড বললেন, আরে আপনি তো আমাকে দারুণ ল্যাজে খেলাচ্ছেন। যাই হোক…।
পোয়ারো বললেন, এলিনর কার্লিসলের বিরুদ্ধে মামলা কিভাবে দাঁড় করানো যেতে পারে তাই দেখছিলাম। মেরী জেরার্ডকে স্যাণ্ডউইচের সঙ্গে মরফিন দেওয়া হয়েছে। এলিনর ছাড়া আর কেউ স্যাণ্ডউইচে হাত দেয়নি আর মেরীকে খুন করার একটা উদ্দেশ্যও আছে এলিনরের। আবার অন্য কেউও মেরীকে খুন করতে পারে বা মেরী আত্মহত্যা করতে পারে। এলিনর ছাড়া মেরীর মৃত্যুতে কে লাভবান হতে পারে? ওর কি কোনো টাকা পয়সা ছিল?
ড. লর্ড জানালেন এখন নেই। তবে আগামী মাসের মধ্যে ওর দু-হাজার পাউণ্ড পাবার কথা ছিল।
মাসিয়ে পোয়ারো নিশ্চিত হলেন যে টাকার জন্য কেউ মেরীকে হত্যা করতে পারে না। প্রশ্ন করলেন ওর অনুরাগীদের বিষয়।
ড. লর্ড তার সঠিক জবাব দিতে পারলেন না। তবে নার্স হপকিন্স এ ব্যাপারে জানতে পারেন বলে জানালেন।
এরপর এরকুল পোয়ারো নার্স দুজন সম্বন্ধে জেনে নিলেন ড. লর্ডের কাছ থেকে।
এরপর মেরী জার্মানীতে কারুর সাথে গণ্ডগোল পাকিয়ে আসতে পারে বলে জানালেন পোয়ারো। তবে সে মেরীকে অনুসরণ করে এখানে এসেছে এবং পেয়ে সে মেরীকে হত্যা করেছে–এটা খুব সম্ভব নয় বলেই বললেন পোয়ারো।
পোয়ারো আর একটি সম্ভাবনার কথা বললেন, ধরা যাক জুন মাসের ঐ রাতে কাউকে মরফিনের শিশি বের করতে দেখেছিস মেরী, তাই তাকে সরিয়ে ফেলা হল।
তাহলে তো সে কথা মেরী বলত?
মঁসিয়ে পোয়োরো বললেন, যে মিসেস ওয়েলম্যানকে খুন করছে সে মেরীকে দেখে ফেলে তাকে সরিয়ে ফেলেছে কিন্তু মেরী ব্যাপারটাকে কোন গুরুত্বই দেয়নি। ভেবেছে নার্স হপকিন্সের কথায় কেউ মরফিনের শিশিটা নিতে এসেছে। তাই মেরী কথাটা কাউকে কিছু বলেনি।
লর্ড বললেন, তাঁর ধারণা মিসেস ওয়েলম্যান কোনক্রমে ওটা সংগ্রহ করে উনি নিজের কাছে রেখেছিলেন। হতে পারে হপকিন্সের কাছে থেকে ওটা আগেই গিয়েছিল, উনি সেদিনমাত্র জেনেছিলেন।
কিন্তু পোয়ারো যেন কথাটা মানতে চাইলেন না।
ড. লর্ড বললেন, নার্সেরা কেউ ঘুষ খাবে না সুতরাং তাদের দিয়ে কাজটা হয়নি।
পোয়ারো বললেন, হয় বিরাট সম্পত্তি একা পাবার জন্য, কিম্বা মাসির দুঃখ লাঘব করার জন্য করুণাবশতঃ মাসির কথায় এলিনর কার্লিসল মরফিন চুরি করেছিল এবং মেরী সেটা দেখে ফেলে। আর তারপরই এলিনর কার্লিসল নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য মেরীকে সরিয়ে ফেলে। নানাভাবে ড. লর্ড এলিনরকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন। এলিনর যে একাজ করতে পারে না, তার যে টাকা পয়সার প্রতি লোভ নেই সেকথা মঁসিয়েকে বারবার বিশ্বাস করাতে চাইলেন।
এলিনর এই পৃথিবীতে সম্পূর্ণ একা জেনে পোয়ারো এলিনরের মৃত্যুতে কে সম্পত্তি পাবে জানতে চাইলেন এবং এলিনর কোন উইল করেছে কিনা তাও জানতে চাইলেন।
ড. লর্ড সংক্ষেপে বললেন, জানি না।
মঁসিয়ে পোয়ারো একটু চাপ দিতেই সম্পূর্ণ অনিচ্ছাসত্ত্বে ড. লর্ড বললেন, মেরীকে উইল করতে দেখে সজোরে হেসে উঠেছিল।
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পোয়ারো বললেন, তার মানে এলিনর জানতো মেরী আর বেশিদিন বাঁচবে না।
.
২.৩.১
ড. লর্ড নার্স হপকিন্সের কটেজে মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারোকে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
নার্স হপকিন্স পোয়ারোকে স্থির বিশ্বাসে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে এলিনরই মেরী জেরার্ডকে বিষ দিয়ে হত্যা করেছে। হপকিন্স বললেন, ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। আমাকে দোতলায় নিয়ে গিয়ে অকারণে কথায় কথায় আটকে রাখল, এদিকে মেরীর ঐ অবস্থা দেখে যখন ওর মুখের দিকে তাকালাম, দেখলাম এটা যে ঘটবে সেটা ও জানতো। অন্ততঃ ওর মুখ দেখে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
পোয়ারো বললেন, মেরী আত্মহত্যাও করতে পারে? নার্স হপকিন্স সে সম্ভবনা একেবারেই উড়িয়ে দিলেন।
পোয়ারো বললেন, মেরী আপনাদের নজর এড়িয়ে নিজের পাত্রে কিছু মিশিয়ে নিতে পারে। নার্স হপকিন্স বললেন, তা হলেও হতে পারে কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন না যে মেরী আত্মহত্যা করেত পারে।
এরপর পোয়ারো জানতে চাইলেন মেরীকে গ্রামের কেউ পছন্দ করত কিনা? নার্স হপকিন্স জানালেন টেড বিগল্যাণ্ড বলে একটি ছেলে মেরীকে ভালোবাসত। কিন্তু টেডকে তিনি বলেছিলেন যে, সে মেরীর উপযুক্ত নয়।
তাহলে বলা যায় মেরী ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছিল, তাই ক্ষেপে ছিল ও মেরীর ওপর।
নার্স হপকিন্স জানালেন টেড তার জন্য নার্সকেই অনেক কথা শুনিয়েছিল। কিন্তু মেরীর মতো সহজ সরল একটা মেয়েকে উনি বাজে পথে চলতে দিতে চাননি।
পোয়ারোকে নার্স হপকিন্স জানালেন মেরী বুড়ো জেরার্ডের মেয়ে নয়। মেরীর মা ছিলেন মিসেস ওয়েলম্যানের খাস ঝি। মেরী হবার পর ওর সঙ্গে জেরার্ডের বিয়ে হয়।
এবার পোয়ারো নার্স হপকিন্সকে জিজ্ঞাসা করলেন, মিঃ রডারিক-এর সঙ্গে মেরীর কি ধরনের সম্পর্ক ছিল।
নার্স হপকিন্স বললেন, মিঃ রডারিক মেরীকে পছন্দ করত কিন্তু মেরী তাকে পছন্দ করত না।
এবং ধরে নেওয়া যেতে পারে এই পছন্দ থেকে ভবিষ্যতে আরও অন্য কিছু জন্মাতে পারতো?
নার্স হপকিন্স জানালেন, মেরী রডারিককে বলেছিল যে, মিস এলিনরের সঙ্গে এনগেজমেন্ট যখন আছে তখন অমন কথা বলা উচিত নয়।
এবার পোয়ারো মিঃ রডরিকের সম্পর্কে হপকিন্সকে প্রশ্ন করতে লাগলেন। রডারিক ওয়েলম্যান সম্পর্ক তার ধারণা, রডারিক তার কাকীকে কতটা ভালোবাসত ইত্যাদি ইত্যাদি।
নার্স হপকিন্স জানালেন, মিসেস ওয়েলম্যান মারা যাবার আগের রাতে ওরা লণ্ডন থেকে এসেছিলেন এবং তাঁর বিশ্বাস রডারিক ওয়েলম্যান সে ঘরে ঢোকেননি।
পোয়ারো যাচাই করে নিতে চাইলেন যে, সত্যিই রডারিক মিসেস ওয়েলম্যানের ঘরে ঢুকেছিল কিনা?
অন্ততঃ আমি যতক্ষণ ডিউটিতে ছিলাম, ততক্ষণ যাননি। ভোর তিনটের সময় আমার জায়গায় এসেছিলেন নার্স ও’ব্রায়ান, উনি ওকে ডেকে আনতে পারেন, তবে সে কথা আমাকে বলা হয়নি।
আপনার অনুপস্থিতেও তো যেতে পারেন ঘরে? ধরুন জল গরম করতে বা কোন বিশেষ ওষুধ আনতে আপনি নীচে গিয়ে থাকতে পারেন?
নার্স হপকিন্স জানালেন বোতলে গরম জল ভরতে তিনি গিয়েছিলেন এবং মিনিট পাঁচেক পরেই তিনি ফিরে আসেন।
তবে ঠিক ঐ সময়রে মধ্যে মিঃ ওয়েলম্যান ভিতরে এসে কাকীকে দেখে থাকতে পারেন? যদি করে থাকেন বলতে হবে খুব তাড়াতাড়ি করেছেন।
.
২.৪.১
মিসেস বিশপ একটু রক্ষণশীল স্বভাবের। বিদেশী পোয়াবোর প্রতিটি কথাতেই উনি একটু সন্দিগ্ধ হয়ে উত্তর দিচ্ছিলেন। মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুর জন্য দুঃখপ্রকাশ করলেন। মিস কার্লিসলের গ্রেপ্তারের ব্যাপারটাকে অপমানজনক, নতুন পুলিশী ব্যবস্থায় পরিণতি প্রভৃতি আখ্যা দিলেন। মেরীর মৃত্যুর ব্যাপারে অস্পষ্ট কিছু উত্তর দিলেন।
পোয়ারো তাঁর শেষ তুরুপের তাসটা কাজে লাগালেন। স্ট্যাণ্ডিংহামের রাজপরিবারে তার যাতায়াত আছে যেন দুজনে বেশ ঘরোয়া হয়ে উঠলেন। নানা কথাবার্তার মধ্যে হঠাৎ পোয়ারো প্রশ্ন করে বসলেন, বিয়ের ব্যাপারে নানা ঝঞ্ঝাট…।
পোয়ারো সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ রডারিক আর এলিনয়ের বিয়ের এনগেজমেন্টটা ঐ বৃদ্ধাকে খুশী করার জন্য করা হয়েছিল কিনা?
মিসেস বিশপ জানালেন, মিস এলিনর আর মিঃ রডারিক দজনেই দুজনের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। তাদের এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে যাবার কারণ মেরী। মিসেস ওয়েলম্যানের অসুস্থতার সুযোগে মেরী তাকে কজা করে ফেলে, যখন তখন ফুল পাঠিয়ে, বই পড়ে শুনিয়ে। এরপর মেরী কিভাবে মিঃ রডারিককে ফাঁদে ফেলেছিল সেকথাও বললেন মিসেস বিশপ। এছাড়া টেড বিগল্যাণ্ড মেরীকে পছন্দ করত একথাও জানালেন মিসেস বিশপ। মেরী মিসেস ওয়েলম্যানের সম্পত্তি গ্রাস করার চেষ্টকরছিল বলে জানালেন তিনি। এবং মিস এলিনরকে ভদ্র মেয়ে বলেই চিহ্নিত করলেন।
নানা কথার পর পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, খুবই দুঃখের বিষয়, মারা যাবার আগে মিঃ রডারিক ওঁর কাকীমার সঙ্গে দেখা করলেন না।
মিসেস বিশপ জানালেন, তিনি মিঃ রডারিককে তার কাকীমার ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন।
এরপর পোয়ারো মেরী জেরার্ডের মৃত্যু সম্বন্ধে মিসেস বিশপের ধারাণা জানতে চাইলেন। তিনি জানালেন টিনের মাছ খেয়েই মেরীর মৃত্যু হয়। মরফিনের ব্যাপারে তিনি তেমন কিছু বলতে পারলেন না। মেরী আত্মহত্যা করে থাকতে পারে কিনা জিজ্ঞেস করাতে তীব্র প্রতিবাদ করে উঠলেন মিসেস বিশপ।
.
২.৫.১
পোয়ারো টেড বিগল্যাণ্ডকে পেল তার বাবার খামারে। টেড জানাল এলিনর কার্লিসলের মতো ভদ্র, নরম মনের মেয়ে মেরীকে খুন করতে পারে না। মেরীর মৃত্যুরহস্য উন্মোচনে টেড তাকে কোনোরকম সাহায্যই করতে পারল না।
মেরী সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন লোকের ভিন্ন ভিন্ন মত হঠাৎ পোয়ারের মনে পড়ে গেল। ড. লর্ড বলেছিলেন, চমৎকার মেয়ে। নার্স হপকিন্সের মন্তব্য। যে কোনদিন ও সিনেমায় নামতে পারতো। মিসেস বিশপের কথায় বড্ড দেমাকী চালচলন আর টেডের কথায় ফুলের মতো নিষ্পাপ।
টেডের বিশ্বাস মেরীর মৃত্যু একটা অ্যাক্সিডেন্ট। যেটা ঘটার নয়, অথচ ঘটে গেছে তাতে অ্যাক্সিডেন্ট ছাড়া আর কিই বা বলা যায়?
টেড জানাল মেরী বিদেশে যাওয়া ও সেখানে লেখাপড়া করার ফলে একটু পাল্টে গিয়েছিল। ও তার আগের জীবনটা ভুলে গিয়েছিল। টেড তার উপযুক্ত ছিল না। আবার মিঃ ওয়েলম্যানের মতো সত্যিকারের ভদ্রলোকের উপযুক্ত ছিল না মেরী।
মিঃ ওয়েলম্যানকে টেড পুরুষ হিসাবে গণ্যই করে না। এবং কথায় কথায় মিঃ ওয়েলম্যানের ওপর টেডের অসন্তোষ প্রকাশ হয়ে পড়ে।
টেড বিগল্যাণ্ড জানান রডি ওয়েলম্যান মেরীর আশেপাশে বড্ড বেশী ঘুরঘুর করতেন। মেডেনসফোর্ড সবাই মেরীকে ভালোবাসত। মিসেস ওয়েলম্যান মেরী না হলে চোখে অন্ধকার দেখতেন। কিন্তু মিসেস বিশপ মেরীকে পছন্দ করতেন না।
হঠাৎ পোয়ারো বললেন নার্স হপকিন্স এমন কথা কি চেপে যেতে পারেন যেটা মেরীকে সবার চোখে নামিয়ে দিতে পারে?
টেড জানাল মেরীকে তিনি ভালোবাসতেন, এক্ষেত্রে একমাত্র মেরীর কথাই উনি না। রটাতে পারেন।
টেড মাথা নাড়ল, নার্স হপকিন্স তেমন কিছু জানেন না।
.
২.৬.১
হাতের কার্ডের দিকে চোখ নামিয়ে রেখে বেশ ভয়ের সঙ্গেই রডি ওয়েলম্যান জানাল যে, ড. লর্ডের সঙ্গে তাদে কোন সম্পর্ক নেই একমাত্র চিকিৎসক হিসাবে ছাড়া। এসব কাজ তাদের উকিল মিঃ সেলডনেরই করা উচিত।
রডি ওয়েলম্যান জানাল, সেলডনের ওপর তার বিশেষ ভরসা নেই তাই বামারের মতো উকিলকে সে একাজের দায়িত্ব দিয়েছে।
পোয়ারে মিঃ বামারের স্তুতি গাইলেন।
পোয়ারো মিস এলিনরকে বাঁচাবার জন্য রডি ওয়েলম্যানের সাহায্য করলেন এবং পুরো ব্যাপারটা সম্বন্ধে রডি কি জানে তা জানতে চাইলেন।
রডি জানান এলিনর ছোটবেলা থেকেই বেশ শান্ত, সংযত বুদ্ধিমতী, কোমল স্বভাবের। এলিনরের পক্ষে কাজটা কিছুতেই সম্ভব নয়। আর নার্স ও কাজ করতেই পারে না বলে রডির ধারণা।
পোয়ারো বললেন, আমি সব খুঁটিয়ে খবর নিয়েছি। স্যাণ্ডউইচের ধারে-কাছে সে আসেনি। তাছাড়া চায়ে বিষ দিলে তাকে নিজেও মরতে হত।
মেরীর মৃত্যুতে রডির একটা দিক ভীষণ ফাঁকা হয়ে গেছে কিনা জানতে চাইলেন মিঃ পোয়ারো।
রডি জানাল ঘটনার সঙ্গে তার প্রশ্নের কোনো সম্পর্ক নেই।
এরকুল পোয়ারো বললেন, আপনি যদি ঠিক কথাটি আমায় বলতে পারেন পরিষ্কারভাবে দেখাতে পারেন, তবে ব্যাপারটার অবসান ঘটতে পারে।
রডি জানাল মেরীর প্রতি তার আবেগভরা ভালোবাসা তার নিজেরই মনে হয় পাগলামি। মেরী যখন মারা যায় আপনি তো ইংল্যাণ্ডের বাইরে? রডি জানাল ৯ই জুলাই গিয়ে সে ১লা আগষ্ট ফিরেছিল।
মিঃ ওয়েলম্যান মেরী জেরার্ড সম্বন্ধে আপনি কি এবং কতটুকু জানেন?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রডি বলল, মেরী ছিল মিষ্টি, শান্ত-ভদ্র, তবে চালাক নয়, স্পর্শকাতর। তার ভদ্রতাবোধ ওদের শ্রেণীর মেয়েদের মধ্যে আশা করা যায় না।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন যারা সহজেই শত্রুতার সৃষ্টি করে সেই ধরনের মেয়ে ছিল কিনা মেরী।
না না, আমি ভাবতেই পারি না কেউ ওকে অপছন্দ করতে পারে। ঈর্ষা অন্য জিনিস। ঈর্ষার ব্যাপার ছিল না কি?
নিশ্চয়ই ছিল…তা না হলে ঐ চিঠিটা আসে কি করে?
পোয়ারো বললেন, কিসের চিঠি?
রডি জানাল, একটা বেনামী চিঠি যেটা সে নিজের হাতে পুড়িয়ে ফেলেছে।
রডি জানাল কোন অস্বস্তি, দুঃশ্চিন্তা বা আশংকায় তারা হান্টারবেরীতে সেদিন ছুটে আসেনি। এসেছিল অসুস্থ কাকীমাকে দেখতে।
পোয়ারো বললেন, আপনারা যখন হান্টারবেরীতে গেলেন তখন পর্যন্ত আপনার কাকীমা কিন্তু কোন উইল করেননি। তার কিছু পরে আবার তার দ্বিতীয় অ্যাটাক হয়, তখন উইল করার ইচ্ছা হয়েছিল। অথচ মিস কার্লির্সলকে সুযোগ দিয়ে তিনি উইল করার আগের রাতেই মারা যান।
রডির রাগত মুখের দিকে তাকিয়ে পোয়ারো যা বললেন, তা হল ঐ চিঠি পড়ে এলিনর কার্লিসল আশংকা করে থাকতে পারে যে বাইরের কেউ তাকে তার প্রাপ্য সম্পত্তি উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে। আর মিসেস ওয়েলম্যান মারা যাবার আগের রাতে যা বলেছিলেন তা তার আশংকাকে দৃঢ় করে তোলে। এক তলায় হলঘরে একটা অ্যাটাচিকেসে নানা ধরনের ওষুধপত্র ছিল। সুতরাং মরফিনের শিশি জোগাড় করা এলিনরের পক্ষে মোটেই কঠিন ছিল না আবার রোগিণীর ঘরে তিনি একা বসেছিলেন যখন রডি নার্সদের সঙ্গে ডিনার করতে যায়।
রডি চেঁচিয়ে প্রতিবাদ জানাল মিঃ পোয়ারোর কথাগুলোর এবং আত্মবিশ্বাস নিয়ে জানাল কাকীমার মৃতদেহ কবর খুঁড়ে তুললেও কোন সাক্ষ্য পাওয়া যাবে না এলিনরের বিরুদ্ধে।
পোয়ারো বললেন, আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত নই। ঐ অবস্থায় মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশী লাভবান কে হত?
পোয়ারো জানালেই প্রকৃত ঘটনার সম্মুখীন তাঁদের হতেই হবে মিঃ ওয়েলম্যান যতই সত্য এড়াবার চেষ্টা করুন না কেন।
রডি অসহায়ের মতো জানতে চাইল নার্সদের সন্দেহের বাইরে কেন রাখছেন মিঃ পোয়ারো।
পোয়ারো জানালেন, নার্স হপকিন্স যদি অপরাধী হতেন তবে তিনি চেঁচামেচি করে মরফিনের শিশি হারানোর খবর জানিয়ে আর পাঁচজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন না। নার্স ও’ব্রায়ান সম্বন্ধেও একই কথা খাটে। কারণ মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুতে তার কোন স্বার্থ থাকতে পারে না।
রডি তার কথায় সম্মতি জানাতেই পোয়ারো বললেন, আপনিও কাজটা করতে পারেন। সে রাতে অল্পক্ষণের জন্য হলেও আপনি একবার ওঁর ঘরে গিয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু উনি বেঁচে থাকলে আপনি সেই সম্পত্তি কিছু পেতেন তাই এক্ষেত্রে আপনারও কোন দূরভিসন্ধি থাকতে পারে না। মাত্র দুজনের উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
রডির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, দুজন? হ্যাঁ একজন এলিনর, অপরজন ঐ বেনামী চিঠির লেখক।
পোয়ারো বললেন, কেউ না কেউ ঐ চিঠিটা লিখেছিল, যে চাইত না মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুতে মেরী জেরার্ড লাভবান হোক। কে হতে পারে বলুন তো?
রডি বলল, এলিনর আর তার ধারণা হয়েছিল ওটা কোন চাকর-বাকরের কাজ।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন আপনারা কি মিসেস বিশপকে সন্দেহ করেছিলেন?
রডি জানাল, উনি অত্যন্ত সম্মানিতা মহিলা, তাছাড়া ওর চিঠি দেখেছি, ভাষার দারুণ বাঁধুনি কিন্তু চিঠিটা ছিল ভুলে ভরা।
পোয়ারো রডিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মিসেস বিশপ মেরী জেরার্ডকে পছন্দ করতেন না মনে হয়।
কিন্তু আমি নিজে কিছু দেখিনি তেমন।
তবে এও তো হতে পারে, আপনি সব জিনিস খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেন না।
রডি ধীরে ধীরে বলল আপনি বলতে চাইছেন যে আমার কাকীমা নিজেই মরফিন খেয়েছেন? সেক্ষেত্রে নার্স দুজনের প্রতি ইঙ্গিত করল রডি।
পোয়ারো বললেন, না, নার্সরা নয়। এতে তাদের বিপদের কথা তারা জানে। নার্সদের সন্দেহ করা যায় না…
তাহলে কে…কে…? রডির প্রশ্ন।
শান্ত গলায় পোয়ারো বললেন, কিছু একটা কথা মনে পড়েছে আপনার, তাই না?
রডি জানাল টেলিগ্রাম পেয়ে ট্রেনে আসার সময় এলিনর বলেছিল, কেউ যদি এই অবস্থা থেকে নিজে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুক্তি চায় তবে তাকে মুক্তি দেওয়া উচিত। রডি জানাল, সে এলিনরের কথায় সায় দিয়েছিল।
একটু আগে, মিঃ ওয়েলম্যান, আপনি সম্পত্তির লোভে এলিনর যে তার মাসিকে খুন করতে পারে তার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাহলে দয়াপরবশ হয়ে মাসিকে মরতে সাহায্য করার দোষেও এলিনরকে দোষী সাব্যস্ত করার প্রশ্নটা উড়িয়ে দেবেন সরাসরি?
আমি..আমি…না, আমি বলতে পারি না…।
.
২.৭.১
মঁসিয়ে পোয়ারো মিঃ সেলডনকে জানালেন, ড. লর্ডের অনুরোধে তিনি মিঃ সেলডনের মক্কেলের স্বার্থের অনুকূলে কাজ করছেন।
মিঃ সেলডন জানালেন যে, ড. লর্ডকে সরকার পক্ষে সাক্ষী হিসাবে সমন দেওয়া হয়েছে। মিস কার্লিসলের মামলার দেখাশোনার ভার তার উপর, তাতে বাইরের কারুর সাহায্যর তাঁদের প্রয়োজন নেই।
পোয়ারো বললেন, তার কারণ কি এই যে, আপনার মক্কেলের কোন অপরাধ নেই তা সহজে প্রমাণ করতে পারবেন?
মিঃ সেলডন চটে গিয়ে বললেন, প্রশ্নটি অত্যন্ত অসঙ্গত।
মিঃ পোয়ারো জানালেন, যদিও ড. লর্ড তাঁকে একাজের দায়িত্ব দিয়েছেন তবে মিঃ ওয়েলম্যানও তাকে একটা চিঠি দিয়েছে। চিঠিটা তিনি দেখালেন মিঃ সেলডনকে।
মিঃ ওয়েলম্যানের লেখা কয়েক লাইনের চিঠিটাকে চোখ বুলিয়ে একটু উষ্ম প্রকাশ করলেন মিঃ সেলডন এবং জানালেন কিংস কাউন্সেল স্যার এডউইন বামারকে এ-কেসে নিযুক্ত করেছে।
পোয়ারো জানালেন, বাগ্মীতা বা হৃদয়াবেগের কাছে আবেদন জানালে কিন্তু আপনার মক্কেলকে বাঁচানো যাবে না, তার জন্য আরো কিছু দরকার।
নীরস গলায় মিঃ সেলডন জানতে চাইলেন কি? আপনি কি করতে বলেন?
আমি কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর চাই।
মিঃ সেলডন জানালেন, তাঁর মক্কেলের অনুমতি ছাড়া তিনি কোন প্রতিশ্রুতি দিতে পারবেন না।
মিস কার্লিসল কাকে উইল করেছেন একথা জানতে চাইলে মিঃ সেলডন আপত্তি জানালেন। আর মিঃ পোয়ারো মিস কার্লিসলের সঙ্গে দেখা করার সঙ্গত মনে করলেন।
.
২.৮.১
স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের চীফ ইনসপেক্টর মার্সডেন নিঃসন্দেহ যে এলিনর কার্লিসলই ঠাণ্ডা মাথায় স্যাণ্ডউইচের উপর মরফিন ছড়িয়ে মেরী জেরার্ডকে হত্যা করেছে এবং পোয়ারোকে সেকথা পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন।
.
২.৯.১
ড. লর্ড প্রশ্ন করলেন, এখনও কিছু ধরতে পারেননি না?
পোয়ারো ধীরে ধীরে বললেন, ঈষাবশতঃ এলিনর কালির্সল মেরী জেরার্ডকে খুন করেছে, সম্পত্তি পাবার লোভে এলিনর তার মাসিকে খুন করেছে, মাসির প্রতি করুণাপরবশ হয়ে এলিনর তার মাসিকে খুন করেছে–তিনটের মধ্যে যে কোন একটা বেছে নিতে পারেন আপনি।
ড. লর্ড রেগে বললেন কি বলতে চান আপনি? আপনি কি মনে করেন মাসির কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এলিনর তাকে সাহায্য করেছিল।
প্রশ্নটা শুনে রেগে উঠলেন ড. লর্ড। বাজে কথা।
কেন আপনি আমাকে বলেননি যে, মিসেস ওয়েলম্যান ঐ ধরনের কথা আপনাকে বলেছিলেন? ঐ চিন্তাটা ওঁর মাথায় ছিল। এলিনর তাঁকে সাহায্য করে থাকতে পারে?
ড. লর্ড জানালেন, এলিনর কার্লিসল ঠাণ্ডা মাথার মেয়ে, চিন্তাভাবনাও সুস্থ। সে এমন ঝুঁকির কাজ কখনোই করতে পারে না। ধরা পড়লে খুনের দায়ে পড়তে পারে তা সে জানে।
পোয়ারো চিন্তাগ্রস্তভাবে জানতে চাইলেন রডারিককে দিয়ে ঐ কাজ করানো সম্ভব।
তাচ্ছিল্যের সুরে ড. লর্ড জানালেন, সাহস তার নেই।
পোয়ারো বললেন, মি ওয়েলম্যান যেমন ধূর্ত, আবার লোককে মোহিত করার ক্ষমতাও তার আছে। পোয়ারো জানতে চাইলেন, এলিনরকে কি কেউ ঘৃণা করতো?
ড. লর্ড মাথা নাড়লেন।
আপনার কি ধারণা কেউ ওকে ওই অপরাধে জড়িয়েছে, মানে ওকে ফাঁদে ফেলে করিয়েছে? না।
এরপর পোয়ারো তাকে ঐ বেনামী চিঠির কথা বললেন, তাতে কেসটা আরো বিপক্ষে যাচ্ছে এলিনরের। সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে একথা ভেবে, তার উপর মাসির উইল করার কথা শুনে দেরী করতে চায়নি এলিনর।
রডারিক একাজ করতে পারে কিনা একথা জিজ্ঞেস করতে ড. লর্ড প্রতিবাদ করলেন, বিয়ে হলে ওর সম্পত্তি তো রডারিকই পেত।
পোয়ারো বললেন, তা ঠিক, কিন্তু এনগেজমেন্ট ভাঙার পরেই রডারিক নিজেকে আলাদা করে নিয়েছিল। কিন্তু কোথাও একটা কিছু আছে, ধাঁধার একটা জায়গায় জট আছে, সেটি খুললেই সব জানা যাবে। আর সেটা মেরী জেরার্ডকে কেন্দ্র করে। পোয়ারো হঠাৎই জানতে চাইলেন, আচ্ছা ওর বিরুদ্ধে কিছু শুনেছেন কি আপনি? তার অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে? তাকে নিয়ে কোন কেলেঙ্কারী, তার সততা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ, কোন বাজে গুজব, যাহোক কিছু একটা মানে, যাতে তার ক্ষতি হতে পারে?
ড. লর্ড ধীরে ধীরে বললেন, নিরীহ একটি মৃত যুবতী, সে সপক্ষে এখন কিছুই বলতে পারবে না, তার সম্বন্ধে ঐ ধরনের অভিযোগ খোঁজা কি ঠিক হবে?
তাহলে বলছেন অত্যন্ত নির্মল চরিত্রের মেয়ে ছিল মেরী জেরার্ড?
জোর দিয়ে ড. লর্ড জানালেন, হ্যাঁ।
শান্ত গলায় পোয়ারো বললেন, নার্স হপকিন্স সম্বন্ধে এমন কিছু জানেন যা বলতে ভয় পেয়েছেন। যদিও নার্সের ধারণা ঐ ব্যাপারটার সঙ্গে খুনের কোনো সম্পর্ক নেই, এলিনরই মেরীর হত্যাকারী। এমনও তো হতে পারে মেরী কোন এক তৃতীয় ব্যক্তির ক্ষতি করেছে, আর সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি মেরীর মৃত্যু চেয়েছিল।
ড. লর্ড জানালেন, বাপারটা এতো ঘোরালো হলে নার্স হপকিন্স নিশ্চয়ই বুঝতে পারতেন।
নার্স হপকিন্স বুদ্ধীমতী হলেও আমার সমান বুদ্ধি নিশ্চয়ই রাখেন না। অতএব তিনি যা বুঝতে পারেননি আমি পারতে পারি।
পোয়ারো জানালেই টেড বিগল্যাণ্ড যার জীবন মেরীর সঙ্গে এখানেই কেটেছে সেও জানে না, মিসেস বিশপও কিছু জানে না। একমাত্র আশা নার্স ও’ব্রায়ান।
ড. লর্ড জানালেন, মাত্র দুমাস হল তিনি বদলি হয়ে এসেছেন এখানে।ও ব্যাপারে তিনি বিশেষ কিছু জানেন না।
পোয়ারো বললেন, মেরীর কথাটা কথাচ্ছলে যদি নার্স হপকিন্স বলে থাকেন নার্স ও’ব্রায়ানকে তবে তার কিছু জানার কথা।
.
২.১০.১
চায়ের টেবিলের অন্যধারে বসে কপালের ওপর এসে পরা লাল চুলের গোছ ঝাঁকুনি দিয়ে পিছন দিকে সরিয়ে আবার পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন ছোটোখাটো লোকটিকে।
পোয়ারো বললেন, স্বাস্থ্য আর প্রাণশক্তিতে ভরপুর এমন কারুকে দেখলে মন খুব প্রসন্ন হয়। আমার স্থির বিশ্বাস আপনার রোগীরা ভালো হবেই হবে।
উত্তরে নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, তার হাতে কম রোগীই মারা গেছে।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, ঐ সময়ে আপনার মনে কোন সন্দেহ হয়নি?
নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, বিন্দুমাত্র না, তবে হওয়া উচিত ছিল। কারণ সেদিন সকালে ড. লর্ড অকারণে একবার একাজে–একবার অন্যকাজে সর্বত্র ছোটাছুটি করিয়েছিলেন, আর ঐ অবসরেই ডেথ সার্টিফিকেট লিখে ফেললেন।
পোয়ারো বললেন যে, মিসেস ওয়েলম্যান আত্মহত্যা করেছেন এমন কথা উঠেছে।
শুনে নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, যিনি কোনরকমে শুধু একটা হাত তুলতে পারতেন, বিছানা থেকে ওঠা তো দূরের কথা উনি কিভাবে আত্মহত্যা করবেন? আবার মিস কার্লির্সল, মিঃ ওয়েলম্যান বা মেরী জেরার্ড কারুর পক্ষেই একাজ করা অসম্ভব বলে জানালেন নার্স ও’ব্রায়ান।
পোয়ারো তার কথা মেনে নিয়ে বললেন, আচ্ছা নার্স হপকিন্সের মরফিনের শিশি কখন হারিয়েছিল?
ঠিক পরের দিন সকালে। উনি বললেন শিশিটা এখানে ছিল, তারপর ওঁর ধারণা হল মরফিন হয়তো বাড়িতে ফেলে এসেছেন।
পোয়ারো বললেন, কি আশ্চর্য তখনও আপনার সন্দেহ হয়নি?
নার্স ও’ব্রায়ান জানালেন, আমার মাথায় ওসব চিন্তা আসেনি। পুলিশরে ওটা নিছক সন্দেহ ছাড়া কিছুই নয়।
উত্তরটা মনঃপুত না হওয়াতে পোয়ারো বললেন, মরফিনের শিশি হারিয়ে গেছে, অথচ আপনাদের দুজনের মনে কোন সন্দেহই জাগল না?
ব্লু-টি কাফেতে বসে নার্স হপকিন্সের সঙ্গে তার যা কথা হয়েছিল, জানালেন নার্স ও’ব্রায়ান। পোয়ারো জানতে চাইলেন, এখন আপনার কি ধারণা?
যদি মেরীর পেটে মরফিন পাওয়া যায়, তবে আন্দাজ করা যাবে কে ওটা চুরি করেছিল বা কোন কাজে লাগানো হয়েছিল, তবে ওর শরীরে মরফিন না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই বিশ্বাস করবো না, তবে মেরী জেরার্ডকে যে এলিনর খুন করেছে সে বিষয়ে আপনার কোন সন্দেহ নেই?
নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, সে রাতেবৃদ্ধা কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন আর মি এলিনর তার সমস্ত ইচ্ছাপূরণের কথা দিয়েছিলেন, সে রাতে আমি যদি উপস্থিত না থাকতাম বা একদিন মেরী যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছিল আর কুটিল মুখে এলিন ওর দিকে তাকিয়েছিল, সে দৃশ্য যদি না দেখতাম তবে হয়ত অন্য কথা ভাবতাম।
পোয়ারো প্রশ্নের জবাবে নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, দুই লাখ পাউণ্ডের সম্পত্তির লোভেই এলিনর মেরীকে খুন করেছে।
নার্স জানাল, মিসেস ওয়েলমান উইল করে গেলে ওনার পাইপয়সা মেরীকেই দিয়ে যেতেন।
পোয়ারো বললেন, একথাও তো কেউ বলতে পারে যে, মেরী জেরার্ড কায়দা করে বুড়ীকে হাত করে নিয়েছিল, ফলে নিজের আত্মীয় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছিল।
ঘাড় নেড়ে নার্স ও’ব্রায়ান কথাটা স্বীকার করলেন।
পোয়ারোর প্রশ্ন, মেরী জেরার্ড কি খুব ধূর্ত, ফন্দিবাজ মেয়ে?
নার্স ও’ব্রায়ান জানালেন, মেরী মোটেই সেরকম মেয়ে ছিল না।
হঠাৎ এক অদ্ভুত মর্মভেদী স্বরে পোয়ারো বলে উঠলেন, আপনি আর নার্স হপকিন্স দুজনেই একটা কথা জনসমক্ষে উপস্থিত করবেন না এমন বোঝাপড়া করে নিয়েছেন, তাই না?
আপনার কথার অর্থ?
নার্স ও’ব্রায়ানের কণ্ঠস্বরে পোয়ারো তাড়াতাড়ি বললেন, না না, এই খুনের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই–সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।
নার্স ও’ব্রায়ান শান্তভাবে বললেন, পুরানো ময়লার গাদা খুঁচিয়ে লাভ কি বলুন? তাছাড়া উনি একজন বয়স্কা সম্মানিতা মহিলা, ওর সম্বন্ধে কোন কেচ্ছা নেই, মারাও গেছেন সম্মান নিয়ে।
আপনি বলছেন মিসেস ওয়েলম্যানকে মেডেনসফোর্ডে সবাই খুব সম্মান করতো।
নার্স ও’ব্রায়ান আপন মনে বলতে লাগলেন, বহুদিন আগে সব শেষ হয়ে গেছে, মানুষ ভুলেও গেছে। যার স্ত্রী পাগলা-গারদে সেই পুরুষের পক্ষে আমৃত্যু একা একা কাটানো বড়ো কঠিন।
আন্দাজে পোয়ারো বললেন, যা বলেছেন, বড় কঠিন।
নার্স ও’ব্রায়ান বললেন, নার্স হপকিন্স কি আপনাকে বলেছেন কিভাবে একই সঙ্গে আমার আর তাঁর চিঠি দুজনের কাছে পৌঁছেছিল। না বলে চললেন, এরকম কাকতালীয় ব্যাপার অনেক সময়ই ঘটে, আমি যখন পিয়ানোর ওপর রাখা একটা ফটো দেখছি, ঠিক সেই সময় ডাক্তারের বাড়ির ঝিয়ের কাছ থেকে ঐ ফটো সম্বন্ধেই গল্প শুনেছেন নার্স হপকিন্স।
খুবই মজার ব্যাপার, কিন্তু মেরী জেরার্ড কি কথাটা জানত?
নার্স জানালেন, নার্স হপকিন্স বা উনি কেউই তাকে একথা জানাননি।
.
২.১১.১
দুজনের মধ্যে একটি টেবিলের ব্যবধান, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ, ফর্সা চৌকো কপাল, নাক কানের গঠন বেশ কোমল, মুখের রেখাগুলো সুন্দর, অহংকারী, সংবেদনশীল, আত্মসংযমী, প্যাশন আছে–পোয়ারো কি যেন খুঁজছেন এলিনরের মুখে।
আমি এরকুল পোয়ারো, ডাক্তার লর্ড আমায় পাঠিয়েছেন। তার ধারণা আমি আপনার উপকারে লাগতে পারি।
আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন কি? নিরপরাধদের তুলে ধরাই আমার কাজ। এলিনর তার স্বচ্ছ নীল চোখের তারা দিয়ে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল পোয়ারোর দিকে, আপনি বিশ্বাস করুন আমি নিরপরাধ।
আপনার আত্মীয় মানে ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সুবিধার জন্য ভাই বলছি, মিঃ রডারিক ওয়েলম্যান। অহংকারের আবরণে নিস্পৃহ মুখে রক্তের কালিমার ছোপ লাগলো ধীরে ধীরে। বিনা প্রশ্নেই যা জানাবার ছিল পোয়ারোর তা জানা হয়ে গেল।
পোয়ারো জানালেন যে, রডারিক ওয়েলম্যান তার জন্য যথাসাধ্য করছেন। পোয়ারো আরো বললেন, আপনি শুনেছেন তো, পোস্টমর্টেম পরীক্ষায় আপনার মাসি যে মরফিন ক্রিয়ায় মারা গেছেন তা জানা গেছে।
হিমশীতল গলায় এলিনর কার্লিসল বলল, আমি ওঁকে খুন করিনি।
এলিনর তার সম্পত্তি কাকে দিয়ে গেছেন জানতে চাইলেন পোয়ারো।
শান্তভাবে এলিনর উত্তর দিল, আমি সব কিছু রডিক..রডারিক ওয়েলম্যানকে দিয়ে গেছি।
সে সম্পর্কে রডারিক কিছু জানে কিনা প্রশ্ন করলে এলিনর জানাল, না।
আপনার উইলের মূল বক্তব্য আর কে জানে?
শুধু মিঃ সেলডন…আর তার কেরানীরাও জানতে পারে।
এলিনর জানাল যেদিন পিটার লর্ড আমাকে উইল করার কথা বলেন সেদিন সন্ধ্যেবেলা সে মিঃ সেলডনকে চিঠি লেখে।
চিঠিটা কি আপনি নিজে ডাকবাক্সে দিয়েছিলেন?
এলিনর বলল হান্টারবেরী থেকে অন্য চিঠির সঙ্গে সে চিঠিটা পাঠিয়েছিল।
পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন চিঠি লিখে একবারও না পড়ে তিনি বাক্সে দিয়েছিলেন কি চিঠিটা?
বিস্মিত হয়ে এলিনর বলল, না তো, আর একবার পড়েছিলাম, আমি স্ট্যাম্প আনতে ওপরে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে নিশ্চিন্ত হবার জন্য আর একবার পড়ে মুখটা সেঁটেছিলাম।
ঘরে আর কেউ ছিল তখন?
শুধু রডি ছিল।
উনি কি জানতেন আপনি কি করছেন?
পোয়ারার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে এলিনর বলল, রডি এ ব্যাপারে কিছুই জানে না।
আপনি যখন ঘরের বাইরে ছিলেন তখন কি কেউ চিঠিটা পড়ে থাকতে পারে।
এলিনর এর কোন সুনিশ্চিত জবাব দিতে পারল না।
মানে মিঃ রডারিক ঘরে আসার আগে?
নিশ্চয়ই।
পোয়ারো বললেন, উনি নিজেও পড়ে থাকতে পারেন চিঠিটা?
এলিনর জানাল, অন্যের চিঠি পড়ার অভ্যেস রডির নেই।
পোয়ারো বললেন, ঐ দিনই কি প্রথম আপনার মাথায় মেরী জেরার্ডকে খুন করার কথাটা
মশালের মত জ্বলতে লাগল এলিনরের মুখ, একথা কি ড. লর্ড আপনাকে বলেছেন?
পোয়ারো প্রশ্নটা সরাসরি এড়িয়ে গিয়ে শান্ত সুরে বললেন, ঠিক ঐ দিনেই? না? যখন আপনি জানালা দিয়ে দেখলেন মেরী উইল লিখছে, ঠিক সেই মুহূর্তে, তাই না, আপনার মনে হয়েছিল মেরী জেরার্ড যদি মারা যায় তাহলে কি মজার ব্যাপারই না হবে, আর সুযোগই বা কি অসামান্য…।
ধরা গলায় এলিনর বলল, উনি জানতেন, উনি আমার দিকে তাকালেন এবং বুঝেছিলেন…। এলিনর জানতে চাইল, সত্যিই কি আমাকে সাহায্য করার জন্য ড. লর্ড আপনাকে পাঠিয়েছেন?
পোয়ারো উত্তর দিলেন, হ্যাঁ কথাটা সত্যি, শুনুন কার্লিসল, মেরী যেদিন মারা যায় সেদিনের সব ঘটনা আমার শোনা উচিত, আপনি কোথায় গিয়েছিলেন, কি করেছিলেন, তার থেকেও বড়ো কথা এমন কি চিন্তা করেছিলেন তাও আমার জানা উচিত।
একদৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে থেকে এলিনর মৃদু হাসলো, আপনি আশ্চর্য রকমের সরল মানুষ মিস পোয়ারো। আপনি কি বুঝতে পারছেন না, আপনাকে মিথ্যে কথা বলা আমার পক্ষে কত সহজ?
এরকুল পোয়ারো বললেন, না মাদমোয়াজেল, সত্যির মতো মিথ্যাও তার শ্রোতাকে সব কথা সমানভাবে জানিয়ে দেয়। কখনও কখনও একটু বেশী জানিয়ে দেয়।
এরপর পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, পরপর কি ঘটনা ঘটেছিল।
এলিনর জানাল, সে স্যাণ্ডউইচের জন্য মাছের পেস্ট কিনে হান্টারবেরীতে পৌঁছে মাসির ঘরে গিয়ে তার জিনিসপত্র দেখে ভড়ার ঘরে গিয়ে স্যাণ্ডউইচ তৈরী করছিল। খুব মৃদু স্বরে পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, তখন কি চিন্তা করছিলেন?
এলিনরের নীল চোখ ঝিলিক দিয়ে উঠল, আমার নামের অন্য এক মহিলা, অ্যাকুইটেইনের এলিনরের কথা চিন্তা করছিলাম।
পোয়ারো জানালেন, আমি ওই অ্যাকুইটেইনের-এলিনরের গল্পটা জানি। মহিলা ফেয়ার রোজামণ্ডকে বেছে নিতে বলেছিলেন হয় ছোরা নয় বিষ। রোজামণ্ড বিষই বেছে নিয়েছিল।
এক্ষেত্রে কিন্তু বেছে নেবার কোন প্রশ্ন ছিল না–তারপর মাদমোয়াজেল, তারপর কি হল? এলিনর বলল, স্যাণ্ডউইচগুলো তৈরী করে প্লেটে রেখে আউটহাউসে গিয়ে নার্স হপকিন্স ও মেরীকে নিয়ে এসে তিনজনে মিলে স্যাণ্ডউইচ খেলাম।
বেশ…তখনো কিন্তু স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন…তারপর?
তারপর? মেরী জানালার ধারে দাঁড়িয়েছিল, আমি আবার গেলাম ভাড়ার ঘরে, ঐ যে আপনি বললেন না, স্বপ্নের ঘোর ঠিক তাই।…নার্স ওখানে কাপ প্লেট ধুচ্ছিলেন, মাছের কৌটোটা আমি ওঁকে দিলাম। নার্সের কব্জিতে একটা দাগ ছিল। আমি প্রশ্ন করতে উনি বললেন, আউটহাউসের ধারে গোলাপ বাগানের কাটাতে কেটে গেছে। আমার মনে পড়ে গেল আমি আর রডি গোলাপের লড়াই খেলতাম। ঐ ভাড়ার ঘরে দাঁড়িয়ে…হঠাৎ হঠাৎ একটা অন্ধকার ঘিরে ধরল আমায়,..মনের গোপন কোণ থেকে ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ল…। আমি চাইনি ওর মৃত্যু হোক-পরে যখন আবার খাবার ঘরে গেলাম, দেখি মেরী মারা যাচ্ছে…।
পোয়ারোকে একদৃষ্টে ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে সলজ্জভাবে এলিনর প্রশ্ন করল, আপনি কি এখনও আমাকে প্রশ্ন করবেন…মেরী জেরার্ডকে আমি খুন করেছি কিনা?
পোয়ারো দ্রুতস্বরে বললেন, এমন অনেক জিনিস আছে যা আমি জানতে চাই না…।
.
২.১২.১
এরকুল পোয়ারো ট্রেন থেকে নামলেন। ড. লর্ড বললেন, যথাসম্ভব জোগাড় করে রেখেছি আপনার প্রশ্নের উত্তর। প্রথমতঃ, মেরী জেরার্ড ১০ই জুলাই এখান থেকে লণ্ডনে গিয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ, বাড়িতে আমার সংসারের কাজ করে কয়েকটি হাসিখুশি মেয়ে, আমার কোন হাউস-কীপার নেই। কাল সকালেই মিসেস স্ট্যাকারীর বাড়িতে আপনাকে নিয়ে যাব যিনি রানসমের (আমার পূর্বসূরীর) হাউস-কীপার ছিলেন।
ড. লর্ড বললেন, মিঃ পোয়ারোর সবচেয়ে আগে হান্টারবেরীতে যাওয়া উচিত ছিল। এ ধরনের কেস হলে তিনি আগে ঐ বাড়িটাতেই ছুটে যেতেন যেখানে মেরী খুন হয়েছে।
পোয়ারো বললেন, বইপড়া বিদ্যে নিয়ে রহস্যের তদন্ত করা যায় না। নিজের স্বাভাবিক বুদ্ধি কাজে লাগাতে হয়।
ড. লর্ড বললেন, কোন না কোন সূত্র তো পেতে পারতেন?
পোয়ারো বললেন, পুলিশ তন্ন তন্ন করে বাড়িটাকে খুঁজেছে এলিনরের বিপক্ষে যেতে পারে এমন সব প্রামণের জন্য, তার স্বপক্ষের জন্য নয়। পোয়ারো আরো জানালেন, এখন তিনি কি চান তা বুঝছেন, মনে হয় সামান্য কিছু হলেও কিছু একটা ও বাড়িতে পাওয়া যেতে পারে।
ব্যগ্র হয়ে ড. লর্ড প্রশ্ন করলেন, মানে এলিনরকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য।
গম্ভীর হয়ে পোয়ারো বললেন, অপেক্ষা করুন বন্ধু, এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
.
২.১২.২
দুপুরের লাঞ্চের সময় ড. লর্ড আর পোয়ারোর মধ্যে কথা হচ্ছিল, পোয়ারো বললেন, কোন কোন অপরাধের মূল থাকে অতীতের মধ্যে ছড়ানো। আমার মনে হয় এই ঘটনারও তাই ছিল।
বিরক্ত ড. লর্ড বললেন, দেখুন মিঃ পোয়ারো, আপনি কোন পথে এগোচ্ছেন তা জানার অধিকার কি আমার আছে? না আমাকে অন্ধকারেই থাকতে হবে?
পোয়ারো বললেন, থাকতে হবে, কারণ এখনও পর্যন্ত এমন কোন সূত্র পাইনি যা থেকে ধারণা হতে পারে একজন ছাড়া অন্য মেরী জেরার্ডকে খুন করতে পারে এবং সেই একজন হল এলিনর।
এতটা নিশ্চিত হবেন না, জানেন তো মেরী বহুদিন বিদেশে ছিল?
পোয়ারো জানালেন, জার্মানীতে তার কিছু স্পাই আছে। ছোটখাট কাজে তিনি তাদের ওপর নির্ভর করেন। শেষ একজনকে মিঃ ওয়েলম্যানের ফ্ল্যাট সার্চ করার জন্য লাগিয়েছিলেন উনি কতটা মিথ্যা কথা বলেছেন তা জানবার জন্য। পোয়ারো বললেন, প্রায় প্রত্যেকেই মিথ্যে বলেছেন। নার্স ও’ব্রায়ান বলেছেন স্বপ্নের কল্পনার রং লাগিয়ে, নার্স হপকিন্স গোঁয়ারের মতো, মিসেস বিশপ ঈর্ষা আর দ্বেষ মিশিয়ে আর আপনি…
ড. লর্ড প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, আমি নিশ্চয়ই আপনাকে মিথ্যে বলিনি।
পোয়ারো অস্বীকার করলেন না।
হান্টারবেরীর গেট পেরিয়ে মাঝবরাবর আসার পর মালী হরলিক-এর সঙ্গে দেখা। ড. লর্ড হরলিকের সঙ্গে পোয়ারার আলাপ করালেন এবং পোয়ারোকে বললেন, সেদিন সকালে হরলিক কাজ করছিল। হরলিক জানাল, সেদিন এলিনর কার্লিসলকে একটু যেন উত্তেজিত মনে হচ্ছিল–যেন মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করছিলেন।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, তুমি মেরী জেরার্ডকে চিনতে?
হ্যাঁ স্যার, তবে খুব ভালো চিনতাম না।
কি ধরনের মেয়ে ছিল ও?
অত্যন্ত ভালো মেয়ে স্যার, সুন্দর কথাবার্তা, নিজের সম্বন্ধে একটু বড় ধারণা ছিল। জানেন মিসেস ওয়েলম্যান ওকে নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি করতেন। ফলে ওর বাবা একেবারে ক্ষেপে গিয়েছিল।
পোয়ারো মেরীর বাবার সম্পর্কে জানতে চাইলে হরলিক জানাল, সবসময়ে কটু কথা বলত মিঃ জেরার্ড।
সেদিন সকালে কোথায় কাজ করছিলে তুমি?
হরলিক জানাল, তরকারীর বাগানে।
তুমি লাঞ্চ খেতে কখন গিয়েছিলে?
দুপুর ১টায় স্যার।
এবং তুমি কিছুই দেখতে পাওনি, আশেপাশে কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে..বা কারুর গাড়ি…কোন কিছু।
মালী আশ্চর্য হয়ে বলল, পিছন দিকের গেটের বাইরে সে ড. লর্ডের গাড়ি দেখেছে।
ড. লর্ড প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, আমার গাড়ি? হতেই পারে না। সেদিন সকালে আমি উইদেরবেরীর দিকে গিয়েছিলাম দুটোর আগে ফিরিনি।
ড. লর্ড তাড়াতাড়ি পোয়ারাকে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোলেন এবং কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললেন, শেষপর্যন্ত পাওয়া গেল গলিতে কার গাড়ি ছিল?
আপনার কি গাড়ি বন্ধু?
ফোর্ড-টেন, সমুদ্র-সবুজ রং। খুবই সাধারণ গাড়ি।
আর আপনি নিশ্চিত তো ঐ গাড়িটা আপনার ছিল না?
ড. লর্ড জানালেন, না।
পোয়ারো বললেন, তাহলে দেখা যাচ্ছে বন্ধু, এতদিনে একটা কিছু হাতের মুঠোর পাওয়া যাচ্ছে।
গাড়ি ঢোকার রাস্তায় অর্ধেকের বেশী যাবার পর রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেছে, যে ভাগটা ফুলের বাগানের দিকে ঘুরে গেছে ওরা সেই পথ ধরে হাঁটতে লাগলেন। কিছু দূরে গিয়ে বাঁক নিতেই ড. লর্ড পোয়ারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন সেই ভাঁড়ার ঘরের দিকে।
আপন মনে বিড় বিড় করে পোয়ারো বললেন, আর এখান থেকে যেকোন নোক ওটা দেখতে পারে। জানালা খোলা দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক।…আর বাড়ির ভেতর কি ঘটছে দেখার জন্য এই জায়গাটা বেছে নেওয়ার স্বাভাবিক।
দুজনে মিলে কিছু খুঁজতে লাগলেন, ড. লর্ড বললেন, ঐ যে জায়গাটা…ঝোঁপগুলির পাশে, ওখানে কিছু ঘাস-পাতার ওপর ভারী কিছুর ছাপ দেখা যাচ্ছে বলে মনে হয়, ঘাসগুলো মাথা তুলেছে বটে, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে জায়গাটা দলামলা হয়েছিল।
হ্যাঁ, জায়গাটা ভালো, রাস্তা থেকে দেখা যায় না, অথচ এখান থেকে দাঁড়িয়ে জানালাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের সেই বন্ধুটি এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিল? সিগ্রেট খেয়েছিল কি?
হঠাৎ পোয়ারো মুখ দিয়ে একটা চাপা শব্দ করলেন। মুখ তুলে ডা. লর্ড দেখলেন পোয়ারোর হাতে ভাঙ্গা দোমড়ানো মোচড়ানো খালি একটা দেশলাই বাক্স। ভালো করে দেখে ড. লর্ড চমকে উঠলেন, বিদেশী দেশলাই। পোয়ারো প্রায় উদাস গলায় বললেন, এবং মেরী জেরার্ড সম্প্রতি জার্মানী থেকে ফিরেছিল?
ড. লর্ড উত্তেজিত হয়ে বললেন, একটা ভালো সূত্র পেয়েছি, এ বিষয়ে আর কি সন্দেহ আছে?…কিন্তু, এখানে কার কাছেই বা বিদেশী দেশলাই থাকতে পারে।
আমি জানি, পোয়ারা বললেন, তবে আরো একটা অসুবিধে আছে, দেখতে পাচ্ছেন কি? না তো, বললেন ড. লর্ড।
ড. লর্ডের উত্তরের প্রত্যাশাকে নস্যাৎ করে দিয়ে পোয়ারো ভিতরে যাবার জন্য পা বাড়ালেন।
প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ড. লর্ড বলে উঠলেন, এমন কোন প্রমাণ নেই যে এলিনর কার্লিসল ঐ মরফিনের শিশিটা নিয়েছিল। ঐ বাগান থেকে কেউ ওকে লক্ষ্য করেছিল, তারপর এলিনর যখন মেরীদের ডাকবার জন্য আউটহাউসে গিয়েছিল সেই ফাঁকে কেউ এসে মরফিনের শিশির মুখ খুলে ওপরের স্যাণ্ডউইচের উপর ছড়িয়ে দিয়ে নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল গাড়ি করে, খেয়ালই করেনি লেবেলের টুকরোটা বেসিনের নীচে মেঝের ফলকটাতে আটকে রইল। পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, এখনও আপনি দেখতে পেলেন না। মানুষ যে কত নিরেট হতে পারে ভাবা যায় না।
.
২.১২.৩
শেষপর্যন্ত তারা সেই ঘরটিতে এলেন যেখানে মেরী মারা গেছিল। ড. লর্ড একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ঘরেই ঐ চেয়ারে মারা যায় মেরী জেরার্ড।
পোয়ারো সব দেখে আউটহাউসে যেতে চাইলেন। আউটহাউস থেকে বেরিয়ে একটা লতানো গোলাপ গাছ দেখিয়ে পোয়ারো আপন মনে বললেন, এই গোলাপের নাম জানেন? এর নাম জেফিরাইন দ্রুহিন।
ড. লর্ড বিরক্ত হলেন। পোয়ারো বললেন, এলিনর বলেছিলেন ছোটবেলায় তিনি আর রডারিক এই গোলাপ বাগানে গোলাপের যুদ্ধ খেলতেন। রডারিক ভালোবাসাত সাদা গোলাপ গন্ধ নেই।…এলিনর ভালোবাসত প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা লাল গোপাল। এলিনর ও রডারিকের ওটাই ছিল পার্থক্য। এর থেকে বোঝা যায় এলিনর কার্লির্সল আবেগপ্রবণ, অহংকারী হলেও ভালোবাসত একটি পুরুষকে যে ওর ভালোবাসার যোগ্য ছিল না।
পোয়ারো ঐ বাগানে যেতে চাইলেন।
নিঃশব্দে দুজনে গিয়ে বাগানে হাজির হলেন। সেই ঝোঁপের পাশে দাঁড়িয়ে যেন মৌনী নিলেন পোয়ারো, কিছুক্ষণ পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ব্যাপারটা এতো সহজ অথচ আপনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। আপনার তত্ত্ব অনুসারে মেরী জেরার্ডকে জার্মানীর পরিচয় কেউ হত্যা করতে এসেছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার দেখুন, এখানে দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেল মেরী নয়, অন্য একটি মেয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে স্যাণ্ডউইচ কাটছে। দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা কেন মনে করবে যে ঐ স্যাণ্ডউইচ দেওয়া হবে মেরীকে।
.
২.১৩.১
মুখভর্তি বানরুটির টুকরো নিয়ে নার্স হপকিন্স দেখলেন দরজায় মিঃ পোয়ারো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও পোয়ারোকে ঘরের ভিতর নিয়ে এলেন নার্স হপকিন্স। পোয়ারো জানালেন, তিনি সত্যি কথাটা জানার জন্য এসেছেন।
নার্স হপকিন্স রাগে ফেটে পড়ে বললেন, নিজেকে কোনভাবেই আমি বাঁচাতে চাই না, তাহলে তদন্তের সময় যেচে গিয়ে মরফিনের শিশি হারানোর কথা বলতাম না। পেশাগত অসাবধানতার জন্য ধমকানি শুনতে হবে জেনেও কথাটা আমি লুকোইনি। আমি সেইটুকুই করোনার কোর্টে বলেছি যেটুকু এ কেসের জন্য বলা দরকার। মেরী জেরার্ড-এর মৃত্যুর ব্যাপারে আমাকে কোনোভাবেই জড়ানো যাবে না।
পোয়ারো বাধা দেবার কোন চেষ্টাই করলেন না। শান্ত গলায় তিনি বললেন, মেরী জেরার্ডের জীবন বৃত্তান্তের কথা আপনি চেপে গিয়েছেন। আমি তাই জানতে চেয়েছি।
কেন চাপবো না, বিশেষ করে অপরাধের সঙ্গে যখন তার সম্পর্কে নেই।
যদি ব্যাপারটা সম্পূর্ণ অনুমান হয়…….তাহলে হয়তো সম্পর্ক নেই কিন্তু আপনি যদি প্রকৃত ঘটনাটা মানেন, তবে অন্য ব্যাপার।
পোয়ারো জানালেন, মিসেস ফ্লাটারীর সঙ্গে তার কথাবার্তায় তিনি জেনেছেন মিসেস ওয়েলম্যান আর স্যার লিউইস রাইক্রফট-এর মধ্যে বিশ বছরের বেশী একটা গভীর প্রেমের ব্যাপার ছিল। স্যার লিউইস রাইক্রফট-এর স্ত্রী ছিলেন পাগল কিন্তু তার শরীর স্বাস্থ্য ছিল খবুই মজবুত, অনায়াসে বছর নব্বই বেঁচে যেতে পারতেন। যেহেতু সেযুগে বিবাহ বিচ্ছেদের সুবিধাজনক আইন ছিল না তাই তাদের মিলন সম্ভব হয়নি। দুজনের প্রেমের গোপন সম্পর্কটা আন্দাজ করলেও কেউ সঠিকভাবে মানত না। পরে রাইক্রফট যুদ্ধে মারা যান। আমার অনুমান, রাইক্রফটের মৃত্যুর পর একটি শিশুর জন্ম হয় আর ঐ শিশুই হল মেরী জেরার্ড।
নার্স হপকিন্স বললেন, দেখছি আপনি সবই জানেন। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর নার্স হপকিন্স ঘরের অন্যদিকে একটা আলমারী খুলে একটা খাম নিয়ে পোয়ারোর হাতে দিয়ে বলেলেন, কি করে এটা আমার হাতে এল তা বলছি। মনে রাখবেন আমার একটু সন্দেহ ছিল। প্রথমতঃ মিসেস ওয়েলম্যান যে চোখে মেয়েটিকে দেখতেন এবং দ্বিতীয়তঃ, যে গুজব চালু হয়েছিল, অসুস্থ অবস্থায় বুড়ো জেরার্ড আমাকে বলেছিলেন, মেরী তার মেয়ে নয়। মেরী মারা যাবার পর আমি আউটহাউসের ঘর পরিষ্কার করছিলাম, একটা ড্রয়ারে বুড়োর অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে এই চিঠিটা পাই।
খামটার ওপর বিবর্ণ হয়ে আসা কালিতে লেখা, মেরীর জন্য, আমার মৃত্যুর পর পাঠাতে হবে। নার্স হপকিন্স জানালেন, চিঠিটা মেরীর মায়ের লেখা, যিনি প্রায় ১৪ বছর আগে মারা গেছেন।
পোয়ারো চিঠিটা বের করলেন–চিঠিতে লেখা–যদি কখনও প্রয়োজন পড়ে সেইজন্য এই চিঠিতে সত্য কথাটি লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছি। হান্টারবেরীর মিসেস ওয়েলম্যানের পরিচারিকা ছিলাম আমি। উনি আমাকে খুব স্নেহের চোখে দেখতেন, একবার আমি বিপদে পড়ি, উনি আমাকে সাহায্য করেন এবং সব শেষ হবার পর আবার কাজে বহাল করেন, বাচ্চাটা কিন্তু মারা যায়। আমার মনিবগিন্নী এবং স্যার লিউইল রাইক্রফট পরস্পর পরস্পরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন কিন্তু তারা বিয়ে করতে পারেননি, কারণ ভদ্রলোকের স্ত্রী পাগলা-গারদে ছিলেন। স্যার রাইক্রফট অত্যন্ত অমায়িক মানুষ ছিলেন। যুদ্ধে তিনি মারা যান। অল্পকাল পরেই মনিবগিন্নী আমাকে জানান তার বাচ্চা হবে। তারপর তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্কটল্যাণ্ডে যান। ওখানে আরডলোক্রিতে শিশুটি জন্ম নেয়। জেরার্ড, যে আমাকে বিপদে ফেলে পালিয়েছিল, আমার বিপদ কেটে গেছে দেখে আবার চিঠি লেখা শুরু করেছিল। বন্দোবস্ত হল যে জেরার্ড আমাকে বিয়ে করবে এবং বাচ্চাটি আমার বাচ্চা বলে মনে করবে, এবং আউটহাউসে থাকবে। উদ্দেশ্য বাচ্চাটিকে চোখের সামনে রাখা। তার লেখাপড়ার বন্দোবস্ত করে সমাজে একটা ভালো জায়গা করে দেওয়া। তিনি চেয়েছিলেন প্রকৃত সত্য যেন কোনদিনও মেরীকে জানানো না হয়। মিসেস ওয়েলম্যান আমাদের দুজনকেই মোটা টাকা দেন। কিন্তু না দিলেও আমি তাকে সাহায্য করতাম। বরকে পেয়ে আমি সুখী হয়েছিলাম, কিন্তু ও মেরীকে সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু আমার মনে হয় মারা যাবার আগে একথাটা কাগজে কলমে লিখে রেখে যাওয়া ভাল।–এলিজা জেরার্ড (বিয়ের আগের নাম এলিজা রাইলি)।
জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে চিঠিটা রাখলেন পোয়ারো। নার্স হপকিন্স এসব ব্যাপার আর পাঁচজন না জানলেই ভালো। কারণ ওঁরা সবাই মৃত।
যাঁরা বেঁচে আছেন, তাদের কথাও তো চিন্তা করা উচিত? পোয়ারো বললেন।
কিন্তু এ ঘটনার সঙ্গে খুনের তো কোন সম্পর্ক নেই।
গম্ভীর হয়ে পোয়ারো বললন, কে বলতে পারে, অনেক কিছুই এ থেকে পাওয়া যেতে পারে। বলে পোয়ারো বেরিয়ে গেলেন।
কিছুদুর যাবার পর হরলিকের সঙ্গে দেখা। হরলিক জানাল গাড়িটা ড. লর্ডেরই ছিল। গাড়ির নম্বর এম.এম.এস. ২০২২। হরলিককে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
৩. আদালত ঘরে
৩.১.১.
আদালত ঘরে গিয়ে এলিনরের অতীতের কথাই মনে পড়ছিল। সরকারী উকিলের বক্তব্য শেষপর্যন্ত শোনেনি সে। পুরোনো দিনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছিল মনে মনে।…সেই প্রথম..যেদিন ঐ অশুভ চিঠিটা পেল…তারপর পুলিশ অফিসার অনর্গল বলতে লাগলেন, আপনি এলিনর ক্যাথরীন কার্লিসল, গত ২৭শে জুলাই বিষপ্রয়োগে মেরী জেরার্ডকে হত্যা করা অপরাধে আপনাকে গ্রেপ্তার করার পরোয়ানা আমি এনেছি এবং আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি যে আপনি যা বলবেন তা লিখে রাখা হবে, এবং তা আপনার বিচারের সময় সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ভয়ংকর গরম সীসার মতো কথাগুলো ওর কানে ঢুকছিল, আর হাজার চোখ অসম্ভব কৌতূহল নিয়ে যেন এলিনরের সমগ্র সত্তাকে গ্রাস করতে চাইছিল। এলিনরের মনে হল জুরীরাই একমাত্র ওর দিকে তাকাচ্ছেন না কারণ…একটু পরেই ওঁরা যা বলবেন সেটা জানেন বলেই ওর দিকে তাকাচ্ছেন না।
.
৩.১.২
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ড. লর্ডকে এখন আর সদা হাস্যময়, নম্র, বন্ধুত্বপর্ণ মোটেই মনে হচ্ছে না। পুরোদস্তুর পেশাদার–নিরুত্তাপ, নিস্পৃহ গলায় একসুরে উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন টেলিফোন পেয়ে তিনি হন্টারবেরী পৌঁছানোর কয়েকমিনিট পর মেরী জেরার্ড মারা যায়। কৌড্রোইয়ান্তে শ্রেণির মরফিন বিষক্রিয়ার মৃত্যু হয়েছে বলেই তিনি মনে করেন।
স্যার এডউইন বামার জেরা করতে শুরু করলেন ড. পিটার লর্ডকে।
মেরী জেরার্ডের প্রতি আসামীর ব্যবহার কেমন ছিল বলতে পারনে কি?
অত্যন্ত মধুর এবং স্বাভাবিক।
একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে স্যার এডুইন বামার বললেন, ঈর্ষা মেশানো ঘৃণার কোন চিহ্ন আপনি দেখেননি, যে কথা অনেকক্ষণ ধরে শুনেছি এখানে।
ড. লর্ড বললেন, দেখিনি।
এলিনরের মনে হল ড. লর্ড ওর জন্যই মিথ্যে কথা বলছেন।
ড. লর্ডের পর পুলিশ সার্জেন এলেন কাঠগড়ায়। মরফিনের ক্রিয়া কিভাবে হয় তার খুঁটিনাটি বর্ণনা দিলেন।
.
৩.১.৩
পরদিন কোর্টে বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ ড. অ্যালান গারসিয়া সাক্ষ্য দিতে এসে বোঝালেন মরফিয়ার এক গ্রেনেই মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।
স্যার এডুইন জেরা করতে লাগলেন ড, অ্যালানকে। এমন কোন প্রমাণ দেখাতে পারেন কি যে মরফিয়া খাওয়া হয়েছিল বিশেষ কোন একটা খাদ্যের মাধ্যমে?
ড. অ্যালান বুঝতে না পারায় স্যার এডুইন জানতে চাইলেন যে, মরফিয়া কি মেরী মাছের পেস্ট বা রুটি বা মাখন বা চা বা দুধ কোন একটা কিছুর সঙ্গে খেয়েছিল?
ড. জানালেন, এমন কোন বিশেষ প্রমাণ নেই যা দিয়ে বলা যায় মাছের পেস্টেই বিষ ছিল বা অন্য কিছুর মাধ্যমে বিষ খাওয়ানো হয়ে থাকতে পারে, এমনকি মরফিয়ার ট্যাবলেট আলাদাভাবেও খেয়ে থাকতে পারে মেরী জেরার্ড। তবে যেভাবেই মরফিয়া খাওয়ানো হোক না কেন অন্যান্য খাবার ও চা খাওয়ার সময়েই মরফিয়া খাওয়ানো হয়েছিল এ বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ।
.
৩.১.৪
এরপর শপথ নিলেন ইনসপেক্টর ব্রিল। অভ্যস্ত স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে তিনি জানালেন খবর পেয়ে বাড়িতে গিয়ে আসামীর কাছ থেকে জানেন যে, খারাপ মাছের মণ্ডের জন্য মেরীর মৃত্যু হয়ে থাকতেও পারে। বাড়ি তল্লাসী করে ঝাঁঝরির মুখে ধুয়ে মুছে সাফ করা একটা মাছের টিনের কৌটো আর একটা অর্ধেক ভর্তি মাছের টিন আর টেবিলের পাশে বেসিনের নীচে মেঝের একটা ফলকে ছোট্ট একটা মরফিন ট্যাবলেটের শিশির গায়ের কাগজপত্র এবং কাগজের টুকরো ঘটনার দিন সকালেও এসে থাকতে পারে বলে তার ধারণা জানালেন।
.
৩.১.৫
সাক্ষীর কাঠগড়ায় নার্স হপকিন্সেকে দেখে এলিনরের মনে হল ইনসপেক্টর ব্রিলের তুলনায় নার্স হপকিন্স অনেকটা মানবিক, হৃদয়বতী।
জেরা শুরু করলেন স্যার এডুইন।
গত ২৮শে জুন আপনি কোথায় ছিলেন?
নার্স হপকিন্স যথাযথ উত্তর দিলেন এবং সঙ্গের অ্যাটাচিকেসে কি কি জিনিষ ছিল তার যথাযথ বর্ণনা দিলেন।
শিশিতে কি ছিল? প্রশ্ন করলেন স্যার এডুইন।
আধ গ্রেনের কুড়িটা মরফিন হাইড্রোক্লোরাইড ট্যাবটেল ছিল।
নার্স হপকিন্স আরো জানালেন ২৮ শে জুন সন্ধ্যেবেলা অ্যাটাচিকেসটা হলঘরে রাখার। পরদিন সকাল ৯টা নাগাদ তিনি ওটার খোঁজ করেন। মরফিনের শিশিটা হারিয়ে যাবার কথা একমাত্র নার্স ও’ব্রায়ানকেই তিনি বলেন।
আপনার কেসটা হলঘরে এমনভাবে ছিল যে যাতায়াত করার সময় যে কেউ ওটার নাগাল পেতে পারতো? জিজ্ঞেস করলেন স্যার এডুইন।
নার্স হপকিন্স সংক্ষেপে জানালেন, হ্যাঁ।
স্যার স্যামুয়েল মৃতা মেরী জেরার্ডের সম্বন্ধে জানতে চাইলে নার্স হপকিন্স জানালেন, মেরী খুব ভালো মেয়ে ছিল।
মৃত্যুর সময় এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল কি যাতে তার সুখ শান্তি বিঘ্নিত হতে পারতো বা ভবিষ্যৎ দুঃখময় হয়ে উঠতে পারত? মানে মেরীর পক্ষে আত্মহত্যা করার তেমন কোন কারণই কি ছিল না?
নিশ্চয়ই না।
এলিনরের মনে হল, সব জিনিষটাই সত্যি…নার্স হপকিন্স ওটা বিশ্বাস করেন, উনি দ্বিমত নন যে কাজটা আমি করেছি। তাছাড়া উনি যা বলেছেন তা বর্ণে বর্ণে সত্যি। আর সেই কারণেই ব্যাপারটা ভয়াবহ।
সাক্ষীকে মরফিন লেবেলের টুকরোটা একটা ছোট পিচবোর্ডের ওপর সেঁটে দেখান হল এবং সাক্ষী জানাল টুকরোটা তার হারিয়ে যাওয়া শিশিরই লেবেলের মতোই যদিও জোর দিয়ে বলা অসম্ভব।
.
৩.২.১
স্যার এডুইন বামার এবার নার্স হপকিন্সকে জেরা শুরু করলেন। অ্যাটাচিকেস শুধু মিস কার্লিসলের নাগালের মধ্যেই ছিল, না, কি যে-কোন চাকর, বা ড. লর্ড, বা মিঃ ওয়েলম্যান বা নার্স ও’ব্রায়ান যে কেউ পেতে পারতো বা মেরীর ব্যাগে যে মরফিরা আছে তা জানা মিস কার্লিসলের পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা বা ড. লর্ড বা মেরী জেরার্ডের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না ইত্যাদি।
এডুইন বামার প্রশ্ন করলেন, সকালে আপনি নার্স ও’ব্রায়ানকে বলেছিলেন যে মরফিয়ার শিশি হারিয়েছে?
হা।
কিন্তু আমি আপনাকে বলছি যে, আপনি আসলে যা বলেছিলেন তা হল: মরফিন আমি বাড়িতে ফেলে এসেছি, ওটার জন্য আবার বাড়ি ফিরতে হবে।
নার্স হপকিন্স জানালেন, শিশিটা খুঁজে না পেয়ে ওই ধরনের মন্তব্য তিনি করেছিলেন। আসলে ওষুধটা নিয়ে কি করেছেন সেটাই আপনার খেয়াল ছিল না।
না, মনে আছে ওটা কেসের মধ্যে ভরেছিলাম।
তাহলে ২৯শে জুন সকালে কেন আপনি বলেছিলেন ওটা বাড়িতে ফেলে এসেছেন?
কারণ মনে হয়েছিল আমি তাই করেছি।
যেদিন মেরী জেরার্ড মারা যায়, সেদিন ২৭শে জুলাই গোলাপ গাছের কাটায় আপনার খোঁচা লেগেছিল–এমন কথা কি আপনি বলেছিলেন?
নার্স হপকিন্স বললেন, হ্যাঁ।
একটু সময় নিয়ে স্যার এডুইন প্রশ্ন করলেন, আপনি এখনও জোর দিয়ে বলছেন যে ২৮শে জুন আপনি যখন হান্টারবেরীতে আসেন তখন আপনার অ্যাটচিকেসে মরফিনের শিশি ছিল?
হা ছিল।
ধরুন যদি এখন নার্স ও’ব্রায়ান কাঠগড়ায় গিয়ে বলেন যে, আপনি বলেছিলেন সম্ভবত ওটা বাড়িতে ফেলে এসেছেন?
ওটা আমার কেসের মধ্যেই ছিল, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্যার এডুইন বললেন, মরফিয়ার শিশি খুঁজে না পেয়ে আপনার একটুও অস্বস্তি হয়নি?
না…অস্বস্তি…না তো?
ও, তাহলে আপনি কোন রকম উদ্বিগ্নও হননি, যদিও মরফিয়ার মত বিপজ্জনক ওষুধ অতোটা হারিয়ে গেছে?
আমি ভাবিইনি ওটা কেউ নিয়েছে।
বুঝেছি, ঠিক সেই মুহূর্তে আপনার মনে পড়েনি ওটা কোথায় রেখেছিলেন?
মোটেই না। অ্যাটাচির মধ্যেই ছিল।
কুড়িটা আধ গ্রেনের ট্যাবলেট, অর্থাৎ দশ গ্রেনের মত মরফিয়াতে অনেকগুলো মানুষ মারা যায় সে কথাটা ভেবে উদ্বিগ্ন হননি? আপনার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল না কি? আইনের চোখে এই অসাবধানতা কিন্তু অপরাধ।
একথা কি ঠিক যে ৬ই জুলাই বৃহস্পতিবার মেরী জেরার্ড উইল করেছিল?
নার্স হপকিন্স জানালেন, মেরী উইল করাটা যুক্তিযুক্ত মনে করেই করেছিল কোন মানসিক অবসাদ বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে দুঃশ্চিন্তা থেকে নয়।
নার্স হপকিন্স জানালেন, এলিনর কার্লিসল মহানুভবতা দেখিয়ে দুহাজার পাউণ্ড দিয়েছিল।
বলুন তো, মেরী জেরার্ড আর মিঃ রডারিক ওয়েলম্যানকে নিয়ে কোন গুজব গ্রামে রটেছিল?
মেরীব প্রতি উনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
তার কোন প্রমাণ আছে আপনার কাছে?
না, শুধু জেনেছি, শুনেছি।
ওহ! শুধু জেনেছেন–শুনেছেন, তাই না, এতে কিন্তু জুরীরা খুব একটা বিশ্বাস করবেন বলে মনে হয় না। মনে পড়ছে কি, সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আপনি একবার বলেছেন রডারিকের ব্যাপারে মেরীর কোন সম্পর্কই ছিল না, কারণ এলিনর বাগদত্তা ছিলেন, এমনকি মেরী লণ্ডনেও রডারিককে ও কথা বলেছেন।
ওই কথা ও আমাকেও বলেছিল।
মেরী জেরার্ড যখন আপনার সঙ্গে উইলে কিভাবে কিলিখতে হবে তাই নিয়ে আলোচনা করছিল, তখন কি আসামী জানালা দিয়ে দেখেছিল?
হ্যাঁ, দেখেছিলেন।
কি বলেছিলেন উনি?
উনি বলেছিলেন, তাহলে মেরী তুমি তোমার উইল করছ। ভারী মজার ব্যাপার তো, এই বলে হাসতে লাগলেন। ঐ মুহূর্তে চিন্তাটা ওর মাথায় এসেছিল। মেরীকে সরিয়ে দেবার চিন্তা। এইসময়েই খুন করার কথাটা মাথায় ঢোকে।
জজ কড়া গলায় বললেন, শুধু প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখুন।
এলিনর ভাবতে লাগল…কি আশ্চর্য,…যখন কেউ সত্যি কথা বলছে…তখন এটা বাদ দেওয়া হচ্ছে।
.
৩.২.২
এবার কাঠগড়ায় এলেন নার্স ও’ব্রায়ান।
২৯শে জুন সকালবেলায় নার্স হপকিন্স কোন কথা আপনাকে বলেছিলেন?
হ্যাঁ, উনি বলেছিলেন ওঁর ব্যাগ থেকে মরফিনের শিশি হারিয়ে গেছে।
আপনি জানতেন কি অ্যাটাচিটা সারারাত হলঘরে ছিল?
হ্যাঁ।
মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুর সময় আসামী এবং মিঃ রডারিক ওয়েলম্যান দুজনে ঐ বাড়িতে ছিলেন–অর্থাৎ ২৮শে জুন থেকে ২৯শে জুন পর্যন্ত?
হ্যাঁ।
মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুর পরের দিন–২৯শে জুন তারিখের কোন ঘটনা আপনার জানা আছে কি?
আমি মিঃ রডারিক ওয়েলম্যানকে দেখেছিলাম মেরী জেরার্ডের সঙ্গে। উনি মেরীকে বলছিলেন তাকে ভালোবাসেন।
তখন কিন্তু আসামী ওঁর বাগদত্তা ছিলেন।
হা।
তারপর কি হল?
মেরী ওঁকে বলেছিল ঐ আচরণের জন্য লজ্জা পাওয়া উচিত, যেহেতু বিশেষ করে ওঁর সঙ্গে এলিনরের বিয়ের পাকা হয়ে আছে।
মেরীর প্রতি আসামীর মনোভাব সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
ঘৃণা করত, এমন করে তাকাত যেন ভস্ম করে দেবে।
স্যার এডুইন বললেন, একথা কি ঠিক নয় যে নার্স হপকিন্স বলেছিলেন তার ধারণা মরফিন উনি বাড়িতে ফেলে এসেছেন?–
হ্যাঁ, বলেছিলেন মানে দেখুন। ব্যাপারটা এইভাবে…পরে…।
তখন উনি ওটার সম্বন্ধে খুব একটা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন না?
না, কারণ তার মনে হয়েছিল, ওটা তিনি বাড়িতে ফেলে এসেছেন, উনি ভাবতে পারেননি কেউ ওটা নিয়েছে।
ঠিক তাই, মরফিয়ার প্রয়োগে মেরী জেরার্ড মারা যাবার পরেই ওঁর কল্পনাশক্তি কাজ করতে লাগল।
জজ বাধা দিলেন, স্যার এডুইন আমার মনে হয় আগের সাক্ষীকে আপনি এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছেন।
ধর্মবতারের মর্জি…বাও করলেন স্যার এডুইন, তারপর ঘুরে প্রশ্ন করলেন, মেরীর প্রতি আসামীর আচরণের কথা হচ্ছিল, আচ্ছা ওদের মধ্যে কখনও ঝগড়া হয়েছে?
না, ঝগড়া হয়নি।
মেয়েটির প্রতি এলিনর কার্লিসল সবসময় খুশি ছিলেন?
হা, ঐ দৃষ্টিতে উনি তাকে দেখতেন।
বেশ, বেশ, বেশ…কিন্তু ঐ ধরনের উত্তরে আমাদের কাজ হবে না। আপনি তো আয়রল্যাণ্ডের লোক, তাই না?
হা।
এবং আয়ারল্যাণ্ডের লোকেরা খুবই কল্পনাপ্রবণ হয়, তাই না?
নার্স ও’ব্রায়ান উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন, আমার প্রতি কথা সত্যি।
.
৩.২.৩
মুদিখানার মালিক মিঃ অ্যাবট কাঠগড়ায় এলেন। বেশ উত্তেজিত অনিশ্চয়তার ভাব (আবার একটু রোমাঞ্চিত নিজের মর্যাদা বৃদ্ধিতে), সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্য দিলেন। তাকে জেরা করা হয়নি।
.
৩.৩.১
আসামীপক্ষের সওয়াল :
জুরী মহোদয়গণ, আপনাদের সমক্ষে আমার বলা অনুচিত হবে না, এবং আমি চাইলেও বলতে পারি আসামীর বিরুদ্ধে প্রকৃতপক্ষে কোন কেই নেই। অভিযোক্তারা বারবার একটি কথা বলেছেন, যে এলিনর কার্লিসল মরফিন সংগ্রহ করার পর (সেটা হাতিয়ে নেবার সুযোগ ঐ বাড়িতে উপস্থিত সকল ব্যক্তির পক্ষে সমান ছিল, এবং বিষটা যে বাড়িতেই ছিল এ সম্বন্ধেও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়ে গেছে), মেরী জেরার্ডকে বিষ খাওয়াতে এগিয়ে গিয়েছিল। বাদীপক্ষ এখানে যে ঘটনার উপর সবিশেষ জোর দিয়েছেন তা হল সুযোগ। উদ্দেশ্য প্রমাণ করতেও তারা পারেননি। তার কারণ হল যে, কোন উদ্দেশ্য ছিল না। বিবাহের সম্পর্কে ভেঙ্গে যাবার বিষয়টিকে বাদীপক্ষ উদ্দেশ্য হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন-বাগদান করার পর বিয়ে ভেঙে যাওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে পৃথিবীতে শতশত খুন হত। আর এখানে এই বিবাহ সম্পর্কটি কোন চিত্তবৃত্তিঘটিত আবেগের অর্থাৎ প্রায় ভালোবাসার ব্যাপার নয়, সম্পূর্ণভাবে এক পরিবারিক বন্ধন। আমি প্রমাণ করতে চাই এই আকর্ষণটা এত গভীর ছিল না। (ওহ রডি…রডি…প্রেমের উত্তাপ নাকি তত তীব্র ছিল না। তাছাড়া, এই বিবাহ সম্পর্কে ছেদ টেনেছিল স্বয়ং আসামী। বৃদ্ধা মিসেস ওয়েলম্যানকে খুশি করাই ছিল এলিনর কার্লির্সল ও রডারিক ওয়েলম্যানের মধ্যে বাগদানের উদ্দেশ্য। উনি মারা যাবার পর এরা দুজনেই মনে করেছিল বিবাহিত হবার পক্ষে যতোটা আকর্ষণ থাকা দরকার তার তাদের মধ্যে নেই। অবশ্য তারা পরস্পরের কাছে পরম মিত্র হয়ে থাকবে। মাসির সম্পত্তি পাবার পর সহৃদয়া এলিনর কার্লির্সল বেশ মোটা টাকা দিতে মনস্থ করেছিলেন মেরী জেরার্ডকে, আর সেই মেয়েটিকেই কিনা খুন করার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত। এর চেয়ে পরিহাসের আর কি হতে পারে।
এলিনর কার্লিসলের বিরুদ্ধে একটিই অভিযোগ আর তা হল, যে পরিস্থিতিতে বিষপ্রায়োগের ঘটনাটা ঘটেছিল।
সরকারপক্ষের বক্তব্যের সারমর্ম এই :
এলিনর কার্লিসল ছাড়া আর কেউ মেরী জেরার্ডকে খুন করতে পারে না। অতএব সম্ভাব্য একটা উদ্দেশ্য তারা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমি আগেই আপনাদের বলেছি তারা কোন কারণ দেখাতে পারেননি, যেহেতু প্রকৃতপক্ষে খুন করার উদ্দেশ্যই এখানে নেই।
এখন দেখা যাক একথা কি সত্যি যে এলিনর কার্লিসলকে ছাড়া আর কেউ মেরী জেরার্ডকে খুন করতে পারে না? না, তা নয়। এলিনর যখন আউটহাউসে গিয়েছিল মেরীকে ডাকতে তখন কেউ এসে স্যাণ্ডউইচে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল, একথাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সাক্ষ্যপ্রমাণের মূল আইনে এ কথা বলা আছে যে, সাক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যদি অন্য কোন বিকল্প তত্ত্ব উপস্থাপিত করা যায় তবে আসামীকে রেহাই দেওয়া যায়। আমি আপনাদের দেখাতে চাইব আরও এক ব্যক্তি ছিল, মেরীকে বিষ দেবার সমান সুযোগ যার ছিল, এবং খুন করার উদ্দেশ্যও তার ক্ষেত্রে অনেক জোরালো, এ ব্যাপারে সাক্ষ্য উপস্থিত করব আমি। তবে তার আগে বলতে চাই যে, একমাত্র সুযোগ থাকা ছাড়া অন্য কোন প্রমাণ যেখানে অনুপস্থিত সেখানে শুধু ঐ একটা কারণ দেখিয়ে পৃথিবীর কোন জুরী এই মহিলাকে দোষী বললেন না। এবং সেই সঙ্গে এটাও যদি দেখান যেতে পারে যে অন্য কারুর সুযোগ ছিল এবং খুন করার উদ্দেশ্যটিও জোরদার। সরকার পক্ষের অন্ততঃ একজন সাক্ষী যে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছিন তা প্রমাণ করার জন্য আমি একজন সাক্ষীকে ডাকবো। কিন্তু তার আগে আমি আসামীকে উপস্থিত করব, তারই মুখে তার কাহিনী শুনুন আপনারা, এবং আপনারা নিজেরাই বুঝতে পারবেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি কত যুক্তিহীন।
.
৩.৩.২
স্যার এডুইন নম্রভাবে ও উৎসাহ দেবার মত করে বারবার শেখানো প্রশ্নগুলি করছিলেন।
রডারিক ওয়েলম্যানকে আপনার ভালো লাগত?
ভীষণ ভালো লাগত। ও আমার ভাই-এর মত ছিল-খুড়তুতো ভাই-এর মতো।…ওকে আমি সবসময় খুড়তুতো ভাইয়ের মতোই দেখতাম।
এর থেকে ধীরে ধীরে…বিয়ের কথা যখন উঠল-তখন বেশ ভালোই লেগেছিল, কারণ এমন একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম যাকে ছোটোবেলা থেকে চিনতুম।
হয়তো ঠিক তা নয়, মানে যাকে খুব একটা মাখামাখি ভালোবাসা বলে তাই না?
না না…আমার দুজন দুজনকে খুব ভালোভাবে চিনতুম।
মিসেস ওয়েলম্যান মারা যাবার পরে আপনাদের সম্পর্কে মধ্যে সামান্য চিড় ধরেছিল কি?
হ্যাঁ, ধরেছিল।
এর কারণ কি?
মনে হয় আংশিকভাবে টাকা-পয়সা।
টাকা-পয়সা?
হ্যাঁ, রডারিক অস্বস্তি বোধ করছিল। ওর ধারণা হয়েছিল লোকে বলবে ও আমাকে টাকা পয়সার জন্য বিয়ে করেছে।
তবে মেরী জেরার্ডের জন্য আপনাদের বিয়ের সম্পর্কটা ভাঙ্গেনি?
আমার মনে হয় রডি ওর দিকে একটু ঝুঁকেছিল, তবে সেটা খুব সিরিয়াস ব্যাপার নয়।
বাড়াবাড়ি হলে কি আপনি খুব ঘাবড়ে যেতেন?
নিশ্চয়ই না, আমি মনে করতাম ওদের ব্যাপারটা খুব খাপ খাচ্ছে না, ব্যস এইটুকুই।
এইবার বলুন, ২৮শে জুন আপনি নার্স হপকিন্সের অ্যাটাচি থেকে মরফিনের শিশি নিয়েছিলেন, না নেননি?
নিইনি।
আপনার কাছে কখনও মরফিন ছিল কি?
কখনও না।
আপনি কি জানেন আপনার মাসি আদৌ কোন উইল করেননি।
না, আমার খুব আশ্চর্য লেগেছিল।
আপনার কি মনে হয় ২৮শে জুন রাতে যখন উনি মারা যান, তার আগে উনি কি আপনাকে কোন কথা বলে যেতে চাইছিলেন?
আমি যা বুঝেছিলাম–মেরী জেরার্ডের জন্য কোন বন্দোবস্ত করেননি, এবং সেটাই করতে চাইছিলেন। এবং তাঁর ইচ্ছা পূরণ করার জন্য আপনি নিজের থেকে ঐ মেয়েটিকে কিছু টাকা দেবেন ঠিক করেছিলেন?
হ্যাঁ, আমি লরা মাসির ইচ্ছাটাকে পূরণ করতে চেয়েছিলাম। এবং মেরী আমার মাসিকে যেভাবে সেবাযত্ন করত তার জন্য আমি মেরীর কাছে কৃতজ্ঞ ছিলাম।
আপনি কি ২৬শে জুলাই লণ্ডন থকে মেডেনসফোর্ড এসে কিংস আর্মসে উঠেছিলেন?
হা।
কেন এসেছিলেন এখানে?
বাড়িটার একজন খদ্দের পেয়েছিলাম, উনি তাড়াতাড়ি দখল চাইছিলেন। আমি এসেছিলাম মাসির ব্যক্তিগত জিনিসপত্রগুলো বেছে নিয়ে যেতে, আর বাকী সব বন্দোবস্ত করে যেতে।
২৭শে জুলাই হান্টারবেরী হলে যাবার সময় পথে কিছু খাবার কিনেছিলেন নাকি?
হ্যাঁ, আমি ভেবেছিলাম আবার গ্রামে কেন ফিরে যাব। সবার জন্য ওখানেই পিকনিকের মত করে একটু খেয়ে নিলে মন্দ হয় না।
তারপর কি আপনি হান্টারবেরীতে গিয়ে জিনিসপত্র বাছাবাছি করছিলেন?
হা।
এবং তারপর কি করলেন?
অমি রান্নাঘরে এসে কিছু স্যাণ্ডউইচ কাটলাম তারপর আউটহাউসে গিয়ে জেলা নার্স আর মেরী জেরার্ডকে বাড়িতে ডাকলাম কিছু খাবার জন্য।
এটা কেন করলেন?
ওরা ঐ রোদে আবার গ্রামে যাবে, খেয়ে আবার ফিরবে, ওদের কষ্ট বাঁচাবার জন্য।
যে স্যাণ্ডউইচগুলো আপনি কেটেছিলেন ওগুলো কোথায় ছিল?
ভাড়ার ঘরে একটা প্লেটের ওপর।
জানালা কি খোলা ছিল?
হ্যাঁ।
আপনি যখন ছিলেন না, তখন যেকোন লোকের পক্ষে ভাড়ার ঘরে ঢোকা সম্ভব ছিল?
নিশ্চয়ই।
যদি কেউ বাইরে থেকে আপনাকে স্যাণ্ডউইচ কাটতে দেখে থাকে তবে তারা কি মনে করতে পারত?
তারা মনে করত আমি পিকনিক লাঞ্চ তৈরী করছি।
খাবারটা যে আপনি ভাগ করে খাবেন সে কথা কি তাদের পক্ষে জানা সম্ভব হত?
না, ওদের দুজনকে ডাকার কথাটা মাথায় যখন এল তখন দেখলাম প্লেটের ওপর অনেক স্যাণ্ডউইচ জমে গেছে।
তাহলে কেউ যদি আপনার অনুপস্থিতিতে ওখানে ঢুকে স্যাণ্ডউইচে বিষ মিশিয়ে দেয়, তবে তার মানে যে তারা আপনাকে বিষ দিতে চেয়েছিল?
আমার তো তাই মনে হয়।
যখন আপনারা তিনজনে বাড়িতে ফিরলেন, কি হল?
আমরা চা খাওয়ার ঘরে গেলাম, তারপর আমি স্যাণ্ডউইচ এনে ওদের দুজনকে দিলাম।
ওদের সঙ্গে আপনিও কি কিছু পান করেছিলেন?
আমি জল খেয়েছিলাম। টেবিলে বিয়ার ছিল, তবে নার্স আর মেরী চা খেতে চাইল। পাশের ঘরে গিয়ে তৈরী করে ট্রে সাজিয়ে নিয়ে এলেন নার্স হপকিন্স। মেরী চা ঢালল।
তারপর কি হল?
নার্স হপকিন্স গিয়ে গ্যাস বন্ধ করে এলেন।
তারপর?
কয়েক মিনিট পরে আমি ট্রে আর স্যাণ্ডউইচের প্লেটটা তুলে নিয়ে চলে গেলাম পাশের ঘরে। নার্স হপকিন্স ওখানে ছিলেন দুজনে মিলে ধুয়ে ফেললাম।
ওর কব্জির ছড়ে যাবার দাগ সম্বন্ধে কিছু বলেছিলেন কি আপনি?
আমি জানতে চেয়েছিলাম কি করে খোঁচা লাগল?
উনি বললেন, আউটহাউসের বাইরে একটা গোলাপ গাছের কাঁটা ঢুকে গেছে, এখুনি বের করে নেব।
সে সময় তার ভাবভঙ্গী কেমন ছিল?
আমার মনে হয় ওঁর খুব গরম লাগছিল, কারণ ঘাম দেখা যাচ্ছিল, মুখেরও রং অদ্ভুত।
তারপর?
আমরা ওপরে গেলাম, উনি আমাকে জিনিষপত্র গোছাতে সাহায্য করলেন।
কখন আবার আপনারা নীচে এলেন?
প্রায় একটা তো বটেই।
মেরী জেরার্ড কোথায় ছিল?
চা খাবার ঘরে বসেছিল। খুব জোরে শ্বাস নিচ্ছিল আর আচ্ছান্নের মত হয়েছিল, আমি ডাক্তারকে নার্সের কথামত ফোন করলাম। মেরী মারা যাবার একটু আগে ডাক্তার এসেছিলেন।
কাঁধ দুটো উঁচু করে এডুইল নাটকীয়ভাবে প্রশ্ন করলেন, মিস কার্লিসল, আপনি কি মেরী জেরার্ডকে খুন করেছেন?
না।
.
৩.৩.৩
স্যার স্যামুয়েল অ্যাটেনবেরী এবার উঠলেন আসামীকে জেরা করতে। এলিনর বুঝলো এবার তাকে এমন কিছু প্রশ্ন তিনি করবেন যার উত্তর তাকে শেখানো যায়নি।
আপনি বলছেন যে, মিঃ রডারিক ওয়েলম্যানের সঙ্গে আপনার বিয়ের কথা পাকা, মোটামুটি স্থির ছিল?
হা।
আপনি তাকে পছন্দ করতেন?
খুব পছন্দ করতাম।
আমি বলছি, আপনি রডারিক ওয়েলম্যানকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন এবং মেরী জেরার্ডকে ওয়েলম্যান ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন বলে আপনি হিংসেতে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন?
না (কথাটা বলল একটু উম্মার সঙ্গে) ক্রুর ভঙ্গীতে স্যার স্যামুয়েল বললেন, আমি বলছি, রডারিক ওয়লম্যানকে ফিরে পাবার জন্য আপনি সুপরিকল্পিতভাবে মেরীকে পথ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
একেবারেই নয়। (হতাশার সুর, একটু ক্লান্ত)। প্রশ্নের পর প্রশ্ন…স্বপ্নের মত..দুঃস্বপ্ন অবশ্যই…রাতের বিভীষিকা যেন…। প্রশ্নের বন্যা বইতে লাগল…তীক্ষ্ণভাবে বিদ্ধ করার মতো প্রশ্ন..কতকগুলো প্রশ্ন বিভ্রান্তিকর। নিজের ভূমিকা সম্পর্কে সদা সচেতন, ভুল করেও যেন বলে না ফেলে, হ্যাঁ, আমি ওর মৃত্যু কামনা করেছিলাম…হা স্যাণ্ডউইচ কাটার সময় আমি কেবলই ওর মৃত্যুর কথা চিন্তা করছিলাম…।
শান্ত থাকতে হবে, এবং যতটা সম্ভব সংক্ষেপে উত্তর দিতে হবে।
শান্ত, মোলায়েম গলায় স্যার এডুইন আরো গোটাকতক প্রশ্ন করলেন, জেরার ফলে তার সম্বন্ধে যে ভুল ধারাণার সৃষ্টি করানো হয়েছিল সেগুলোর সংশোধন করার জন্য। কাঠগড়া থেকে নেমে আবার আসামীর ডকে গিয়ে ঢুকল এলিনর, জুরীদের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল…এরপর।
.
৩.৩.৪
ঐ তো রডি..রডি পিটপিট করছে পুরো ব্যাপারটাই তার অপছন্দ হচ্ছে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। কেমন যেন অবাস্তব মনে হচ্ছে তাকে। গোটা দুনিয়াটা তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।…যেন আমি এলিনর কার্লিসল নই…আমি একজন আসামী। ওরা আমায় ফাঁসিই দিক, বা ছেড়েই দিক আগের মতো আর হবে না।…একটা কিছু যদি থাকত, একটা কিছু অবলম্বন করার মতো…।
আপনার প্রতি মিস কার্লিসলের মনোভাব কেমন ছিল?
বরং আমি বলব, ও আমাকে খুব চাইত, কিন্তু আত্মহারা
আপনাদের বিয়ের যে এনগেজমেন্ট ছিল, সেটা আপনার
ওহ, নিশ্চয়ই। আমাদের বহু বিষয়ে মিল ছিল।
মিঃ ওয়েলম্যান, দয়া করে জুরীদের বলুন কেন আপনাদের বিয়ে ভেঙ্গে গেল।
দেখুন, মিসেস ওয়েলম্যান মারা যাবার পর আমরা খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম। নিজের অবস্থা কপর্দকশূন্য, তাই বড়লোক মহিলাকে বিয়ে করাটা আমার খুব ভালো লাগছিল না। সত্যি কথা বলতে কি আমাদের এনগেজমেন্ট বাতিল করেছিলাম দুজনেই একমত হয়। এবং আমরা দুজনেই যেন মুক্তি পেয়েছিলাম।
মেরী জেরার্ডের সঙ্গে আপনার কিরকম সম্পর্ক ছিল?
ওকে আমার খুব সুন্দর লাগতো।
আপনি কি ওকে ভালোবাসতেন?
সামান্য একটু।
শেষ কবে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আপনার?
দাঁড়ান ভেবে দেখি। ৫ই বা ৬ই জুলাই হবে।
ইস্পাতের শান গলায় নিয়ে স্যার এডুইন প্রশ্ন করেলন, আমার ধারণা তারপরেও মেরীর সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল।
না, আমি বাইরে চলে গিয়েছিলাম–ভেনিসে, ডালমেশিয়ায়।
কবে ইংল্যাণ্ডে ফিরলেন?
একটা টেলিগ্রাম পেয়ে দাঁড়ান বলছি..যতদূর মনে পড়ছে ১লা আগস্ট।
কিন্তু আসলে আপনি ২৭শে জুলাইতে ইংল্যাণ্ডে ছিলেন।
না।
দেখুন মিঃ ওয়েলম্যান আপনার পাশপোর্ট থেকে দেখা যাচ্ছে যে আপনি ২৫শে জুলাই ইংল্যাণ্ডে ফিরে আবার ২৭শে জুলাই চলে যান, কথাটা কি ঠিক নয়।
রডারিকের মুখ শুকিয়ে গেছে, কয়েক মিনিট চুপ করে থাকার পর টেনে টেনে বলল, হ্যাঁ, মানে কথাটা ঠিক।
২৫ তারিখে লণ্ডনে আপনি মেরী জেরার্ডের বাসায় ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন?
হা গিয়েছিলাম।
আপনি কি ওকে বিয়ে করার কথা বলেছিলেন, মেরী কি উত্তর দিয়েছিল?
হ্যাঁ, ও রাজী হয়নি।
আপনি কি জানতেন না যে, এলিনর কার্লিসল মারা গেলে তার সব সম্পত্তি আপনি পাবেন?
কথাটা এই প্রথন শুনছি।
২৭শে জুলাই সকালবেলায় আপনি কি মেডেনফোর্ডে ছিলেন?
ছিলাম না।
স্যার এডুইনের পর উঠলেন সরকারী উকিল–
আপনি বলছেন আপনার অনুমান যে আসামী আপনাকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন না।
কথাটা আমিই বলেছি।
মিঃ ওয়েলম্যান আপনি কি উদার হৃদয়সম্পন্ন প্রেমিক? যদি কোন মহিলা আপনাকে ভীষণ ভালোবাসেন অথচ আপনি তাকে ভালবাসেন না, তবে কি আপনার মনোভাব মহিলার কাছে গোপন রাখবেন?
নিশ্চয়ই না।
.
৩.৩.৫
আপনি কি গোলাপ ফুলের চাষ করেন মিঃ আলফ্রেড ওয়ারগ্রেভ?
হ্যাঁ।
আপনি কি গত ২০ শে অক্টোবর মেডেনসফোর্ডে গিয়ে হান্টারবেরী হলের আউট হাউসে একটা গোলাপগাছ পরীক্ষা করেছিলেন?
হা।
ঐ গাছটার একটু বর্ণনা দেবেন?
গাছটা লতান গোলাপ, জেফিররাইন দ্রুহিন। মিষ্টি গন্ধওয়ালা গোলাপী ফুল হয়। কাটা হয় না।
.
৩.৩.৬
আপনার নাম জেমস আর্থার লিটলভেন। আপনি একজন পাশ করা কেমিস্ট; জেনকিন্স অ্যাণ্ড হেল কোম্পানীতে চাকরী করেন?
হ্যাঁ, করি।
দয়া করে বলবেন কি এই কাগজের টুকরোটা কিসের?
একজিবিটটা সাক্ষীকে দেওয়া হল।
আমাদের একটা ওষুধের লেবেলের টুকরো। হাইপোডারমিক ট্যাবলেটের শিশির গায়ে যে ধরনের লেবেল আমরা লাগাই।
যেটুকু টুকরো দেখছেন তা থেকে কি আপনার পক্ষে বলা সম্ভব, আপনাদের কোন ওষুধের লেবেল এটা?
হ্যাঁ, বিনা দ্বিধায় বলতে পারে এই লেবেলটা অ্যাপোমরফিন হাইড্রোক্লোরাইড ১/২০ গ্রেন-এর হাইপোডারমিক ট্যাবলেটের শিশির।
মরফিন হাইড্রোক্লোরাইডের নয় তো?
না, তা হতেই পারে না।
কেন নয়?
এধরনের শিশিতে মরফিন কথাটার এম অক্ষরটা বড় হাতের লেখা থাকে। এখানে মরফিনের এম অক্ষরটি দেখা যাচ্ছে ছোট হাতের লেখা। ম্যাগনিফায়িং গ্লাস দিয়ে দেখলে পরিষ্কার দেখা যাবে।
দয়া করে জুরীদের ওটা দেখতে দিন, ওঁরা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখবেন, আপনি যা বলছেন তার প্রমাণ হিসাবে ঐ ধরনের লেবেল সঙ্গে এনেছেন কি?
জুরীদের হাতে তুলে দেওয়া হল এই ধরনের লেবেল, আপনি বলেছেন এটা অ্যাপোমরফিন হাইড্রোক্লোরাইডের শিশির লেবেল? অ্যাপোমরফিন হাইড্রোক্লোরাইড জিনিষটা আসলে কি?
এর ফর্মুলা হল সি ১৭ এইচ ১৭ এন, ও ২, সীল করা শিশির মধ্যে হাইড্রোক্লোরাইড অ্যাসিডের মিশ্রণের দ্বারা মরফিনকে ঘীনভূত করে যে মরফিন তৈরী হয়, এটা তারই একটি বিশিষ্ট রূপ। মরফিন থেকে এক অণু জল শুকিয়ে যায়।
অ্যাপোমরফিনের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধর্মগুলি কি কি?
পরিচিত সবরকম ওষুধের মধ্যে অ্যাপোমরফিন হল দ্রুত শক্তিশালী বমি করাবার ওষুধ। দু-এক মিনিটের মধ্যে কাজ শুরু করে দেয়।
তাহলে কেউ যদি মরফিনের প্রাণঘাতী ডোজ খেয়ে থাকে এবং তার কয়েক মিনিটের মধ্যে এক ডোজ অ্যাপোমরফিন ইনজেকশন দেওয়া যায় তবে তার কি ফল হবে?
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বমি হবে এবং মরফিন বমির সঙ্গে বেরিয়ে যাবে পেট থেকে।
অতএব যদি দুজন মানুষ একই স্যাণ্ডউইচ খেয়ে থাকে বা একই কেটলী থেকে চা খেয়ে থাকে, এবং তাদের একজনকে যদি অ্যাপোমরফিন ইনজেকশন দেওয়া হয়, তাহলে কি ফল হবে, ধরে নেওয়া যাক যে স্যাণ্ডউইচ বা চায়ে মরফিন মেশানো ছিল।
যাকে ঐ ইনজেকশন দেওয়া হবে তার পেট থেকে মরফিন সমেত যা খেয়েছে তা বমি হয়ে উঠে আসবে।
এবং তার বিশেষ কোন ক্ষতি হবে না?
না।
হঠাৎ আদালতে চাপা উত্তেজনা দেখা দিল। জজ সবাইকে শান্ত হবার জন্য হুকুম দিলেন।
.
৩.৩.৭
আপনার নাম আমেলিয়া মেরী সেডলি এবং আপনি ১৭ চার্লস স্ট্রীট, বুনাম্বা, অকল্যাণ্ডে থাকেন?
হা।
মিসেস ড্রোপার নামের কাউকে চেনেন?
হ্যাঁ, প্রায় কুড়ি বছর ধরে তাকে চিনি আমি।
তার বিয়ের আগের কুমারী নামটা জানেন কি?
হা, ওর বিয়েতে ছিলাম আমি, ওর নাম ছিল মেরী রাইলি?
তিনি কি নিউজিল্যাণ্ডের অধিবাসী?
না, ও ইংল্যাণ্ড থেকে এসেছিল।
এই মামলা শুরু হবার প্রথম দিন থেকে তো আপনি কোর্টে আসছেন?
হা।
এই মেরী রাইলি–বা ড্রেপারকে আপনি কোর্টে দেখেছেন?
হা।
কোথায় দেখেছেন তাকে?
সাক্ষীর কাঠগড়ায়।
কোন নামে?
জেসি হপকিন্স।
আর এ বিষয়ে আপনি নিঃসন্দেহ যে এই জেসি হপকিন্স হলেন সেই মহিলা যাকে আপনি মেরী রাইলি বা ড্রোপার নামে চেনেন?
আদৌ সন্দেহ নেই।
এর আগে শেষ কবে আপনি মেরী ড্রেপারকে দেখেছিলেন?
পাঁচ বছর আগে, যখন সে ইংল্যাণ্ডে ফিরে যায়।
মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানিয়ে স্যার এডুইন স্যার স্যামুয়েলকে বললেন, এবার উনি আপনার সাক্ষী।
স্যার স্যামুয়েল বিব্রত মুখে বলে উঠলেন, মিসেস সেডলি, আমি বলছি আপনি হয়তো ভুল করছেন।
আমার কোন ভুল হয়নি।
চেহারার মিল থাকায় আপনার ভুল হওয়া সম্ভব।
আমি মেরী ড্রেপারকে খুব ভালোভাবে চিনি। নার্স হপকিন্স একজন পাশ করা জেলা নার্স।
মেরী ড্রেপার বিয়ের আগে হাসপাতালের নার্স ছিল।
আপনি বুঝতে পারছেন কি যে একজন সরকারী সাক্ষীর বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষ্য দেবার অভিযোগ করছেন আপনি?
আমি যা বলছি, বুঝেসুঝেই বলছি।
.
৩.৩.৮
এডওয়ার্ড জন মার্শাল আপনি বেশ কয়েকবছর নিউজিল্যাণ্ডের থাকার পর সম্প্রতি ১৪নং রেন স্ট্রীট, ভেন্টফোর্ডে বাস করছেন?
হা।
আপনি মেরী ড্রেপারকে চেনেন কি?
নিউজিল্যাণ্ডে বহু বছর ধরে আমরা পরস্পরকে চিনতাম।
ওঁকে কি আজ আপনি আদালতে দেখেছেন?
দেখেছি। উনি নিজের নাম বললেন, জেসি হপকিন্স, অথচ উনি যে মিসেস ড্রেপার তাতে কোন সন্দেহ নেই।
জজ মাথা তুললেন, সুস্পষ্ট অথচ শান্ত গলায় বললেন, আমার মনে হয়, সাক্ষী জেসি হপকিন্সকে আবার ডাকাটাই ঠিক হবে।
কারুর মুখে কথা নেই, মৃদু গুঞ্জন…মাই লর্ড জেসি হপকিন্স কয়েক মিনিট আগে আদালত ছেড়ে চলে গেছেন।
.
৩.৩.৯
কাঠগড়ায় উঠলেন এরকুল পোয়ারো।
মঁসিয়ে পোয়ারো এই কাগজটা আপনি চিনতে পারছেন?
নিশ্চয়ই।
কিভাবে এটা আপনার হাতে আসে?
জেলা নার্স মিসেস হপকিন্স আমাকে দিয়েছিলেন।
স্যার এডুইন বললেন, আপনার অনুমতি নিয়ে মাই লর্ড আমি এই কাগজটা জোরে জোরে পড়ব, তারপর জুরীদের দেব।
.
৩.৪.১
আসামী পক্ষের শেষ সওয়াল :
জুরী মহোদয়গণ, এবার দায়দায়িত্ব সব আপনাদের, এলিনর কার্লিসল মুক্তি পাবে কি পাবে না, সেটা আপনারই বলবেন। সব সাক্ষ্যপ্রমাণ শোনার পর যদি মনে করেন এলিনর কার্লিসল মেরী জেরার্ডকে বিষ দিয়েছিল, তবে তাকে আপনারা দোষী সাব্যস্ত করবেন।
কিন্তু যদি মনে করেন যে অন্য কারুর বিরুদ্ধে সমপরিমাণ প্রমাণ আছে, এবং সম্ভবত অনেক বেশী জোরদার প্রমাণ সেটা, তবে আদৌ দ্বিধা করবেন না মিস কার্লির্সলকে মুক্তি দিতে। এতদিন আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে গোড়ার দিকে ঘটনাটা যা মনে হয়েছিল এখন তা আর মনে হচ্ছে না।
গতকাল এরকুল পোয়ারার নাটকীয় সাক্ষ্যের পর আমি অন্য সাক্ষীদের ডেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে সমর্থ হয়েছি যে এই মেয়েটি, মেরী জেরার্ড আসলে লরা ওয়েলম্যানের অবৈধ কন্যা। এবং কথাটা সত্যি বলে, স্বভাবতই অনুমান করা যেতে পারে, এবং মহামান্য জজসাহেব নিশ্চয়ই আমাদের সেইমত বলবেনও যে মিসেস ওয়েলম্যানের নিকটতম আত্মীয় তার বোনঝি এলিনর কার্লিসল নয়, বরং তার অবৈধ কন্যাসন্তান মেরী জেরার্ড। এবং মিসেস ওয়েলম্যানের মৃত্যুতে তার বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়েছিল মেরী জেরার্ড। জুরী মহোদয়গণ এটাই হল সমগ্র পরিস্থিতির সারমর্ম। প্রায় ২ লক্ষ পাউণ্ডের সম্পত্তির মালিক হয়েছিল মেরী জেরার্ড। কিন্তু একথা সে নিজে অবহিত ছিল না। এমনকি মিসেস হপকিন্সের পরিচয়ও সে জানতো না। আপনারা হয়তো মনে করতে পারেন যে মেরী রাইলি বা মিসেস ড্রেপারের যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণ থেকে থাকতে পারে নিজের নাম হপকিন্স পাল্টে নেবার। যদি তাই হয়, তবে সেই কারণটা উনি জানালেন না কেন?
আমরা যেটুকু জেনেছি তা হল: নার্স হপকিন্সের প্ররোচনায় মেরী জেরার্ড উইল করে এবং তার যাবতীয় সম্পত্তি এলিজা রাইলিকে দিয়ে যায়। আমরা এও জানি যে, নিজের পেশার দিক দিয়ে মরফিন ও আপোমরফিন সহজেই পেতে পারেন এবং কোন ওষুধের কি গুণ সেটা তিনি ভালোভাবেই জানেন। তাছাড়া এটাও প্রমাণিত হয়েছে, যে নার্স হপকিন্স মিথ্যা সাক্ষ্যও দিয়েছেন, যখন তিনি বলেছেন কাটাহীন গোলাপ গাছের কাঁটাও তার কব্জিতে দাগ হয়েছে। ইনজেকশনের সঁচের দাগটার জন্য একটা অজুহাত দেখাতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে ঐ মিথ্যে কথাটা বলে ফেলেছেন উনি। একথা মনে রাখবেন যে, শপথ নিয়ে সাক্ষ্য দেবার সময় আমার বলেছিলেন যে, নার্স হপকিন্স যখন ভাড়ার ঘরে বাসনপত্র ধোবার জন্য তার কাছে এসেছিলেন তখন নার্সকে করুণ, অসুস্থ লাগছিল–পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল একটু আগে যেন তিনি খুব অসুস্থ হয়েছিলেন।
আর একটা বিষয়ের উপর জোর দিতে চাই–যদি মিসেস ওয়েলম্যান আরও ২৪ ঘণ্টা বাঁচতেন তবে তিনি নিশ্চয়ই উইল করতেন এবং খুব সম্ভব মেরী জেরার্ডের জন্য উপযুক্ত বন্দোবস্ত করতেন। তবে প্রচুর সম্পত্তি নিশ্চয়ই দিতেন না, কারণ মিসেস ওয়েলম্যান নিশ্চয়ই চাইতেন যে তার পরিচয় না দেওয়া মেয়েটি নিজের জগতে নিজস্ব পরিচয় নিয়েই সুখে থাক।
অপর এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই, শুধু বলতে চাই যে ঐ অপর ব্যক্তিটিরও সমান সুযোগ ছিল এবং খুন করার উদ্দেশ্য আরও গভীর ছিল।
এই দৃষ্টিকোণ দিয়ে বিচার করলে জুরী মহোদয়গণ, আপনাদের কাছে নিবেদন করছি যে মিস এলিনর কার্লিসলের বিরুদ্ধে অভিযোগ নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে…।
.
৩.৪.২
জুরীদের মামলার বিষয় বোঝাতে গিয়ে মিঃ জাস্টিস বেডিংফিল্ড বললেন,…নিজেদের যুক্তি বিচারে আপনাদের নিঃসন্দেহ হতে হবে যে প্রকৃতপক্ষে এই আসামীই ২৭শে জুলাই তারিখে মেরী জেরার্ডকে বিপজ্জনক ডোজের মরফিয়া খাইয়ে দিয়েছিল। যদি সম্পূর্ণভাবে নিঃসন্দেহ না হন তবে আসামীকে মুক্তি দেবেন।
সরকারী পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে মেরী জেরার্ডকে বিষ দিতে পারার সুযোগ একমাত্র ছিল আসামীরই। আসামী পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয়েছে বিকল্প প্রমাণ করার। মেরী জেরার্ডের আত্মহত্যার তত্ত্বও উপস্থাপিত হয়েছে, এবং এই তত্ত্বের সমর্থনে প্রমাণ হিসাবে বলা হয়েছে মারা যাবার অনতিকাল আগে মেরী জেরার্ড উইল করেছিল। তবে সে যে নিজের সম্বন্ধে বীতশ্রদ্ধ হয়েছিল, বা তার মনে কোন অশান্তি ছিল সে সম্বন্ধে আদৌ কোন প্রমাণ নেই। এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, এলিনর কার্লির্সল যখন আউট হাউস থেকে মেরীদের ডাকতে গিয়েছিল, সেই অবসরে ভাড়ার ঘরে ঢুকে স্যাণ্ডউইচে মরফিন মিশিয়ে দিয়েছে। তা যদি সত্য হয় তবে উদ্দেশ্য ছিল এলিনর কার্লির্সলকে খুন করা, ভুলবশতঃ মেরী জেরার্ড সেটা খেয়ে মারা গেছে। তৃতীয় বিকল্পটি হল এই যে, মরফিন মেশাবার সুযোগ আর একজনেরও ছিল, এবং সেটা মেশানো হয়েছিলো চায়ের সঙ্গে, স্যাণ্ডউইচে নয়। এই তত্ত্বের সমর্থনে আসামীপক্ষ থেকে সাক্ষী হিসাবে ডাকা হয়েছে মিঃ লিটনডেনকে, তিনি শপথ গ্রহণ করে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে ভঁড়ার ঘরের মেঝেতে ফাটলে যে লেবেলের টুকরো পাওয়া গেছে সেটা মরফিনের, যা হল বমি করার জোরালো ওষুধ। দুধরনের লেবেলের নমুনা আপনাদের দেখানো হয়েছে। আমার মতে লেবেলের বাকী অংশটুকু খোঁজার চেষ্টা না করে এবং তাড়াতাড়ি ওটা যে মরফিনের লেবেল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে পুলিশ মাত্রাতিরিক্ত অসাবধানতার দোষে দোষী।
সাক্ষী হপকিন্স বলেছে যে আউট হাউসের গোলাপ গাছের কাঁটা ফুটেছিল তার কব্জিতে। সাক্ষী ওয়াদ্রেভ গাছটাকে পরীক্ষা করে অভিমত দিয়েছেন ঐ ধরনের গাছে কাটা হয় না। আপনারাই সিদ্ধান্ত নেবেন নার্স হপকিন্সের কব্জিতে দাগ কেন হয়েছিল এবং কেনই বা সে মিথ্যা করা বলবে…
যদি সরকারী পক্ষ আপনাদের মনে বিশ্বাস জন্মাতে সক্ষম হয়ে থাকেন যে আসামী ছাড়া কারুর পক্ষে এই অপরাধ করা সম্ভব নয়, তবে আপনারা আসামীকে দোষী সাব্যস্ত করবেন।
যদি আসামীপক্ষের উপস্থাপিত বিকল্প তত্ত্বটিকে আপনারা যুক্তিযুক্ত মনে করেন এবং সাক্ষ্যপ্রমাণের সঙ্গে তার সঙ্গতি খুঁজে পান, তবে আসামীকে রেহাই দিতে হবে।
আপনাদের যেসব প্রমাণ পেশ করা হয়েছে শুধু তারই ভিত্তিতে সাহস, ধৈর্য্যের এবং সুচিতার সাহায্যে আপনারা আপনাদের অভিমত দেবেন এটাই আমার অনুরোধ।
.
৩.৪.৩
এলিনরকে আবার আদালতে আনা হলো। জুরীরা যথাস্থানে সার বেঁধে বসলেন।
জুরী মহোদয়গণ, আপনারা আপনাদের সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে ঐক্যমত হয়েছেন কি?
হ্যাঁ।
কাঠগড়ার মধ্যে বসে থাকা আসামীকে দেখুন এবং বলুন যে সে অপরাধী না। নিরপরাধ।
নিরপরাধ।
.
৩.৫.১
পাশের দরজা দিয়ে এলিনরকে ওরা বারের করে আনল। যারা এগিয়ে এসে ওকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল তাদের মুখগুলো এলিনরের চেনা..রডি…বড় গোঁফওয়ালা ডিটেকটিভ পোয়ারো..
ও কিন্তু এগিয়ে গেল লর্ডের দিকে।
আমি এখান থেকে বেরোতে চাই…
মসৃণ গতিতে ডেমলার ছুটে চলেছে লণ্ডনকে পিছনে ফেলে, গাড়িতে ড. লর্ড আর এলিনর। ডাক্তার একটা কথাও তাকে বলেননি, আশীর্বাদের ধারার মতো এই নিঃশব্দের মধ্যে নিশ্চল হয়ে বসেছিল এলিনর। প্রতিমুহূর্তে এগিয়ে চলেছে…এক নতুন জীবনের দিকে, এটাই ও চাইছিল…এত নতুন জগৎ.হঠাৎ এলিনর বললো, আমি…আমি এমন একটা শান্ত জায়গায় যেতে চাই…যেখানে কোনো চেনামুখ থাকবে না… ।
ধীর গলায় ড. লর্ড বললেন, সব ঠিক করা আছে, আপনাকে একটা স্যাটেরিয়ামে নিয়ে যাচ্ছি। শান্ত জায়গা। সুন্দর বাগান। কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না…। দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলিনর বললো, আমি ঠিক ওটাই চাইছি। ডাক্তার বলেই হয়তো ওর মনের ও শরীরের অবস্থা বুঝে এই বন্দোবস্ত করেছেন, মনে মনে খুশি হলো এলিনর। ক্রমশ এক নিরাপদ দূরত্বে চলে যাচ্ছে সে..ড. লর্ডের থাকায় অনেকটা স্বস্তি আছে যেন। লণ্ডনের শহরতলী পার হয়ে যাচ্ছে তারা। শেষপর্যন্ত কথা বললো এলিনর, সবটাই আপনার জন্যে..আপনার জন্যে। ড. লর্ড বললেন, পোয়ারোর জন্য। লোকটা যেন জাদু জানে। অবাধ্য মেয়ের মতো এলিনর মাথা নাড়ল, আপনার জন্য। ওঁকে আপনিই জোগাড় করে কাজ করিয়ে নিয়েছেন। পিটার লর্ড একটু হাসলেন, সেটা ঠিক যে ওঁকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে হয়েছে।
আপনি কি বিশ্বাস করতেন আমি করিনি, নাকি আপনার দ্বিধা ছিল?
পুরোপুরি বিশ্বাস কখনই করিনি।
এলিনর বললো, ঠিক এই জন্যেই প্রথম দিকে আমি প্রায় বলে ফেলতে যাচ্ছিলাম, আমি দোষী…কারণ জানেন, কথাটা কিন্তু আমি ভেবে ছিলাম…ঐ নার্সের বাড়ির সামনে যখন আমি হেসেছিলাম ঐ চিন্তাটা আমার মাথায় এসেছিল।
ড. লর্ড বললেন, হ্যাঁ আমি জানতাম।
আশ্চর্য হয়ে এলিনর বললো, এখন খুব অদ্ভুত লাগে…গোপন সম্পদের মত। সেদিন আমি মাহের মণ্ড কিনলাম। স্যাণ্ডউইচ তৈরী করছিলাম, তখন নিজের সঙ্গে ছলনা করে চলেছিলাম আমি…আমার মাথায় ঘুরছিলো একটা কথা : এর সঙ্গে আমি বিষ মিশিয়ে দিয়েছি, ও যখন এটা খাবে, মরবে…আর আমার রডিকে আমি ফিরে পাবো।
ড. লর্ড বললনে, এই ধরনের চিন্তা অনেকে করে। সেটা কিন্তু খুব খারাপ নয়। কল্পনার মধ্যে দিয়ে মনের ভার লাঘব করে নেওয়া যায়।
এলিনর বললো, হ্যাঁ, ঠিক তাই। কারণ তারপরই আমার মনের কালিমা মুছে গিয়েছিল। ঐ নার্সটা যখন আউট হাউসের গোলাপ গাছের কথা বললো, তখনই আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলাম, মনের নীচতাবোধ মুহূর্তে উবে গেল। তারপর একটু কেঁপে উঠে বলো, পরে যখন আমি সকালের চা খাওয়ার ঘরে গিয়ে দেখলাম ও মারা যাচ্ছে, তখন আমার মনে হয়েছিল খুন করার চিন্তা করা আর সত্যি সত্যিই খুন করার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য আছে কি?
প্রচুর পার্থক্য আছে। খুন করার চিন্তা করলে কারুর কোন ক্ষতি হয় না। লোকে অবশ্য উল্টোপাল্টা নানা কথা বলে।…বলে খুনের চিন্তা করা আর খুন করা একই জিনিষ। আসলে তা নয়। অনেকক্ষণ ধরে খুন করার চিন্তা থাকলেও হঠাৎ মনোভাবে দ্রুত পরিবর্তনও আসতে পারে। মনে হয় এতক্ষণ কি যা তা ভাবছিলাম।
এলিনর কান্নার সুরে বললো, আপনি শুধু ভালো ভালো কথা বলে আশ্বাস দিচ্ছেন।
অসংলগ্ন ভাবে ড. লর্ড বললেন, আদৌ নয়…শুধু সাধারণ বুদ্ধি…হঠাৎ এলিনরের চোখ জলে ভরে উঠলো, আদালতে ঘুরে ফিরে বার বার আমি আপনাকে দেখেছি। মনে সাহস পেতাম। আপনাকে দেখতে…খুব সাধারণ লাগতো…।
জোরে হেসে উঠে আবার বললো, কথাটা খুব অভদ্রের মতো বললাম।
ড. লর্ড বললেন, আমি বুঝতে পারছি, মানুষ যখন কোন বিভীষিকার মধ্যে পড়ে তখন সাধারণ মানুষকেই সে চায় আশ্রয় হিসাবে। আরও কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি থামলো পাহাড়ের কোলে একটা সুন্দর ছোটো সাদা রঙের বাড়ির সামনে, ড. লর্ড বললেন, এখানে খুব নিরাপদে থাকবেন আপনি, কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না।
এক অজানা চাপা উচ্ছ্বাসে এলিনর হাত রাখলেন ড. লর্ডের হাতের ওপর, বললো, আপনি..আপনি আসবেন তত আমার সঙ্গে দেখা করতে?
নিশ্চয়ই।
প্রায়ই আসবেন তো?
আপনি যেমনটি চাইবেন, ড. লর্ড বললেন।
আসবেন নিশ্চয়ই…প্রায়ই আসবেন।
.
৩.৬.১
এরকুল পোয়ারো বললেন, তাহলে দেখছেন তো বন্ধু, মানুষ যে-সব মিথ্যে কথা বলে সেগুলো সত্যি কথার মতোই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে?
ড. লর্ড বললেন, সকলেই কি আপনার কাছে মিথ্যে কথা বলছে?
হ্যাঁ। কেননা কোন কারণে, বুঝতে পারছেন তো, যে মানুষটির কাছে সত্যি কথাটা বলা ছিল একটা গুরুদায়িত্ব এবং এ ব্যাপার যে ছিল স্পর্শকাতর আর খুঁতখুঁতে–সেই মানুষটি আমাকে খাইয়ে ছিল সবচেয়ে বেশি।
ড. লর্ড অস্ফুট স্বরে বললেন, এলিনর নিজে, তাই না?
ঠিক তাই। প্রমাণগুলো বলে দিচ্ছিল ওই দোষী। আর সে নিজেও তার স্পর্শকাতর মন আর অত্যন্ত খুঁতখুঁতে বিবেক নিয়ে ঐ অনুমানকে নস্যাৎ করার কোন চেষ্টাই করেনি। প্রকৃত কাজটা না করলেও, খুনের চিন্তা করেছিল এই অপরাধবোধেই সে তাই নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করে নিতে চলেছিল, যে অপরাধ সে আদৌ করেনি। দীর্ঘশ্বাস চেপে ড. লর্ড বললেন, অবিশ্বাস্য।
পোয়ারো মাথা নাড়লেন, আদৌ নয়। সে নিজেকেই দোষী বলে মনে করেছিল, সাধারণ মানুষের চিন্তাশক্তির মাপকাঠি দিয়ে নয়, আরও উচ্চস্তরের মানবিকতার মাপকাঠি দিয়ে।
ড. লর্ড বললেন, হ্যাঁ, উনি ঐ ধরনেরই মহিলা।
এরকুল পোয়ারো বললেন, তদন্ত শুরু করার প্রথম থেকেই এলিনর কার্লিসলই যে অপরাধী তার নানা জোরালো প্রমাণ পাচ্ছিলাম। কিন্তু আপনার প্রতি আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি, আমি দেখলাম অন্য আরেক জনের বিরুদ্ধেও জোরালো কেস পাওয়া যাচ্ছে।
নার্স হপকিন্স?
না, প্রথমে তা ছিল না। আমার নজর প্রথমে পড়েছিল রডারিকওয়েলম্যানের ওপর। তার ব্যাপারেও অবশ্য আমাকে প্রথমে একটা মিথ্যে দিয়ে শুরু করতে হয়েছিল। ও আমাকে বলেছিল ৯ই জুলাই ইংল্যাণ্ড ছেড়ে যায়। ফেরে ১লা আগস্ট। কিন্তু কথায় কথায় নার্স হপকিন্স আমাকে বলেছিল যে মেরী জেরার্ড রডারিককে একবার মেডেনসফোর্ডে এবং আর একবার যখন ও মেরীর সঙ্গে লণ্ডনে দেখা করেছিল তখন রডারিককে বেশি ঘনিষ্ঠতা দেখানোর জন্য কড়া কথা শুনিয়েছিল। আপনি আমায় বলেছিলেন যে মেরী লণ্ডনে যায় ১০ জুলাই। অর্থাৎ রডারিক ইংল্যাণ্ড ছাড়ার একদিন পরে। তাহলে কবে লণ্ডনে মেরীর সঙ্গে রডারিকের দেখা হল? আমার যে সিঁধিলে চোর বন্ধু আছে,তার শরণাপন্ন হলাম, রডারিকের পাশপোর্ট দেখতে হবে। দেখা গেল যে, সে ইংল্যাণ্ডে ফিরে এসেছিল, ২৫ থেকে ২৭ শে জুলাই পর্যন্ত ছিল। এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই মিথ্যে কথা বলেছে ও।
ভাঁড়ার ঘরে প্লেটে স্যাণ্ডউইচ রেখে এলিনর মেরীদের ডাকতে গেল আউট হাউসে–ঐ সময়টুকুর কথা আমার মনে ভীষণভাবে দাগ কেটেছিল। কিন্তু তাতে এই ধারণাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, যদি ঐ সময়ের মধ্যে বিষ মেশানো হয়ে থাকে তবে হত্যাকরীর লক্ষ্য ছিল এলিনর, মেরী জেরার্ড নয়। এলিনর কার্লিসলকে হত্যা করার কোন উদ্দেশ্য ছিল কি রডারিকের? হ্যাঁ, খুব সঙ্গত কারণ ছিল। এলিনর তার উইলে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করেছিল রডারিক ওয়েলম্যানকে। এবং খুঁটিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম ঐ ব্যাপারটা জেনে ফেলার পুরো সুযোগ রডারিকের ছিল।
ড. লর্ড বললেন, তবে কেন আপনি ধরে নিলেন যে ও নিরপরাধ?
আর একটা মিথ্যা কথার জন্যে। খুব বোকার মতো একটা মিথ্যে কথার জন্যে, নার্স হপকিন্স বলেছিল গোলাপের কাটাতে তার কব্জি ছড়েছে। আমি নিজে গিয়ে গাছটা দেখলাম…ওতে কোন কাটাই ছিল না।…স্পষ্ট বোঝা গেল নার্স হপকিন্স মিথ্যে কথা বলছে। আর মিথ্যেটা এতই বাজে ভাবে ধরা পড়ে গেল যে ওর ওপর আমার সন্দেহ শুরু হয়ে গেল।
নার্স হপকিন্সকে নিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম আমি। তার আগে পর্যন্ত ওকে আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য সত্যবাদী সাক্ষী মনে হয়েছিল। মেরীর প্রতি ওর প্রচণ্ড স্নেহ-ভালোবাসার মধ্যেই যে ও এলিনরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছিল–এটাই আমার ধারণা হয়েছিল। কিন্তু ঐ মিথ্যে কথাটা ধরা পড়ার পর থেকে ওর প্রতিটি কথার বিচার করতে শুরু করলাম। এবং দেখলাম এমন কিছু একটা আছে যা আমার বিদ্যেবুদ্ধি ধরতে পারেনি। নার্স হপকিন্স মেরী জেরার্ড সম্বন্ধে এমন কিছু একটা জানে, এবং সেটা যাতে জানাজানি হয়ে যায় তার জন্যে সে সচেষ্ট।
চমকে গিয়ে ড. লর্ড বললেন, আমি তো উল্টোটাই ভেবেছিলাম।
বাইরে থেকে তাই মনে হবে। এমন অভিনয় করছিল যেন সে জানে কিন্তু কিছুতেই বলতে চাইছে না। কিন্তু ওর কথাগুলো বারবার চিন্তা করে দেখলাম যে কটা কথা ও উচ্চারণ করেছে বা বলেছে ওর উদ্দেশ্য ছিল তার উল্টোটা বলার, প্রকাশ করার। নার্স ও’ব্রায়ানের সঙ্গে কথা বলার পর আমার সন্দেহ পাকা হল, হপকিন্স খুব চালাকি করে ও’ব্রায়ানকে না জানিয়ে কাজটা হাসিল করে নিল।
তখন ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো যে নার্স হপকিন্স নিজের চাল চেলে যাচ্ছে। রডারিক আর হপকিন্স, দুজনের মিথ্যে কথাগুলো ওজন করতে শুরু করলাম। এর সরল ব্যাখ্যা দুজনের মধ্যে কে দেবে?
রডারিক-এর ব্যাপারে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেয়ে গেলাম : বড্ড অভিমানী ভদ্রলোক, ও যে তার প্ল্যানমাফিক বিদেশে সবটা সময়ে কাটায়নি, চুপিসাড়ে এসে মেরীর সঙ্গে দেখা করেছে। হৃদয়ের টানে, এবং কোনরকম প্রশ্রয় পায়নি, এতে তার ব্যক্তিসত্তা অপমানিত হয়েছে তাই ও প্রকাশ্যে স্বীকার করেনি, বলেছিল একেবারে ১লা আগষ্ট ইংল্যাণ্ডে ফিরেছে। তাছাড়া খুন হবার সময় ঘটনাস্থলের ধারে-কাছে ছিল না রডারিক। খুনের কথা কিছু জানতোও না, তাই নিজের দুর্বলতার দিকটাও ঢাকবার জন্যে বেমালুম মিথ্যে বললে।
তারপর আসা যাক নার্স হপকিন্সের কথায়। ওর মিথ্যে কথার সরল ব্যাখ্যা কি হতে পারে? যতো ভাবতে লাগলাম, ততই জটিল হয়ে উঠল ব্যাপারটা, কব্জিতে ক্ষতচিহ্নের জন্যে অমন একটা বাজে মিথ্যে কথা বলার কি দরকার তার? ঐ দাগটার বিশেষত্ব কি?
আমি নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম। চুরি হওয়া মরফিনটা কার ছিল? নার্স হপকিন্সের। মিসেস ওয়েলম্যানকে মরফিন কে দিয়ে থাকতে পারে? নার্স হপকিন্স, বেশ, কিন্তু ওটা পাওয়া যাচ্ছে না এ বিষয়ে সোরগোল তুলল কেন? এর একটাই উত্তর, যদি নার্স হপকিন্স নিজেই অপরাধী হয় তবে, কারণ অপর খুনটা, অর্থাৎ মেরী জেরার্ডের খুনের ব্যাপারটা পরিকল্পনা আগেই হয়ে গেছে, কাকে শিখণ্ডী করা হবে তাও ঠিক হয়ে গেছে। অতএব দেখতে হবে ঐ শিখণ্ডীর পক্ষে মরফিন জোগাড় করা কতটা সম্ভব।
আরও একটা ঘটনা খাপ খেয়ে গেল, এলিনরকে লেখা বেনামী চিঠি। এলিনর ও মেরীর মধ্যে সম্পর্কে চিড় ধরানো। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার-এলিনর চলে আসবে এবং মিসেস ওয়েলম্যানের ওপর তার প্রভাব কমাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু রডারিক ওয়েলম্যান যে পাগলের মত মেরীর প্রেমে পড়ে যাবে, একথা স্বপ্নেও ভাবা যায়নি–কিন্তু ঘটনাটাকে খুব সহজ কাজে লাগিয়ে নিলে নার্স হপকিন্স। এতে অভিসন্ধির ব্যাপারে এলিনরকে শিখণ্ডী করার কাজটা আরও সহজ হয়ে উঠল।
কিন্তু দুটো খুনের কারণ কি? মেরী জেরার্ডকে সরিয়ে ফেলার কথা নার্স হপকিন্স কেন চিন্তা করল? আশার আলো দেখতে পেলাম…তবে তখনও আলোটা খুব ক্ষীণ। মেরীর ওপর নার্স হপকিন্সের প্রচণ্ড প্রভাব ছিল, এবং সেই প্রভাব খাঁটিয়ে মেরীকে দিয়ে ও একটা উইলও করিয়ে নিল। কিন্তু তাতে তো নার্স হপকিন্সের কোন লাভ হচ্ছে না? লাভ হচ্ছিল মেরীর এক মাসির, যে নিউজিল্যাণ্ড থাকে, তখন হঠাৎ মনে পড়ে গেল গ্রামেই কে একজন বলেছিল মেরীর ঐ মাসিও ছিলেন হাসপাতালের নার্স।
তখন আর আলোটা অত ক্ষীণ নয়। অপরাধের পরিকল্পনা…পদ্ধতি ক্রমশঃ সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। পরের ধাপটাও খুব সোজা, নার্স হপকিন্সের সঙ্গে আর একবার দেখা করলাম। নাটকের অভিনয় দুজন ভালোভাবেই করলাম। শেষপর্যন্ত যে কথাটা ও বারবার বলতে চাইছিল সে কথাটাই যেন ওকে দিয়ে জোর করে আমি বলিয়ে নিচ্ছি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। তবে যখন বললে ওর পক্ষে সবচেয়ে ভালো হত, তার চেয়ে একটু আগেই বলে ফেলতে হল কিন্তু এমন সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চাইল না। ফলে প্রচণ্ড অনিচ্ছার ভান করে ঐ চিঠিটা বের করে দিল। বুঝলে বন্ধু তখন আমি আর অনুমানের জগতে রইলাম না। আমি জেনে গেলাম সবকিছু। চিঠিটাই ওকে ধরিয়ে দিল।
ড. লর্ড বললেন কিভাবে?
বন্ধু হে, চিঠির খামের ওপরে লেখা ছিল মেরীকে পাঠাতে হবে আমার মৃত্যুর পর, কিন্তু চিঠির সারমর্ম থেকে জানা যায় মেরী জেরার্ড সত্যি কথাটা জানতো না। তাছাড়া খামের ওপর পাঠাতে হবে (দিতে হবে না) কথাটা অনেক সংকেত বহন করে আনল। চিঠিটা মেরীকে লেখা হয়নি, হয়েছিল অপর একজন মেরীকে। এলিজা রাইলি চিঠি লিখেছিলেন তার বোন মেরী রাইলিকে, যে নিউজিল্যাণ্ডে থাকত।
মেরী জেরার্ডের মৃত্যুর পর নার্স হপকিন্স চিঠিটা আউট হাউস থেকে পায়নি। পেয়েছিল বহু আগে, যখন সে নিউজিল্যাণ্ডে থাকত, ও চিঠিটা ওকে পাঠান হয়েছিল নিউজিল্যাণ্ডে, দিদির মৃত্যুর পর।
মনের চোখ দিয়ে কোন কিছু একবার দেখে নিতে পারলে পরের কাজটা সহজ হয়ে যায়। এরোপ্লেনে সহজে আসা যায় বলে একজন সাক্ষীর পক্ষে সম্ভব হল নিউজিল্যাণ্ড থেকে এসে আদালতে হাজির হওয়া। সে নিউজিল্যাণ্ডে মেরী ড্রেপারকে ভালো ভাবে চিনত।
ড. লর্ড বললেন, ধরুন যদি আপনি ভুল করতেন, নার্স হপকিন্স আর মেরী ড্রেপার যদি সম্পূর্ণ আলাদা দুজন লোক হতো?
পোয়ারো বললেন, আমি কখনও ভুল করি না।
ড. লর্ড হেসে উঠলেন, পোয়ারো বলতে লাগলেন, এখন আমরা এই মহিলা মেরী রাইলি বা ড্রেপার সম্বন্ধে অনেক খবর পেয়েছি। নিউজল্যাণ্ডের পুলিশ ওর বিরুদ্ধে যথেষ্ট সাক্ষীসাবুদ যোগাড় করতে পারেনি, তখন নজর রেখে চলেছিল, তারপর হঠাৎ একদিন মহিলা উধাও হয়ে গেল দেশ ছেড়ে। ওখানে ওর এক বুড়ি রোগী ছিল, যিনি স্নেহের নার্স রাইলিকে মোটামুটি ভালোই সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। যার মারা যাবার ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়। ডাক্তারও খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। মেরী ড্রেপারের স্বামীও ওর নামে মোটা টাকার বীমা করেছিলেন, স্বামীও হঠাৎ মারা যান এবং তার মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যায়নি। দুর্ভাগ্যবশতঃ, স্বামী প্রথম প্রিমিয়ামের চেকটা লিখে রেখেছিলেন, পোস্ট করতে ভুলে গিয়েছিলেন। অন্য মৃত্যুগুলো তার নিজের এক্তিয়ারের মধ্যেই ঘটেছিল। মহিলার কোন অনুশোচনা বা বিবেক বলে কিছু ছিল না।
একথা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে যে চিঠির বিষয়টাকে নিজের কাজে লাগাবার মতো ধূর্ত বুদ্ধির অভাব নার্স হপকিন্সের ছিল না। নিউজিল্যাণ্ডে ওর থাকা ক্রমশঃ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠায়, সে এদেশে চলে এল এবং হপকিন্স এই নাম নিয়ে (ঐ নামে বিদেশে তার এক নার্স সহকর্মী ছিল, যে ওখানেই মারা যান) নিজের পেশার কাজ শুরু করে দিল। তার লক্ষ্য ছিল মেডেনসফোর্ডে। বুড়ি মিসেস ওয়েলম্যানের গুপ্তকথা ফাস করে দেবার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করার পরিকল্পনাও তার থেকে থাকতে পারত, তবে মিসেস ওয়েলম্যান ছিলেন কড়া ধাঁচের মহিলা, ওতে খুব সুবিধে হবে না এটা নার্স রাইলি বা হপকিন্স বুঝে ফেলেছিল। ফলে ও পথে পা বাড়াল না। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে মিসেস ওয়েলম্যানের সম্পত্তির পরিমাণ সম্বন্ধেও খোঁজখবর নিয়েছিল আর হয়তো দৈবক্রমে জানতে পেরে গিয়েছিল বুড়ি কোন উইল করেননি।
ফলে জুন মাসের ঐ সন্ধ্যেবেলায় নার্স ও’ব্রায়ান যখন ওকে বললে যে মিসেস ওয়েলম্যান উকিল ডাকছেন উইল করার জন্য, হপকিন্স আর দেরী করল না। মিসেস ওয়েলম্যানকে উইল না করেই মরতে হবে। যাতে তার অবৈধ মেয়ে সব সম্পত্তি পায়। ইতিমধ্যে মেরী জেরার্ডের সঙ্গে খুব ভাব জমিয়ে নিয়েছে হপকিন্স, এবং প্রায় হাতের মুঠোয় পুরে ফেলেছে স্নেহ ভালোবাসা দেখিয়ে। তারপরের কাজ হল বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মেরী জেরার্ডকে দিয়ে উইল করানো, যাতে সে তার সম্পত্তি মাসিকে দিয়ে যায়, এমনকি উইলের কথাগুলো পর্যন্ত নিজের ইচ্ছামত করে লিখিয়ে নিল। সম্পর্কের কোন উল্লেখ করা হল না, শুধু লেখা হল–স্বৰ্গত এলিজা রাইলির বোন মেরী রাইলি। একবার ওতে সই হবার পর মেরীর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। তারপর শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকা। আমার অনুমান, খুন করার পুরো প্ল্যানটা ও এঁটে ফেলেছিল। নিজেকে বাঁচাবার জন্য অ্যাপোমরফিন ব্যবহার করবে তাও ঠিক করে রেখেছিল। হয়তো ঠিক করেছিল এলিনর আর মেরীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। কিন্তু যখন এলিনর আউট হাউসে এসে স্যাণ্ডউইচ খাবার নেমন্তন্ন করল তখন ঐ সুবর্ণসুযোগটাকে হাতের কাছে পেয়ে ও কাজে নেমে পড়ল। পরিস্থিতি এমনই ছিল যে এলিনর শাস্তি পেতই।
ধীরে ধীরে ড. লর্ড বললেন, আপনি না থাকলে এলিনরের শাস্তি হতই।
সঙ্গে সঙ্গে পোয়ারো বললেন, না বন্ধু, ওঁর উচিত আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া।
আমি? আমি তো কিছুই করিনি। আমি চেষ্টা করেছিলাম…।
বাকীটা ড. লর্ড বললেন, না, পোয়ারো হেসে বললেন, হ্যাঁ, বন্ধু, আপনি প্রচণ্ড চেষ্টা করেছিলেন, তাই না? আপনি অধৈৰ্য্য হয়ে উঠেছিলেন, কিছুই করতে পারছি না দেখে। আপনার মনে ভয়ও হচ্ছিল উনি দোষী প্রমাণিত না হয়ে যান। ফলে চরম অধৈৰ্য্য হয়ে গিয়ে আপনিও আমাকে মিথ্যে কথা বললেন। ভবিষ্যতে আপনার উচিত হবে জ্বর-জ্বালার চিকিৎসার মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখা। খুনের কিনারা করতে চেষ্টা করবেন না। ড. লর্ড লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন–আপনি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন…মানে প্রথম থেকেই? আপনি আমার হাত ধরে ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে গেছেন। আপনার নিজেরই জার্মান দেশলাই বাক্স খুঁজে পেতে সাহায্য করলেন আমায়। একেবারে ছেলেমানুষী ব্যাপার।
ড. লর্ড এড়াতে চাইলেন প্রসঙ্গটা। পোয়ারো বলেই চললেন, মালীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিলেন আপনি এবং ওকে দিয়ে বললেন, যে ঐ দিন সকালে রাস্তার ওপরে ও আপনার গাড়িটা দেখেছে। অথচ আমাকে বোঝাতে চাইলেন ওটা আপনার গাড়ি নয়। অন্য কেউ এসেছিল, উদ্দেশ্য আমি যাতে বিশ্বাস করি ওখানে বাইরের লোক এসেছিল।
আমি একটা গাধা, বললেন ড. লর্ড।
ওদিন সকালে হান্টারবেরীতে কেন গিয়েছিলেন আপনি?
আরে ওটা নেহাতই বোকামী আমার…আমি শুনেছিলাম উনি এসেছেন, একবার দেখার জন্য ওখানে গিয়েছিলাম। গিয়ে যে কথা বলব তার জন্য কিন্তু যাইনি। আমি..আমি শুধু একবার চোখে দেখবার জন্য গিয়েছিলাম। ঝোঁপের ধার থেকে ওঁকে স্পষ্ট দেখলাম মাখন আর রুটি কাটছেন… ।
সেই শার্লোট আর কবি ওয়ারদারের মতো…তারপর বন্ধু…
আর বলার কিছু নেই। ঝোঁপের ধারে দাঁড়িয়ে যতক্ষণ উনি ছিলেন, দেখলাম।
প্রথম দর্শনেই কি এলিনর কার্লিসলের প্রেমে পড়েছিলেন?
মনে হয় তাই।…
যাই হোক উনি এবং রডারিক ওয়েলম্যান এরপর সুখেই থাকবেন আশা করি।
বন্ধু হে, ও ধরনের কোন আশাই আপনার করা উচিত হবে না।
কেন নয়। মেরী জেরার্ডের ব্যাপারটার জন্য উনি নিশ্চয়ই রডারিক ওয়েলম্যানকে ক্ষমা করবেন। ওটা সাময়িক উন্মত্ততা মাত্র।
ব্যাপারটা অত সহজ নয় বন্ধু, ফাটলটা অনেক গভীরে সৃষ্টি হয়েছে। অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে ব্যবধানের মত। মৃত্যুর উপত্যকা পার হয়ে এসে কেউ আর অতীতে ফিরতে চায় না, নতুন ভাবে শুরু করতে চায়। অতীত সেখানে কোন কাজ লাগে না…
নতুন জীবন…সেই জীবনই এলিনর কার্লিসল শুরু করতে চলেছেন..আর আপনিই ওকে নতুন জীবন দিয়েছেন।
না, আমি নয়।
হ্যাঁ, আপনার ইচ্ছাশক্তি, আপনার গোঁয়ারতুমির ফলেই আমি বাধ্য হয়েছিলাম যেমনটি বলেছিলেন সেই মতো কাজ করতে। স্বীকার করুন এখন, আপনার প্রতিই উনি কৃতজ্ঞ তাই না?
হ্যাঁ, উনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, এমনকি প্রায়ই যেতে বলেছেন ওঁর কাছে..।
হ্যাঁ, আপনাকে ওঁর খুবই প্রয়োজন।
ড. লর্ড, ওঁর কাছে রডারিকের যতো প্রয়োজন ততটা নয়।
রডারিক ওয়েলম্যানের প্রয়োজন উনি কখনই অনুভব করেননি। উনি ওকে ভালোবাসতেন, মনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও খানিকটা মরিয়া হয়ে।
উনি কখনোই আমাকে ওর মতো ভালোবাসতে পারবেন না–শান্তভাবে পোয়ারো বললেন, হয়তো না। কিন্তু আপনাকে ওঁর খুবই দরকার, আপনাকে ঘিরেই উনি নতুন জগৎ গড়তে পারবেন আবার। পোয়ারো শান্তস্বরে বললেন, বাস্তবকে মেনে নিতে পারেন না? উনি রডারিক ওয়েলম্যানকে ভালোবাসতেন, তাতে কি হয়েছে? আপনাকে পেলে উনি তো সুখী হতে পারেন…।